আর কখনো লাশ বহন করবেনা সৈয়দপুরের লাশ টানা “চায়না”

ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়, নীলফামারী ১৬ জুলাই॥
ডাক নাম চায়না। তার পুরো নাম হাদিস উদ্দিন। বয়স আর কত হবে ৪৫। পুলিশের বন্ধু। ডাকামাত্রই ছুটে আসে সহায়তা করতে। ছোট বেলা থেকেই তার পেশা লাশ টানা। পচা-গলা দুর্গন্ধময় বেওয়ারিশ মানুষের লাশ নাম-মাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিজে বহন করে কবরস্থ্য করতে সহায়তা করতো। তাই অনেকে বলেন চায়না ছিলো পুলিশের জন্য এক নিবেদিত প্রাণ। আজ সেই চায়না নেই। কেউ ভাবতেই পারেনি চায়না এতো দ্রুত পৃথিবী ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমাবো।
নীলফামারীর সৈয়দপুরের গোলাহাট বিহাড়ি ক্যাম্পে তার বসবাস। রয়েছে স্ত্রী সন্তান। অপরাধ বা অন্যায় কি তা কোন দিন জানতো না চায়না।
জানা যায়, গত তিনদিন আগে কাঠাল গাছে উঠে ছাগলের জন্য পাতা পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে যায়। পেটে ঢুকে যায় লোহার রড। সৈয়দপুর হাসপাতালে নেয়া হলে তাকে দ্রুত প্রেরন করা হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তার অপারেশন করা হয়। এরপরেও তাকে বাঁচানো গেলনা। আজ সোমবার বেলা সাড়ে ৩টায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। রংপুর হতে মরদেহ নিয়ে আসা হয় সৈয়দপুরে। বাদ এশা নামাজে জানাজা শেষে গোলাহাট কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে বলে জানান সৈয়দপুর থানার ওসি শাহজাহান পাশা।
নীলফামারী থানার ওসি বাবুল আকতার তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন- সৈয়দপুর থানার লাশ বহনকারী মোঃ হাদিস উদ্দীন @ চায়না আর কখনো লাশ বহন করবেনা। সে নিজেই লাশ হয়ে অন্যের বাহনে সওয়ার। সবাই চায়না-র জন্য দোয়া করবেন।
এই স্ট্যাটাসে এসআই তামবিরুল ইসলাম লিখেছে- একবার তার লাশ বহনকারী ভ্যানের নতুন টায়ার-টিউব কিনে দিয়েছিলাম, সে এতটা খুশী হয়োছিল যে তার হাসিমাখা মুখখানি এখনও মনে আছে আমার। আল্লাহ চায়না কে জান্নাতবাসী করুন, আমীন।।।

এস আই ইসলাম হোসেন লিখেছেন- (ইন্না লিল্লাহি-----রাজিউন। হে প্রভু ! পচা-গলা শেয়াল-শকুনের  খোরাক, দুগন্ধময় বেওয়ারিশ মানুষের লাশ নাম-মাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিজে বহন করে কবরস্থ করতে সহায়তা করা যদি পুণ্যের কাজ হয়, হে আল্লাহ সেই সকল পুণ্যের বিনিময়ে তুমি চায়নার বিদেহি আত্মাকে তোমার জান্নাতে রাখিও।জান্নাতুল ফেরদাউস তার নসিব করিও।আমিন।

এস আই সুজন হারেজ লিখেছেন- চায়নার অনেক গল্প শুনেছি। সে ছিল পুলিশের নিবেদিত প্রাণ। সবাই তাকে ভালবাসতো। আল্লাহ চায়নাকে জান্নাত নসিব করুন-আমিন।

সৈয়দপুর সার্কেলের সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার জিয়া রহমান জিকো লিখেছেন চায়নার সঙ্গে একদিন অনেকক্ষন কথা বলেছিলাম। ভাল মনের একজন মানুষ ছিলেন। আল্লাহ চায়নাকে কবুল করে নিন সেই দোয়া করি- আমিন।

নীলফামারী থানার ওসি বাবুল আকতার চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল তার ফেসবুকে চায়নাকে নিয়ে তার অনুভুতি প্রকাশ করে এক বিশাল স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেই স্ট্যাটাসে বলা হয়েছিল চায়না কোন দিন রাগ করে স্ত্রীকে নির্যাতন করেনি। যখন স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করতো তখন রাগ দমনে সে বাড়ি হতে বেরিয়ে যেত। রাগ কমলে বাড়ি ফিরতো। যা ছিল চায়নার নিরব হুশিয়ারী টেকনিক। চায়না মেয়ে মানুষকে ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছে। 
ওসি বাবুল আকতার সেই চায়নাকে নিয়ে ছবি সহ লিখা স্ট্যাটাসটি এখানে হুবাহু তুলে ধরা হলো- ছবির ব্যাক্তিটিকে আমরা অনেকেই চিনি। সৈয়দপুর পুলিশকে দু:সময়ে সহায়তা করে, ঝড়, বৃষ্টি, শীত সবকিছু উপেক্ষা করে ছুটে আসে ডাকা মাত্রই। ওর নাম মো: হাদীস উদ্দীন (চায়না)। ওর আর একটি পরিচয় লাশ বহনকারী। লাশের ময়না তদন্ত হলে ও খুব খুশী, না হলে ওর মন খারাপ। কারণ, ময়না তদন্তের উপর নির্ভর করে চায়নার জীবিকা।
যখন লাশের ময়না তদন্ত নাই, তখন ওর উপবাসে দিন কাটে। দেখার কেউ নাই। মদ খেয়ে ঘুড়ে বেড়ায় এদিক সেদিক। পুরা মাতাল অবস্থায় মাঝে মাঝে আসে আমার কাছে। বিশ্বাস কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। চাওয়াও কিন্তু খুব বেশী কিছু নয়, কিছু চাল আর ডাল। সাথে একটু মাংস হলেতো হাতে স্বর্গ পেল।
অফিসে এসে অনেক সময়ই চায়নার পুরা বেসামাল অবস্থায়ও আমার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আমাকে অবাক করে। প্রথমে ভেবেছিলাম কিছু পাওয়ার আশায় ওর এই ভালবাসার নাটক। কিন্তু পরে বুঝলাম আমার এই ধারণা ভুল।
চায়না যেহেতু বেশীর ভাগ সময়ই মাতাল থাকে, তাই চায়নার কাছে আমার প্রশ্ন ছিল মাতাল অবস্থায় সে তার স্ত্রীকে মারপিট করে কিনা? চায়নার উত্তর শুনে আমি শুধু অবাকই হইনি, ওর এই উত্তর অনেকের সাথে শেয়ার করেছি। আজ ফেসবুকের মাধ্যমে অনেক বড় পরিসরে শেয়ার করলাম। ওর জবাবটা কিন্তু বলি নাই। ওর জবাব ছিল, " মেয়ে মানুষ হলো ফুলের মত। ফুলে টোকা দিলে যেমন ফুলের পাপড়ি পরে যায়, তেমনি মেয়ে মানুষকে মারলে ওরা নষ্ট হয়ে যায়।" তাই চায়নার থিওরী, স্ত্রীর সাথে রাগারাগি হলে চায়না বাড়ির বহিরে চলে যায়। অনেক পরে ফিরে আসার পর স্ত্রীর জন্য হুশিয়ারী, আবার রাগারাগি করলে চলে যাবে, আর ফিরে আসবেনা। একজন অশিক্ষিত, মাতাল ব্যক্তির সংসারের চাকা গতিশীল রাখার এই টেকনিক সত্যিই অবাক করার মত।

এদিকে অনেকে চায়নার অকাল মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছেনা। তারপরেও চায়নাকে একদিন সকলে ভুলে যাবে। আর সৈয়দপুরে লাশ টানার জন্য চায়নার মতো আরেকজন চায়নার জন্ম হবে। সেও একদিন পুলিশের নিবেদিত প্রাণ হয়ে যাবে। #

পুরোনো সংবাদ

নীলফামারী 4744005829502648589

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item