পঞ্চগড়ে বিলুপ্ত ছিটমহলে স্কুল করো, টাকা কামাও প্রথায় বানিজ্য

 মো: সাইদুজ্জামান রেজা, পঞ্চগড় প্রতিনিধি-
পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোতে গত দুই মাসে ৩৪টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। একটি চক্র প্রতিটি বিদ্যালয়ে পাঁচ-ছয়জন করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। স্থানীয়রা এভাবে বিদ্যালয় তৈরিকে বলেছে, ‘স্কুল করো, টাকা কামাও’ প্রথা। স্থানীয় সূত্র জানায়, বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোর মধ্যে জনবসতি রয়েছে ১৭টিতে। ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ার পর সরকার বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে ছিটমহলের উন্নয়নের কাজ শুরু করে। শিক্ষা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নকাজ চলছে। এর অংশ হিসেবে ৩৬টি ছিটমহলে ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে পাঁচটি বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ছিটমহলগুলোতে স্কুল, মাদরাসা, কলেজসহ মোট ৩৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর মধ্যে পাঠদানের অনুমতি পেয়েছে মাত্র ছয়টি। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গড়ে ওঠা ৩৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন প্রতিষ্ঠাতারা। এর মধ্যে গত দুই মাসে হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্মারক, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের সুপারিশপত্র নতুন করে ৩৪টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়। বিলুপ্ত নাজিরগঞ্জ ও শিংগিমারী ছিটমহলে যৌথ আদমশুমারি অনুযায়ী কোনো জনসংখ্যার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অথচ এখানে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের নাম ঠিক করার ক্ষেত্রেও প্রতারকচক্র বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ ফজিলাতুন্নেছা, সজিব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, কাজী নজরুল ইসলাম, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, ভাষাসৈনিক আব্দুল জব্বার, ভাষা সৈনিক বরকত, আতাউল গনি ওসমানী, শেখ কামাল, ক্যাপ্টেন বাসার, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, তাজউদ্দীন আহমদ,শেখ রাসেলের মতো বিশিষ্টজনদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। বিদ্যালয়গুলোর নামফলকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্মারক নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। রাতারাতি বিদ্যালয় গুলো গড়ে ওঠায় স্থানীয়রাও বিস্মিত। কোনো নিয়োগ কমিটি নেই। নেই বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী। রাস্তাঘাটে টাকা নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের নেতারা জানান, দুই মাস আগে নীলফামারীর জনাব আলী, জাহাঙ্গীর আলম ও পঞ্চগড়ের রেজাউল ইসলাম ছিটমহল গুলোতে আসেন। তাঁরা প্রচার করেন জমি ও টাকা দিলেই প্রাথমিক বিদ্যালয় করে দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্মারক, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সুপারিশপত্র দেখান। তাঁরা ঘোষণা দেন, বিদ্যালয় গুলো শিগগিরই সরকারীকরণ হবে। তাঁদের কথা শুনে স্কুলের নামে ৩০ শতাংশ করে জমি দেন অনেকে। জমি দেওয়ার বিনিময়ে বিনা পয়সায় ওই পরিবারের কারো চাকরিও জোটে কল্পিত বিদ্যালয়ে। এরপর প্রতারকচক্র কয়েক দিনের মধ্যে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা করে নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়। বিদ্যালয় গুলোতে টিনশেড ভবন নির্মাণও করে। তবে কোনো বিদ্যালয়েই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দেখা মেলেনি। এসব বিদ্যালয় গড়ে ওঠার ব্যাপারে স্থানীয়রাও খুব বেশি জানে না। ছিটমহল গুলো বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই। কিন্তু সদ্যঃ প্রতিষ্ঠিত এসব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দেখানো হয়েছে ২০০৮ সালে। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সুপারিশপত্র (ডিও লেটার) থেকে জানা যায়, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত বিভিন্ন ছিটমহলে ১১টি এবং লালমনিরহাটে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে তৃতীয় ধাপে জাতীয়করণের প্রস্তাব করেছেন। সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩৩৭-এর সংসদ সদস্য ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য হোসনে আরা বেগম ১১টি, ৩১২ আসনের মহিলা সংসদ সদস্য বেগম রিফাত আমিন ১০টি, ৩১৫ নম্বর আসনের মহিলা সংসদ সদস্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মমতাজ বেগম ১৩টি বিদ্যালয়কে তৃতীয় ধাপে জাতীয়করণের সুপারিশ করেছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, বোদা উপজেলার বিলুপ্ত নাজিরগঞ্জ ছিটমহলের ডানাকাটার হায়াত আলীর ছেলে সোহেল রানা, পঞ্চগড় সদর উপজেলার ব্যারিস্টারপাড়ার রেজাউল করিম, নীলফামারীর জনাব আলী, জাহাঙ্গীর মাস্টারসহ একটি চক্র এসব স্কুল প্রতিষ্ঠার নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অভিযুক্ত সোহেল রানা বলেন, ‘আমি শুধু ঘর তুলে দিয়েছি। সব ব্যাপার জানেন পঞ্চগড়ের রেজাউল ভাই।’ রেজাউল করিম বলেন, ‘এই কাজ সরাসরি তথ্যমন্ত্রী করে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে ভালো জানেন নীলফামারীর জনাব আলী।’ কিন্তু জনাব আলী ও জাহাঙ্গীর মাস্টারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তাঁরা রিসিভ করেননি। বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা কালিয়াগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল হালিম বলেন, ‘একটি চক্র রাতের অন্ধকারে এসব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে। চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে সাত-আট লাখ টাকা নিচ্ছে। আট লাখ টাকার বিনিময়ে আমার ছেলেকে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হারুনর রশিদ বলেন, ‘কিছু অতি উৎসাহী লোকজন রাতের অন্ধকারে এসব বিদ্যালয় গড়ে তুলেছে। সরকার এগুলো কখনোই সরকারি করবে না। বিলুপ্ত ছিটমহলে সরকার এরই মধ্যে ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি বিদ্যালয়ের কাজ শেষ হয়েছে।’
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি চক্র বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তদন্ত করছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পুরোনো সংবাদ

পঞ্চগড় 4928465144766344787

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item