মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ শিশু শঙ্কু এবং..............

মামুনুর রশীদ মেরাজুল রংপুর ব্যুরো।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ শঙ্কু সমাজদার। যার রক্তে রক্তাক্ত হয়েছিলো রংপুরের মাটি। দাউ দাউ করে জ¦লে উঠেছিলো বিদ্রোহের আগুন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো মুক্তির সংগ্রাম আর স্লোগানে। 
একাত্তরের ৩ মার্চ পূর্ব ঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়ায় কথা থাকলেও হঠাৎ করেই কোন কারণ ছাড়া পাকিস্তানী শাসক প্রধান ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। এই হঠকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় ৭০’র নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া আওয়ামী লীগসহ সারা বাংলার মানুষ। ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। ৩ মার্চ কারফিউ ভেঙ্গে রংপুরেও হরতাল পালিত হয়। সেই অসহযোগ আন্দোলনে বিক্ষোভ মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন শঙ্কু সমাজদার। ১২ বছর বয়সী এই শহীদের নাম গেজেটভুক্ত হলেও সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না তার পরিবার।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, পাকিস্তানি দখলদারদের শোষণ-শাসন এবং ষড়যন্ত্রের খপ্পর থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধুর আহবানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল রংপুরের মানুষ। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ যুবক, ছাত্র, কৃষক, দিন মজুর, নারী পুরুষসহ সর্বস্তরের জনতা কারফিউ ভাঙ্গার জন্য রংপুর শহরের কাচারি বাজারে সমবেত হয়েছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম গোলাপ, অলক সরকার, মুকুল মুস্তাফিজ, নূর উর রসুল চৌধুরী, হারেস উদ্দিন সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, মুসলিম উদ্দিন (মুসলিম কমিশনার), আবুল মনসুর আহমেদসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে মিছিল বের হয়।
ওই দিন সকাল নয়টায় ষষ্ঠ শ্রেণী পড়–য়া কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র শঙ্কু সমাজদার তার বড় ভাই কুমারেশ সমাজদার এর হাত ধরে গুপ্তপাড়ার বাসা থেকে বেড়িয়ে ছিলেন মিছিলে অংশগ্রহনের জন্য।  বিভিন্ন এলাকা থেকে কারফিঊ ভাঙতে শত শত ছাত্র-নেতাদের সাথে মিশে গিয়েছিলো আমজনতা। যেন অবিচ্ছিন্ন ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ভারী হয়ে উঠে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার স্লোগান মুখরিত বিক্ষোভ মিছিল।
হাজারো মুক্তিকামী সাহসী বাঙালি সেই মিছিলে উচ্চারিত হতে থাকে- ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব-শেখ মুজিব। ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
মিছিলটি শহরের তেঁতুলতলা (বর্তমান শাপলা চত্ত্বর) এলাকায় আসতেই কলেজ রোড থেকে কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি শহীদ মুখতার ইলাহি, জিয়াউল হক সেবুসহ অন্যান্যদের নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল এসে যোগ হয় মূল মিছিলের সাথে। কথা ছিল মূল মিছিল তেঁতুলতলা থেকে ফিরে যাবে। কিন্তু কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের চাপে নেতৃবৃন্দ মিছিলটি আলমনগর স্টেশনের অবাঙালি বিহারি ক্যাম্পের দিকে এগুতে থাকে। মিছিলটি আলমনগর এলাকার অবাঙ্গালী ব্যবসায়ী সরফরাজ খানের বাসার সামনে যেতেই এক কিশোর ঐ বাসার দেয়ালে একটি উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড দেখে তা নামিয়ে ফেলতে যান ছুটে যায়। আর তখনই বাসার ছাদ থেকে মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন ভাইয়ের হাত ধরে মিছিলে আসা স্কুল ছাত্র কিশোর শঙ্কু সমজদার। গুলির বিকট শব্দে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়া গুলিবিদ্ধ কিশোর শঙ্কুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের দিকে। কিন্তু ততোক্ষণে ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে। পথেই কিশোর শঙ্কু মারা গেছেন।
এদিকে শঙ্কুর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ক্ষোভের আগুনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পুরো রংপুর। গুলিবিদ্ধ কিশোর শঙ্কুর রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে জনতা উত্তেজিত হয়ে সারা শহরে অবাঙ্গালীদের দোকান ভাংচুর, সামগ্রী রাস্তায় এনে অগ্নি সংযোগ করতে থাকে। যে বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছিল সেই বাড়িতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা কালে ইপিআর বাহিনী এসে বাঁধা দান করে।
ওই দিনে আরও দুইজন নিহত হয়েছেন অবাঙ্গালীদের হাতে। তাঁদের একজনের নাম আবুল কালাম আজাদ। যাকে গিনি এক্সচেঞ্জের (বাটার গলির পাশের মূল সড়কের সাথেই, বর্তমান রেইনবো প্লাজা) সামনে এক অবাঙ্গালী গুলি করে হত্যা করে। অপরজন ওমর আলী। বাসা শহরের মুলাটোলে। তিনি ছোড়ার আঘাতে মারা যান জেনারেল বুট হাউসের (ঢাকা হোটেলের গলির পাশে, টাইম হাউস, ক্রোকারিজ মার্কেটের বিপরীতে) সামনে। এছাড়াও সেদিন আরও দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
৩ মার্চের রক্তাক্ত রংপুর কাঁদিছেন স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাই তো তিনি ঘটনার তিন দিন পর রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতায় কিশোর শঙ্কুর আত্মদানের কথা উল্লেখ করে রংপুরের কথা বলেন।
সেই কিশোর শঙ্কুর আতœত্যাগের পথ ধরে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য ত্রিশ লক্ষ প্রাণ শহীদ হয়েছেন। সম্ভ্রম হারিয়েছে অসংখ্য মা-বোন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। দেখতে দেখতে কিশোর শঙ্কু সমাজদারকে ছাড়াই কেটে গেছে অসুস্থ মা দীপালি সমাজদারের আট চল্লিশটি বছর। শুধু ৩ মার্চ এলেই সন্তান হারা সেই অসহায় মায়ের কথা মনে পড়ে কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু কেমন আছেন তিনি, কেমন কাটছে তার দিনকাল-সেই খবরাখবর যেন কেউ রাখে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর শহরের কামাল কাছনায় জীর্ণশীর্ণ বাড়িতে বাস করছেন কিশোর শঙ্কুর মা শত বছর বয়সী দ্বীপালি সমজদার। অনাহারে-অর্ধাহারে তার দিন কাটছে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় শঙ্কুর নাম গেজেটভুক্ত হলেও ঠিক মতো সম্মানি ভাতা পাচ্ছেন না শঙ্কুর পরিবার।
অসুস্থ মা দীপালি সমাজদার বলেন, তিনি এখনও শঙ্কুকে স্মরণ করে এবং তার ছোট ছেলের বীরত্ব ও সাহসীকতার জন্য গর্ববোধ করেন।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ কিশোর শঙ্কুর প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে শঙ্কু স্মৃতি পরিষদসহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন আজ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে শঙ্কুর  প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর সাথে স্মরণ করছেন। ##


পুরোনো সংবাদ

রংপুর 3188603251466629985

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item