পঞ্চগড় জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ৫ জয়িতার জীবন সংগ্রামের কাহিনী

মোঃ মোজাহারুল আলম জিন্নাহ্ রানা,জেলা প্রতিনিধি পঞ্চগড়- জেলার বোদা উপজেলার সুভাসুজন গ্রামের কৈকেয়ী রানীর জীবন কাহিনী।
১। অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী এক নারী । কৈকেয়ী রানীর বাবা ছিল দিনমজুর। সে অন্যের বাসায় ও মাঠে কাজ করে সংসার চালাত। কৈকেয়ী রানী ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তার পর অন্যের দোকানে সেলাই কাজ করতেন। একজন গরীব ছেলের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। তাঁর স্বামী তাকে ঠিকমত ভরণপোষণ দিতে পারতোনা।
সংসার ছিল অভাব অনটনে জর্জরিত। অভাবের তাড়নায় তিনি নিজেও সেলাইয়ের কাজ শিখে স্বামীকে সাহায্য করা শুরু করলেন। পাশা পাশি অল্প টাকা বেতনে ডেন্টাল লাইফ ইন্সুরেন্স লিঃ এ চাকুরী নেন। দিনে চাকুরীর পাশা পাশি সেলাই কাজের অর্ডার নিতেন এবং রাত্রে সেলাই কাজ করতেন। এভাবে কৈকেয়ী রানী নিজ প্রচেষ্টায় আতœনির্ভরশীল হয়েছেন এবং সমাজে অর্থনৈতিক ভাবে সফলতা অর্জন করেছেন। তাঁর দোকানে এখন ১২ জন মহিলা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাঁকে দেখে অনেক অসহায় গরীব নারী অনুপ্রেরণা পায়। কৈকেয়ী রানী ইউনিয়ন পরিষদ ও বিভিন্ন এনজিও এবং দর্জিবিজ্ঞান প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন এবং অসহায় দরিদ্র মহিলাদের আতœনির্ভরশীল হওয়ার সাহস দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে তাঁর তিন রুম বিশিষ্ঠ পাকা বাড়ি আছে। মাঠে ৫ বিঘা আবাদী জমি ও বাজারে ১১ শতক জমি আছে যেখানে তিনি ট্রেনিং সেন্টার খুলেছেন। তাঁর দুই সন্তান উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে। বর্তমানে তার সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। #

জেলার আটোয়ারী উপজেলার নিতুপাড়া গ্রামের জোসনা বেগমে জীবন কাহিনী।
০২। শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী এক নারী। আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর পূর্বে জেলার আটোয়ারী উপজেলার নিতু পাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোঃ আব্বাস আলীর সাথে পারিবারিক ভাবে জোসনা বেগমের বিবাহ হয়। দিন মজুর স্বামীর সম্পদ বলতে কিছু ছিল না। আর্থিক অবস্থাও ছিল শোচনীয় অন্যের জমিতে বাড়ি করে থাকত। বিয়ের এক বছর পরে একটি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। বর্তমানে মেয়ের বয়স প্রায় ১৪ বছর। সন্তান জন্মের পর পরই তার তাঁর স্বামী মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। স্বামী উধাও হওয়ার পর বেশ কিছু দিন পর স্বামীর অভাব অনাটনের সংসারে মেয়ে নিয়ে দিশাহারা হয়ে যায় এবং সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। অবশেষে বাবার বাড়িতে ফিরে আসে। বাবার বাড়ি ফিরে আসার পর নিকট আতœীয়ের সহযোগীতায় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ১,৫০,০০০/- টাকা খরচে লেবাননের ভিসা নিয়ে লেবাননে যাওয়ার সুযোগ হয়। লেবাননে তিন বছর থাকার পর বাড়িতে আসে এক বছর থাকার পর বর্তমানে হংকং পাড়ি জমায়। বর্তমানে তিনি বিদেশে সন্তোষজনক বেতনে চাকুরী করে জীবনে সফলতা অর্জন করেছেন এবং অবহেলিত জীবন থেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর বাবাসহ ১৪ বছরের মেয়ের ভরণপোষন ও লেখা পড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর জীবনে এখন স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে।
জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার বাজার পাড়া গ্রামের হোসনে আরা বেগমের জীবন কাহিনী।
০৩। সফল জননী এক নারী । হোসনে আরা বেগম ছিলেন গ্রামের একটি সাধারণ কৃষক পরিবারের মেয়ে। তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তেন তখন তার গ্রামের মোজাহার হোসেনের সাথে বিয়ে হয়। স্বামীর সম্পদ বলতে শুধু নিজের বাড়ি ছিল। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় পরিবার পরিকল্পনা তিনি জানতেন না। ফলে একে একে আটটি সন্তান জন্ম নেয়। চারটি ছেলে ও চারটি মেয়ের মধ্যে ৩য় সন্তানের বয়স যখন ৫ বছর তখন তার স্বামী দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্তান্ত হয়। আর্থিক সামর্থ ও বর্তমান সময়ের মত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় তাকে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে সংসারের হাল ধরতে হয় এবং অনেক কষ্টে সন্তানদের পড়াশোনা করাতে হয়। তাঁর ৮ জন সন্তান হলেও প্রত্যেকটি সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন এবং আতœীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের সন্তানদের শিক্ষিত করার জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ সহ বিভিন্ন সমাজ সেবা মূলক কাজে জরিত আছেন। তাঁর ৮ সন্তান সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরের কর্মরত রয়েছেন।#
জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহার গ্রামের অনিতা বালার জীবন কাহিনী।
০৪। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে আবারও নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী- অনিতা বালা সোনাহার গ্রামের একজন সাধারণ মহিলা। তিন ছেলে মেয়ের জননী অনিতা বালা। দিন মজুর স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে ভালই কাটছিল তার সংসার জীবন। তাদের এই সুখ শান্তি চোখের কাটা হয়ে বিধল প্রতিবেশী বখাটে যুবকদের চোখে। একদিন সুযোগ বুঝে বখাটে যুবকেরা অনিতা বালাকে কুপ্রস্তাব দিলে তাৎক্ষনাত তা প্রত্যাখান করেন অনিতা বালা। যুবকদের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কারণে যুবকেরা অনিতা বালার ক্ষতি করার হুমকি দেয়। সুযোগ বুঝে ১৭/০২/২০০২ খ্রিঃ তারিখ গভীর রাতে বখাটে যুবকেরা ঘুমন্ত অনিতা বালার উপর এসিড নিক্ষেপ করে। অনিতা বালা ঘুমন্ত অবস্থায় চার বছরের ছেলে শ্যামল ও পাঁচ বছরের মেয়ে শ্যামলীসহ নিক্ষিপ্ত এসিডে আক্রান্ত হয়। এতে অনিতার সারা শরীর,ছেলে শ্যামলের মাথা,বুক ও উভয় হাত এবং মেয়ে শ্যামলীর মুখমন্ডলসহ শরীরের বামপাশ এসিডে ঝলসে যায়। এ এস এফ হতে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে ছেলে মেয়ের স্বাভাবিক জীবন ফিরে এলেও অনিতা বালার একটি চোখ চিরদিনের জন্য হারায় এবং ক্ষতের যন্ত্রণা বেয়ে বেড়াচ্ছে। এসিড আক্রান্ত পরিবার চিকিৎসার খরচ যোগাতে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পরে। এসিডে এক চোখ হারিয়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে আবার শুরু হয় অনিতার সংগ্রামের পথ চলা। এ এস এফ হতে পাওয়া ভ্যান নিয়ে সংসার ও ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে। অনিতা বালাকে ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির পক্ষ থেকে ৩০,০০০/- দামের দুটি বকনা গরু প্রদান করা হয়। অনুদানে পাওয়া দুটি গাভী পালন করে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে আবারও নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন। তার সংসারে এখন সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। সমাজে সে মাথা উচু করে বেঁচে আছে। বর্তমানে স্বামী ছেলে মেয়েকে  নিয়ে অনিতা বালার সংসারে কিছুটা হলেও সুখের হাওয়া বইছে।#

 জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার ময়নাগুড়ি গ্রামের  -মোছাঃ সুলতানা রাজিয়ার জীবন কাহিনী।
০৫। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী ,মোছাঃ সুলতানা রাজিয়া তেঁতুলিয়া উপজেলার ময়নাগুড়ি গ্রামের মৃত হযরত আলী সরকার এর কনিষ্ঠ পুত্র ¯œাতক বর্ষের ছাত্র ছাদাক্কাস আলী সরকার এর সঙ্গে বিবাহ হয়। বিয়ের পর নানা প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাবার চেষ্ঠা করেন। কলেজ পড়–য়া স্বামীর সংসারে অভাব অনটন থাকলেও কোন দিন লজ্জায় তা কারো সামনে প্রকাশ করেননি। স্বামীর সহযোগীতায় তেঁতুলিয়া ডিগ্রী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। শ্বশুর শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর শুরু হয় তাদের পৃথক সংসার। সুলতানার সংসারে বেকার স্বামীকে সহযোগীতা করার জন্য নববধু থাকাবস্থায় গণসাহায্য সংস্থা (জিএসএস) কর্তৃক পরিচালিত স্থানীয় স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে সাতশত টাকা বেতনে চাকুরী নেন। বাই সাইকেল চালিয়ে মাঠ পর্যায়ে চাকুরী করেন। ১৯৯৫ সালে তার সংসারে প্রথম কন্যা সন্তান জন্ম হয়। সেই কোলের সন্তানকে নিয়ে তিনি উন্নত জীবিকার সন্ধানে ১৯৯৭ সালে কেয়ার বাংলাদেশ পুষ্টি প্রকল্পের অধীন বারোশত টাকার বেতনে সুপারভাইজার পদে চাকুরী নেন। সে সময় সংসারে বাড়তি আয় করার জন্য পুষ্টি প্যাকেট ও উহার মালামাল বাড়িতে বিক্রি করেন। তিনি চাকুরীরত অবস্থায় সমাজ সেবার মতো মহৎ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী ২০১৪ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় বারের মতো মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন এবং তার স্বামী কালান্দিগঞ্জ দ্বি-মূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। দাম্পত্য জীবনে এক কন্যা ও এক ছেলে রয়েছে। তাঁর কন্যা সন্তান বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছেলে সন্তান উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। উপজেলা পরিষদে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হওয়ার পর যেখানেই নারীদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড,সমস্যা ও পারিবারিক কলহের কথা শুনছেন সেখানেই নিজ খরচে মোটর সাইকেল চালিয়ে পৌছে নারীদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সহযোগীতা সমাধান ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন।এই ভাবে তিনি নারীদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

পুরোনো সংবাদ

রংপুর 6922773294728613606

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item