গাভীর দুধে চরবাসীর মুখে হাসির ঝিলিক

হাজী মারুফ রংপুর ব্যুরো অফিস :

গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলা সদরের মূল-ভূখন্ড থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ফুলছড়ি, ফজলুপুর ও এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়ন। এ তিনটি ইউনিয়নে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে বর্ষায় ইঞ্জিনচালিত শ্যালোনৌকা, আর শুকনো মৌসুমে মোটরসাইকেল অথবা পায়ে হেঁটে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘপথ যাতায়াত। সরেজমিন চরাঞ্চল ঘুরে উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের পশ্চিম খাটিয়ামারি গ্রামের শেষ প্রান্তে মিললো এক সময়ের দুধ বিক্রেতা গোলাপ হোসেনের বাড়ি।বাড়ির বাহির আঙিনায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, নদীভাঙনে আমি নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পরে এ গ্রাম-ও গ্রাম ঘুরে বাড়ি বাড়ি থেকে দুধ সংগ্রহ করে ফুলছড়ি বাজারে বিক্রি করতাম। সে সময় প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ টাকার বেশি আয় হতো না। তা দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক পর্যায়ে একটি বেসরকারি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বছর দশেক আগে একটি বকনা বাছুর কিনি। সেই বাছুরটিই আজ আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। গোয়ালে আমার এখন ছয়টি দেশি জাতের গাভী। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লিটার দুধ পাচ্ছি। এখন আমাকে আর বাজারের দুধ বিক্রি করতে হয় না। বাড়ি থেকে পাইকাররা ৩০ টাকা লিটার দরে দুধ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মাসে প্রায় ১৮ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। এর মধ্যে আবার গরুর খাবার হিসেবে ব্যয় হচ্ছে প্রায় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তবে আমার সবচেয়ে বড় ভয় ডাকাত ও জলদস্যুর। তাই প্রতিনিয়ত গাভীগুলোকে রক্ষায় রাত জেগে গোয়ালঘর পাহারা দিতে হচ্ছে।’ফুলছড়ি ইউনিয়নের খঞ্চাপাড়া গ্রামে মহিষের দুধ বিক্রি করে ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, আমি দুধ বিক্রি করি এত কিছু করপ্যার পারব, তা কনোদিন ভাবি নাই। এই যে মহিষগুল্যোর জন্নেই আইজ হামার এরমক অবস্থা।ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙনে নিঃস্ব আলতাফ হোসেনের বসতভিটা পর্যন্ত ছিল না। ভাঙনদুর্গত আরও অনেক মানুষের সঙ্গে তিনি ফুলছড়ি উপজেলার যমুনার চর খঞ্চাপাড়া গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। অন্যের জমিতে দিনমজুরি খেটে ও বর্গাচাষী হিসেবে কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালাতেন। আজ তার ঘরবাড়ি, জমিজমা সব হয়েছে। এলাকায় তিনি এখন অন্যতম সচ্ছল মানুষ। তার গোয়ালে আজ পাঁচটি মহিষ। মহিষেই তার ভাগ্য পাল্টেছে বলে জানান তিনি। প্রতিদিন প্রায় ৩৫ থেকে ৩০ লিটার মহিষের দুধ পান। জেলা সদর থেকে এসে এ দুধ ৪০ থেকে ৫০ টাকা লিটার কিনে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। গোলাপ হোসেন ও আলতাফ হোসেনের মতো গরু ও মহিষ পালন করে দুধওয়ালাদের অবস্থা বদলের অনেক কাহিনী শুনতে পাওয়া যায় ফুলছড়ির চরাঞ্চলে গিয়ে।

ফজলুপুর ইউনিয়নের পশ্চিম খাটিয়ামারি গ্রামের দুধ বিক্রেতা বাদশা মিয়া, আবু সাঈদ, কছিম উদ্দিন, ফুলছড়ি ইউনিয়নের খঞ্চাপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম, হাসেম আলীসহ প্রায় ৪০ জন ব্যক্তি দুধ বিক্রি করে তাদের জীবনে এনেছেন পরিবর্তন। বন্যা আর নদী ভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন কাটানো চরবাসীর জীবনে অর্থনৈতিক দুর্দশা প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। তবে গরু-মহিষ লালন-পালনের মধ্যে দিয়ে দৈন্যদশা ঘুচে স্বচ্ছলতা এসেছে তাদের জীবনে।উপজেলার ফুলছড়ি ইউনিয়নের টেংরাকান্দি, গাবগাছি, পিপুলিয়া, খঞ্চাপাড়া, বাঘবাড়ি, দেলুয়াবাড়ি, পূর্ব খোলাবাড়ি, ফজলুপুর ইউনিয়নের পশ্চিম খাটিয়ামারি, পূর্ব খাটিয়ামারি, নিশ্চিন্তপুর, কাউয়াবাঁধা, এরেন্ডাবাড়ির হরিচন্ডি, আলগারচর, জিগাবাড়ি, গজারিয়া ইউনিয়নের গলনা, জিয়াডাঙ্গা, ভাজনডাঙ্গা, ঝানঝাইর, কটকগাছা, উড়িয়া ইউনিয়নের কালাসোনা, রতনপুরসহ ফুলছড়ি উপজেলার ছোট-বড় সব চরেই এখন গরু পালনের জন্য আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে। একটির সঙ্গে আরেকটি চরের দূরত্ব প্রায় তিন থেকে ছয় কিলোমিটার। এসব চরে লোকসংখ্যা পপ্রয় ৮০ হাজার।সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এসব গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে গরুর ছোট ছোট খামার। সাতসকালেই চলছে গাভীর দুধ দোয়ানোর তোড়জোড়। কাজের ফাঁকে খাটিয়ামারি গ্রামের দুধ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি সকাল ও বিকেল মিলিয়ে প্রতিদিন চর থেকে ১৫ থেকে ২০ লিটার দুধ সংগ্রহ করেন। সেগুলো ফুলছড়ি এলাকার বিভিন্ন বাড়ি ও মিষ্টির দোকানে বিক্রি করেন।তিনি আরও জানান, তার মতো চরের কমপক্ষে ৪০জন ব্যবসায়ী চর থেকে দুধ সংগ্রহ করে হাট-বাজারসহ বিভিন্ন বাসাবাড়িতে সরবরাহ করেন। এছাড়াও জেলা শহর থেকে ছানা তৈরির কারখানার অনেক লোক এসেও দুধ নিয়ে যান। দৈনিক কমপক্ষে পাঁচ হাজার লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে।একই এলাকার আরেক দুধ ব্যবসায়ী বাদশা মিয়া বলেন, প্রায় এক মণ ওজনের দুধের ভার ঘাড়ে নিয়ে শুকনো মৌসুমে দুই থেকে তিন কিলোমিটার বালুচর পায়ে হেঁটে ঘাটে আসতে হয়। এতে আমাদের খুব কষ্ট ভোগ করতে হয়। সরকারিভাবে চরাঞ্চলে যদি পাকা রাস্তা তৈরি করা হতো তাহলে রিকশা বা ভ্যানে করে দুধের টিন আনা-নেওয়া করতে পারতাম।ব্রহ্মপুত্র নদের তিস্তামুখ ঘাটে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে গিয়ে দেখা যায়, দুধ নিয়ে আসা একটি নৌকা থেকে আট থেকে দশটি দুধের পাইকার টিনভর্তি দুধ নিয়ে কিনারে নামছেন। নৌকার মাঝি কমল মিয়া জানান, বালাসীঘাট, হাজিরহাট ও ফুলছড়িঘাটে দৈনিক চারটি দুধের নৌকা আসে। দৈনিক অন্তত পাঁচ হাজার লিটার দুধ চর থেকে আসে বলে স্থানীয় পশুসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়।ফুলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা এম এ সবুর সরকার জানান, অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি চরে আয়ের উৎস হচ্ছে গরু পালন। কিন্তু চোর ডাকাতের উৎপাতে গরু পালনেও ভয় পাচ্ছে চরের মানুষ। তার মতে, মানুষের নিরাপত্তার জন্য চরের টেংরাকান্দিতে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা বিশেষ প্রয়োজন। ফাঁড়ি স্থাপন হলে চরের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাবে। বর্তমানে গাভীর দুধ ও গরু মোটাতাজা করা থেকে ভালো লাভ হতে দেখে গরু পালনে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ছে। এখন চরের প্রায় বাড়িতেই গড়ে উঠেছে গরুর খামার। অন্তত ৬০ ভাগ মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে এ গরু পালন করে।গো-খাদ্য সব সময় পাওয়া যায়। রাখাল সারাদিন গরুগুলোকে চরের পতিত জমিতে ছেড়ে দেওয়ায় খাদ্যের অভাব নেই। তাই সেখানে গরু পালন দিন দিন বেড়ে চলেছে।

পুরোনো সংবাদ

নিবিড়-অবলোকন 322532765349146399

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item