চিলাহাটি -হলদিবাড়ি রুটে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবশিষ্ট লাইনপাতার কাজ শেষ


ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়॥
বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে (স্বাধীনতার ৫০ বছর) ১৬ ডিসেম্বর/২০২০ বা ২৬ মার্চ/২০২১) বাংলাদেশের চিলাহাটি ও ভারতের হলদিবাড়ি আন্তর্জাতিক ট্রেন রুটে এবার ট্রেনের হুইসেল শোনা যাবে। সেদিন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী এই রুটের ট্রেন চলচলের আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্ধোধন করবেন। সেই ভাবেই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। 

দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকা এই রুটকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

১৯৬৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া ৫৬ বছর পর ট্রেনের এই হুইসেল শোনার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে নীলফামারী জেলা বাসী। চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথটিকে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বান্ধব রেলপথ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। নেপাল ও ভুটানো এই রেলরুটের আওয়ায় সংযুক্ত হতে যাচ্ছে।  


দেশের উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী জেলার চিলাহাটি ও ভারতের কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ি আন্তর্জাতিক সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে রেললাইন পাতানোর কাজ শেষ করা হয়েছে। সীমান্তের ২০০ মিটার নো-ম্যান্স ল্যান্ডে পহেলা অক্টোবর অবশিষ্ট লাইনপাতার কাজ শেষ করা হয়।  

সূত্র মতে, সড়ক পথে ব্যয় কমাতে নীলফামারীর চিলাহাটি ও ভারতের হলদীবাড়ি এই রেলপথকে সব থেকে গুরুত্ব দিচ্ছেন আমদানী ও রপ্তানীকারনগন। মালগাড়ীর পাশাপাশি ঢাকা ও খুলনা থেকে সরাসরি যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে শিলিগুড়ি পর্যন্ত। পাশাপাশি ভারতের শিয়ালদহ রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে পেট্রাপোল সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশের বেনাপোলে ঢুকবে ট্রেন। বাংলাদেশের ভেতরে যশোর, দর্শনা, পাকশী ঈশ্বর্দী, নাটোর সান্তাহার, জয়পুরহাট পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী ও চিলাহাটি পেরিয়ে ফের তা গিয়ে উঠবে ভারতের হলদিবাড়িতে। সেখান থেকে গিয়ে পৌঁছাবে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি। 

বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় এই রেলপথের বিষয়ে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তির ভিত্তিতে গত বছরের (২০১৯) ২১ সেপ্টেম্বর দুই দেশের রেল লাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছিল। এই কাজের উদ্ধোধন করেছিলেন রেলপথ মন্ত্রী এ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন এমপি। কথা ছিল চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে দুই দেশ রেললাইন পাতানো সহ অন্যান্য অবকাঠানো নির্মানকাজ শেষ করবে এবং জুলাই থেকে ট্রেন চলাচল শুরু করা হবে। কিন্তু চলমান করোনা ভাইরাসের লকডাউনের কারনে ভারত ও বাংলাদেশ চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ায় পুনরায় এই কাজ শুরু হয়। যা পহেলা অক্টোবর রেললাইন বিছানো সমাপ্ত করা হয়েছে।  

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে শেষবার ট্রেন চলেছিল ভারতের হলদিবাড়ি ও চিলাহাটির মধ্যে। সেই সময়  দার্জিলিং মেইল নামের একটি ট্রেন কলকাতার শিয়ালদাহ থেকে ছেড়ে গেদে ও দর্শনা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নীলফামারীর চিলাহাটি হয়ে হলদীবাড়ি, জলপাইগুড়ি দিয়ে শিলিগুড়ি চলাচল করতো।  আবার একই পথে শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন ঢুকত কলকাতায়। এ ছাড়া নীলফামারীর চিলাহাটি ও হলদিবাড়ি হয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত চলাচল করতো পাসপোর্ট নামের আরেকটি ট্রেন। ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের সময় থেকে এই পথটি স¤পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই রুটকে বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াসে আজ এটি নতুনভাবে আলোর মুখ দেখতে পেল। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এ রেলপথ প্রস্তুত করতে ভারতের পক্ষে ব্যয় ৪২ কোটি রুপি ও বাংলাদেশের ৮০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ ছাড়া চিলাহাটি রেলষ্টেশটি আন্তর্জাতিক রেলস্টেশন হিসাবে নতুনভাবে তৈরী করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক রেলষ্টেশনের আদলে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, ভারতের হলদিবাড়ি রেলস্টেশন থেকে সীমান্ত পর্যন্ত পাতা হয় (নো-ম্যান্স ল্যান্ড সহ) ৩ দশমিক ৩৪ কিঃমিঃ রেল লাইন। এ ছাড়া হলদিবাড়ি থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার রেলপথকে নতুন করে স্থাপন করা হয়। অপর দিকে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার চিলাহাটি স্টেশন থেকে ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত ৬ দশমিক ৭২৪ কিলোমিটার বিছানা হয়েছে রেলপথ। সেই সঙ্গে চিলাহাটি রেলস্টেশনে পৃথকভাবে পাতানো হচ্ছে ২ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার লুপলাইন। এ ছাড়া চিলাহাটি থেকে ঢাকা ও খুলনা পর্যন্ত রেলপথ আধুনিকায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া ডবল লাইন স্থাপনের চিন্তাভাবনা চলছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভারতের হলদিবাড়ির দিক থেকে আসা ও চিলাহাটির দিক দিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়া দুই দেশের স্থাপিত রেললাইন এক সঙ্গে এসে মিলিত হয়েছে। শুধু দুই দেশের বিছানো রেললাইনের জোড়া লাগানো স্থানটিতে সামান্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। যে কোন সময় রেললাইন জোড়া লেগে যাবে। এলাকায় শুরু হয়েছে আনন্দ উৎসবের ঘনঘটা। তবে এই দৃশ্য দেখতেই যেন দুরদুরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসছে। 

ভারতের উত্তরপূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারি শুভানন চন্দের কথায়, “বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত রেল লাইন বসানোর কাজ শেষ। ডিসেম্বরেরই দুই দেশের মধ্যে ট্রেন চলাচলে কোন সমস্যা হবেনা। এখন স্থাপন করা হচ্ছে বৈদ্যুতিন সিগন্যাল।  মাটির নীচে বৈদ্যুতিক তার পাতা হয়ে গিয়েছে। সিগন্যাল পোস্টও বসানো হয়েছে। মূলত দুদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক স¤পর্কের উন্নতি ঘটাতেই ওই রেলপথ চালু হচ্ছে। চালু হওয়ার পর আপাতত ওই পথে শুধুমাত্র মালগাড়ি চলবে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি হয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ফের রেল যোগাযোগ শুরু হবে। ভবিষ্যতে ওই রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চালানো হবে।

চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথটিকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বান্ধব রেলপথ হিসেবে গণ্য করে নীলফামারী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মারুফ জামান বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শুধু মুখে বলেন না। তিনি যা বলেন তা বাস্তবায়ন করে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। এমনটাই আজ বাস্তবে পরিনত হলো-চিলাহাটি-হলদিবাড়ি ট্রেন রুটটি। তিনি বলেন, সড়ক পথে আমদানী রপ্তানীকারকগন সাচ্ছন্যবোধ করেন না। এ ছাড়া সড়ক পথে ভারত থেকে আমদানী ও বা রপ্তানী করতে পরিবহন খরচ বেশী পড়ে। সেই ক্ষেত্রে ট্রেনে মালামাল পরিবহন অনেকটাই সাশ্রয়। 

গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর এই রেলপথ নির্মানের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানের সময় সদ্য বিদায়ী ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাস বলেছিলেন, একসময় দার্জিলিং মেইল শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে আসা রেল, রানাঘাট, ভেড়ামারা, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, সান্তাহার, হিলি, পার্বতীপুর, নীলফামারী, চিলাহাটি, ভারতের হলদিবাড়ি, জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়িতে চলাচল করতো। সেটার আদলেই এই পথে আবারও দুই দেশের মধ্যে রেল চালু হবে। এর ফলে কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা একটি রেল বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রবেশ করে খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে আবার ভারতে প্রবেশ করে গন্তব্যে পৌঁছাবে। এভাবে যাতায়াতের ফলে ভারতের রেলে যাত্রাপথ অন্তত ২০০ কিলোমিটার কমে যাবে। বর্তমানে শিয়ালদহ থেকে শিলিগুড়ির দূরত্ব ৫৩৭ কিলোমিটার। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, রেলপথটি বাংলাদেশ ও ভারত, উভয় দেশের রেলই ব্যবহার করবে। ভারতের রেল যেমন এই পথ ব্যবহার করে শিলিগুড়ি যাবে, তেমনি বাংলাদেশের রেলও পথটি ব্যবহার করে শিলিগুড়ি থেকে পণ্য আনা নেওয়া করতে পারবে। মালবাহী ট্রেনের পাশাপাশি এই পথে চালু হবে যাত্রীবাহী ট্রেন। যেভাবে এখন খুলনা-কলকাতা বা কলকাতা-ঢাকা রেল যোগাযোগ রয়েছে, এটিও তেমন একটি রেল যোগাযোগ হবে। 

অপরদিকে অনেকে মনে করছেন শিলিগুড়ির সঙ্গে ঢাকা ও খুলনার থেকে সরাসরি যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হলে তা হবে অত্যান্ত লাভ জনক। পর্যটকরা ভারত সফরে শুরুতেই দার্জিলিংকে বেছে নেন। দার্জিলিং ঘুরে পর্যটকরা অনায়াসেই শিলিগুড়ি থেকে বিমানে বা ট্রেনে ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমন করতে পারবেন। এই ট্রেন রুট ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটান বাংলাদেশের মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে মালামাল পরিবহন করতে পারবে। ফলে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও এই পথে আমদানি রপ্তানি করা যাবে।'' শিলিগুড়ির সেখানকার আশেপাশের এলাকার সঙ্গও সংযোগ তৈরি হবে, যেখান থেকে পাথরসহ অনেক দ্রব্য বাংলাদেশে আমদানি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। রেলপথের কারণে অনেক সুযোগ তৈরি হবে।'' ফলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেল চলাচলে তারা যেমন সুবিধা পাবে, তেমনি ভারতের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ির সঙ্গে রেল যোগাযোগ তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যের নতুন সুযোগ তৈরি হবে। 

রেলপথমন্ত্রী এ্যাডঃ মো. নূরুল ইসলাম সুজন এমপি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি অতিক্রম করতে পারলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্রমোদীর উপস্থিতিতে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলরুট উদ্বোধন করা হবে। আর স¤পূর্ণ নিরাপদ না হলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করা হবে। মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর সুবর্ণ জয়ন্তীতে এটি আমরা উদ্ধোধনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যে সোনালি অধ্যায়ের সূচনা করেছেন, তারই ফলশ্রুতিতে এই রেলপথ চালুর কার্যক্রম আমরা অচিরেই সফলতার মুখ দেখতে যাচ্ছি।

মন্ত্রী আরো বলেন, অবিভক্ত ভারতের রেল যোগাযোগের এটিই প্রধান পথ ছিল। পাকিস্তান-ভারত ভাগ হওয়ার পরও ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সেটি চালু ছিল। কলকাতা থেকে এ পথে ট্রেন চলাচল করত। সেই যোগাযোগটি ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, গত জুন মাসে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯-এর কারণে আমরা মহা দুর্যোগের মধ্যে আছি। তার পরও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা, বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প পরিচালকের আন্তরিকতায় কাজটি শেষ করতে পেরেছি। এখন আমরা উদ্ধোধনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। #


পুরোনো সংবাদ

প্রধান খবর 893319298402972537

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item