একটা শহীদ মিনারের জন্য

লেখক- মোঃ মফিজার রহমান দুলাল (বীরমুক্তিযোদ্ধা)
সাবেক ভি,পি,নীলফামারী মহকুমা ডিগ্রী কলেজ
ডোমার, নীলফামারী।

লেখাটি সংগ্রহ করেছেন-আনিছুর রহমান মানিক
ডোমার(নীলফামারী) প্রতিনিধিঃ

আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে,২০ শে ফেব্র“য়ারি ১৯৬৫ সাল। দুপুর ২টা, নীলফামারী মহকুমা ডিগ্রি কলেজ সংলগ্ন পুকুর পাড়। আমাকে ডেকে পাঠানো হলো। গিয়ে দেখি দুই ছাত্রনেতা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।  একজন প্রখ্যাত অভিনেতা, অসহায়- অসুস্থ দুঃখী গরিব মানুষের বিপদের বন্ধু এবং আমার ছাত্র রাজনীতির গুরু মাননীয় সংস্কৃতিক মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নুর ভাই। অন্যজন ষাট দশকের সংগ্রামী ছাত্রনেতা, ডোমার উপজেলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদের সাবেক সভাপতি মরহুম গোলাম মোস্তফা বাউলাদা। দু’জনেই আমার নিকট জানতে চাইলেন একটি কঠিন এবং অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য আমি প্রস্তুত আছি কিনা? আমি একবাক্যে উত্তর দিলাম আমি প্রস্তুত। নুর ভাই একটা চিঠি আমার হাতে দিয়ে মনোযোগ সহকারে আমাকে যে কাজগুলো করতে হবে- তা বুঝিয়ে দিলেন। সময় মাত্র আজ রাতটা। কারণ আগামীকাল মহান ২১ শে ফেব্র“য়ারী। আজ রাতের মধ্যেই আমার নেতৃত্বে খুব গোপনে দেবীগঞ্জে একটা নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করতে হবে। আগামীকাল সকালে সেই নতুন শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পন করে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করে মহান ২১ শে ফেব্র“য়ারী সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে হবে। এই গুরুদায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথে আমার শরীরের সম্পূর্ণ লোম খাড়া হয়ে গেল। রক্ত দ্বিগুন গতিতে প্রবাহিত হতে লাগলো। আনন্দ ও উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে। কারণ একজন সামান্য কর্মী হিসেবে এই গুরুদায়িত্ব পাওয়াটা আমার জন্য সামান্য ব্যাপার নয়। গৌরব অনুভব করলাম। চিঠিটার ব্যাপারে জানতে চাইলে নুর ভাই বললেন এই চিঠিটা আজ গভীর রাতে খুব গোপনে দেবীগঞ্জ থানার সিও (ডেভ) সাহেবের বাসায় গিয়ে তাঁর হাতে দিবে। সিও (ডেভ) আমার পরিচিত এবং খুব ভাল মানুষ। শহীদ মিনার তৈরির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দিবেন। বিকেলের ট্রেনে ডোমারে এসে একখানা পুরাতন বাইসাইকেলে বালু ও ধুয়াময় ছয় মাইল রাস্তা পেরিয়ে সন্ধ্যায় দেবীগঞ্জ বাজারে এলাম ।  এখানে আমার জন্য দেবীগঞ্জ হাইস্কুলের ছাত্রনেতা মনিররুল চৌধুরী, মোজাম্মেল হক, এনামূল, স্বদেশ ও আনাররুল হক বাবুল অপো করছে। সবাই মিলে মুড়ি ও  কলা খেয়ে সারাদিনের ক্ষুদা নিবারণের চেষ্টা করলাম। গভীর রাতে আমি এবং মনিররুল খুব সাবধানে সিও (ডেভ) সাহেবের বাসায় গিয়ে তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আমাদের পরিচয় এবং নুর ভাইয়ের চিঠিটা দিলাম। চিঠিখানা খুব গোপনে পড়লেন এবং একটা লোকের সঙ্গে আমাদেরকে সাবধানে যেতে বলেলেন। ঘনকুয়াশা এবং গভীর রাত্রীতে লোকটা একটা গোডাউন থেকে এক বস্তা সিমেন্ট দিলেন এবং গোডাউনের পাশে ইট আছে যা লাগে খুব সাবধানে নিয়ে যেতে বলেই উধাও হয়ে গেলেন। সবাই মিলে (ছয়জন) প্রয়োজনীয় ইট এনে জমা করলাম। গায়ের চাঁদর দিয়ে পুকুর পাড় থেকে বালু আনলাম। পাশের মসজিদ থেকে দুইটা ওজুর বদনা এনে ইট ভিজানোর ব্যবস্থা করলাম। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন,ঠান্ডা বাতাস মাঝে মাঝে টিপ টাপ বৃষ্টির ফোটা । এভাবেই রাত ১টা বেজে গেল কিন্তু রাজমিস্ত্রির দেখা নাই। কেউ ভয়ে আসতে চায় না। রাত ২টার সময় ভোলামিয়া নামের একজন রাজমিন্ত্রিকে একপ্রকার জোর করে মনিরুল নিয়ে আসে। অনেক কষ্টে একটা কুপি সংগ্রহ করলাম। সেই কুপির আলো দিয়েই গভীর রাতে দেবীগঞ্জ  হাইস্কুল মাঠে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ আরম্ভ করলাম। ফজরের আজানের সাথে সাথে অনেক কষ্ট, ত্যাগ, পরিশ্রমের মাধ্যমে দেবীগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে তৈরি হলো এই অঞ্চলে প্রথম শহীদ মিনার। নতুন শহীদ মিনারের চারদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তাড়াতাড়ি বাজারের একটা চায়ের দোকানে গেলাম। দোকানে কেই নেই। ভিতরে শুধুমাত্র একখানা মাচাং, সেই মাচাংয়ে আমরা সবাই মিলে শুয়ে পরলাম। সারা দিন- রাত প্রায় অনাহারে থেকে এবং অমানুষিক পরিশ্রম করে কান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি জানি না। সকালে দোকানের মালিক এসে আমাদেরকে ঘুমাতে দেখে ডেকে তুললেন এবং তার মুখে জানতে পারলাম সারা রাতের অমানবিক পরিশ্রমে যে শহীদ মিনার আমরা তৈরি করেছি। দেবীগঞ্জ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা শফিউল আলম (ছাব্দার মিয়া) পা দিয়ে লাথি মেরে সেই শহীদ মিনার ভেঙ্গে দিয়েছে। যারা শহীদ মিনার তৈরি করেছে, তাদেরকে ছাব্দার মিয়া ও তার দলের লোকজন এবং পুলিশ খুঁজছে। সুতরাং আমাদের বাজারে না থাকার জন্য অনুরোধ করলো। আমরা প্রতিবাদ করতে চাইলাম। কিন্তু জনগন সেখান থেকে আমাদেরকে একপ্রকার জোড় করে যার যার বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। যাতে আমরা পুলিশের  হাতে ধরা না পড়ি। দেবীগঞ্জ থেকে ডোমারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রচন্ড পরিশ্রমে ও ক্ষুধায় পা টলমল করছে। কেমন করে ডোমারে এলাম আমি নিজেও জানি না। বাউলাদার সাথে দেখা করে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। সাথে সাথে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। প্রথম ডোমারে বাউলাদার নেতৃত্বে। পরে নীলফামারীতে খবর পাওয়ার পর সাথে সাথে নুর ভাইয়ের নেতৃত্বে মিছিল এবং প্রতিবাদ সভা হয়। পরের দিন ২২ ফেব্র“য়ারী প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দেবীগঞ্জ  হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কর্তৃক ‘মহান শহীদ মিনার’ পা দিয়ে লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলার খবর প্রকাশিত হয়। আজো প্রতিবছর ২০ শে ফেব্র“য়ারীর রাতটা আমার হতাশার, ব্যাথা এবং বেদনার রাত। শত চেষ্টা করেও ভূলতে পারি না। বারবার ভেসে উঠে গভীর রাতে কুপি দিয়ে তৈরী করা ‘মহান শহীদ মিনার’- এর অনুভূতি। কতো চেষ্টা এবং কত অমানবিক পরিশ্রম করেছি শুধু মাত্র একটি শহীদ মিনারের জন্য। অথচ আজ হাজার হাজার শহীদ মিনার প্রত্যেক স্কুলে এবং কলেজ প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো স্কুল বা কলেজে দুইটি করে শহীদ মিনার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। অনেক শহীদ মিনার তৈরির পর থেকে একবারও শহীদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় না। স্কুলের ছেলে মেয়েদেরকে (মফস্বলের) জিজ্ঞাসা করলে সেখানে (শহীদ মিনার) ফুল দিয়ে পুঁজা করা হয় বলে তাদের ধারণা। মাতৃভাষা দিবস, শহীদ দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস অথবা একুশে ফেব্র“য়ারী সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারনাই নেই। কারণ এখন আর শহীদ মিনার তৈরি করতে দেশাত্ববোধ, শ্রদ্ধা, হৃদয়ের অনুভূতি ভালোবাসা ও শহীদের প্রতি গভীর অনুভূতির কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র টাকা হলেই ঠিকাদার শহীদ মিনার তৈরী করে দেন। আমার অনুরোধ শুধুমাত্র টাকার জোড়ে বড় বড় শহীদ মিনার তৈরি না করে ছেলেমেয়েদের এবং জনসাধারণকে সাথে নিয়ে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, হৃদয়ের উন্মেশ ঘটিয়ে সকলের সমন্বয়ে মহান শহীদ মিনার তৈরি করুন। তাহলেই কেবল মহান শহীদদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে। ধন্যাবাদ সকলকে.........

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item