রিকশাচালক থেকে সামাদ মহাজন

আব্দুল আউয়াল ঠাকুরগাঁও প্র‌তিনি‌ধি:
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে একটু দূরে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা সালন্দর ইউনিয়নের ইব্রাহীম আলী ও অলেখা বেগমের আদরের সন্তান সামাদ। 

দারিদ্র্যের মাঝে থাকলেও বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিলো ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। তবে দারিদ্র্যতাকে ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত বাবা মায়ের এই স্বপ্ন সার্থক হবার সব ব্যবস্থা প্রায় নিশ্চিত।

ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি অনেক বেশি আগ্রহ ছিলো সামাদের। তবে মায়ের আগ্রহে সেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় আরো কয়েকগুণ। অল্প অল্প করে কচি হৃদয়ে বাড়তে থাকে উচ্চশিক্ষিত হবার প্রবল ইচ্ছে। তবে দারিদ্র্যতার কোপানলে জর্জরিত হওয়া পরিবারে জন্ম নিয়ে কিভাবে পূরণ হবে এই স্বপ্ন?- এই শঙ্কা প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াতো সামাদের তনু মনে। 
এক পর্যায়ে বৃদ্ধ বাবা অসহায় হয়ে ক্ষুদে সামাদের ওপরেই তুলে দিলেন সংসারের গুরুদায়িত্ব। নিজের অমত থাকা সত্ত্বেও সত্তোরোর্ধ বাবার অক্ষমতার কথা বিবেচনা করে সামাদ তুলে নিলো রিকশার হ্যান্ডেল, শুরু হলো রিক্সাচালক সামাদের নতুন সংগ্রাম।

তবে এতোকিছুর পরেও নিজের পড়ালেখার বিষয়ে এতোটুকু ঘাটতি রাখেনি ক্ষুদে এই যোদ্ধা। 
সারাদিন স্কুল করে বাসায় যখন সবাই ঘরে ফিরে আসতো তখন সামাদকে বের হতে হতো রিকশা নিয়ে জীবিকার তাগিদে।

এ গলি ও গলিতে রিকশা চালিয়ে চলতে থাকে তার দিন। এমনই একদিন সামাদের রিকশায় যাত্রী হয়ে উঠলেন গণমাধ্যম প্রতিনিধি নুর ই আলম সিদ্দিকী। একটি ছোট্ট শিশুকে রিকশা চালাতে দেখে তার মনে প্রশ্ন জাগলো ভেতরের গল্পটুকু জানার। সেই আকাঙ্খা থেকেই সামাদের সাথে আলাপচারিতায় ফুটে উঠলো ভেতরের গল্প। এই মর্মস্পর্শী কাহিনী তিনি তুলে ধরলেন সকলের মাঝে। ঘটনাটি নজর এড়ালো না ঠাকুরগাঁও জেলার সম্মানিত পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদের।

বিষয়টি নিয়ে কিছু করার জন্য তিনি তৎক্ষণাৎ তার সহকর্মীদের সাথে বৈঠক করেন এবং প্রশাসনের সকলেই এ নিয়ে কিছু করার জন্য সহমত প্রকাশ করে। 

পরদিন সকালেই তিনি সামাদকে ডেকে পাঠান এবং তার অসহায়ত্বের গল্প শুনে তিনি নিজেই সামাদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নেন। সেই সাথে ঘোষণা দেন, কোনমতেই সামাদ আর রিকশা চালাবে না, সে শুধুই লেখাপড়া করবে। এছাড়াও সামাদের রিকশার সকল প্রকার দায় শোধ করারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

পুলিশ সুপারের এসব পদক্ষেপ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো এগিয়ে আসেন সমাজের অনেকেই। শুরু হয় এক নতুন গল্প। স্কুলের প্রধান শিক্ষক, স্থানীয় চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে অনেক বিত্তশালীরাও এগিয়ে আসেন সামাদকে সহযোগিতা করার জন্য। বদলে যায় এক শিশুশ্রমিকের ভাগ্যের চাকা, রচিত হয় নতুন একটি ইতিহাসের।

বুধবার (৩০ আগস্ট) সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের দেয়া কথা রেখেছেন পুলিশ সুপার; সামাদের হাতে তুলে দিয়েছেন রিকশার চাবি। তবে একটি রিকশা নয় আরেকটি ইজিবাইকও সামাদকে কিনে দেন তিনি। 

শিশু সামাদ এখন এই রিকশা এবং ইজিবাইকের একক সত্ত্বাধিকারী। পুলিশ সুপার নিজেই সামাদের পরিবহণের নামকরণ করে দেন; নাম দেন 'সামাদ মহাজন'। 

এ সময়ে একটি উৎসবমুখর এবং আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। উক্ত মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ এবং গণমাধ্যমকর্মীরা ছাড়াও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ।

এসময়ে পুলিশ সুপার সামাদ মহাজনের পরিবহণের সাথে সকলকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তিনি নিজেও সামাদের সাথে তার ইজিবাইকে উঠে খোশগল্পে মেতে উঠেন।

পরবর্তীতে গণমাধ্যমের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে পুলিশ সুপার এহেন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, "এই দায়বদ্ধতা সমাজের সকলের। সবাই যদি নিজ নিজ স্থান থেকে এরকমভাবে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে একটি আদর্শ এবং প্রগতিশীল সমাজ উপহার দেয়া সম্ভব।" পরবর্তীতে এমন কর্মকাণ্ডে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ।

এরপরে হাসিমুখে সবার কাছে বিদায় নিয়ে নিজ বাহনে চেপে মালিকের বেশে বাড়ির পথে রওয়ানা হয় সামাদ মহাজন।

এক সপ্তাহ; মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানেই বদলে গেলো এই ক্ষুদে শিশুশ্রমিকের জীবনের গল্প। সেই সাথে জয় হলো মানবতার, দায়বদ্ধতা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেলো আমাদের সমাজ।


আব্দুল আউয়াল

পুরোনো সংবাদ

নিবিড়-অবলোকন 684657179557946964

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item