পীরগঞ্জে ক্লাবের নামে দাদন ব্যবসা।অত্যাচারে অতিষ্ঠ ঋণীরা আতংকে,বাড়ী ছাড়া অনেকে
https://www.obolokon24.com/2017/06/rangpur_86.html
গোপনে জুন ক্লোজিংয়ের প্রস্তুতি!
রংপুরের পীরগঞ্জের ভেন্ডাবাড়ী হাটের বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী ক্লাবের দেয়া চড়া সুদের প্রায় ৭ কোটি টাকা আদায়ে গোপনে জুন ক্লোজিংয়ের প্রস্তুতি চলছে। কারণ সম্প্রতি এক ঋনগ্রস্থ ব্যক্তিকে মডেল ক্লাবের সদস্যরা অপহরন করার ঘটনায় ৪ ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর ক্লাবগুলোর অনেক সদস্য গা ঢাকা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই ক্লাবগুলোর সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলা হয়েছে, সরিয়ে ফেলা হয়েছে কয়েক বস্তা ফাঁকা ষ্ট্যাম্প আর চেক বহি। অপরদিকে টাকা পরিশোধের নির্দেশ পেয়ে ঋণীরা চরম আতংকে রয়েছে।
জানা গেছে, পীরগঞ্জের ভেন্ডাবাড়ীহাটে প্রায় ৩ যুগ ধরে ব্যক্তিগতভাবে এবং কথিত ক্লাবের মাধ্যমে দাদন ব্যবসায়ীরা ফাঁকা ষ্ট্যাম্প ও চেক বহিতে স্বাক্ষর নিয়ে চাকরীজীবি, ব্যবসায়ী ও সাধারন মানুষের মাঝে মাসে শতকরা ১০ টাকা হারে সুদে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আসছে। প্রতিমাসের ঋণ এবং সুদের কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলেই ক্লাবের সদস্যরা মোটর সাইকেলে দলবেঁধে ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির বাড়ীতে গিয়ে চড়াও হয়। ঋণের সুদ দিতে ব্যর্থ হলে অনেককে বেঁধে মারধর, ক্লাবে এনেও নির্যাতন করা হয়েছে। পাশাপাশি ঋণ ও সুদের টাকা আদায়ে দাদন ব্যবসায়ীরা অনেক সময় গরু, ঘরের আসবাবপত্র, মোটর সাইকেলও নিয়ে আসে। এমনকি দাদন ব্যবসায়ীরা অনেক ঋণী ব্যক্তির বসতবাড়ী, ভিটে মাটিও বিক্রি করিয়েছে কিংবা তাদের নামে করে নিয়ে অনেককে নিঃস্ব করেছে। তাদের নির্যাতনে অনেকে এলাকা ছাড়াও হয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে এলাকায় একাধিক শালিস বৈঠকও বসেছে।সুত্রে জানা গেছে, উপজেলার ব্যবসায় প্রসিদ্ধ এলাকা ভেন্ডাবাড়ীহাটের মধ্যে ডায়মন্ড ক্লাব, মডেল ক্লাব, মুনষ্টার ক্লাব, গোল্ডেন ক্লাবসহ বেশ কয়েকটি নিবন্ধনবিহীন ক্লাব সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেদারছে সুদের ব্যবসা করে আসছে। সুদের টাকা আদায়ে রয়েছে বিশাল বাহিনী এবং অফিসিয়ালভাবে কর্মচারীও নিয়োগ আছে। ক্লাবগুলোর নির্দিষ্ট ছাপানো ফরমের মাধ্যমে টাকা আদান-প্রদান করা হয়ে থাকে। চড়াসুদে ব্যবসা করে অনেককে সর্বশান্ত করে ক্লাবগুলোর অনেক সদস্য ভুমিহীন থেকে কোটিপতি বনে গেছে। অনেকে গ্রামের মধ্যেই আধুনিক মডেলের দৃষ্টিনন্দন বাড়ী করেছে। এরমধ্যে ভেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের মাইকড় গ্রামেই বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী দাদন ব্যবসায়ী রয়েছে। মুনষ্টার ক্লাবের সাধারন সম্পাদক ভেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের মাইকড় গ্রামের কাজল মিয়া। তিনি খুচরা কাঁচামাল বিক্রেতা থেকে দাদন ব্যবসার করে এখন কোটিপতি। গ্রামে তার ”অন্তর ভিলা” নামে দৃষ্টিনন্দন বাড়ী রয়েছে। মুনষ্টার ক্লাবের সভাপতি আহসান হাবিবও বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেছে। ডায়মন্ড ক্লাবের সভাপতি উজ্জল মিয়া ও সম্পাদক ফুল মিয়া দু’জনই মাইকড় গ্রামের। মাইকড় গ্রামের শরিফুল ইসলাম ডায়মন্ড ক্লাবে ক্যাশিয়ারের চাকরী করার একপর্যায়ে নিজেও দাদন ব্যবসায় গড়ে তোলেন। এখন তিনি লাখ লাখ টাকার মালিক বনে গেছেন। ভেন্ডাবাড়ী হাট সংলগ্ন পশ্চিমে মৃত. কাশিরাম বর্মনের দু’ছেলে শ্রী বাচ্চু বর্মন ও স্বাধীন বর্মন প্রায় কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। তাদের টাকাও ক্যাশিয়ার নিয়োগ করে উত্তোলন করা হচ্ছে। অনন্তরামপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রী মধু চন্দ্র এলাকায় প্রভাবশালী দাদন ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে ঋণী ব্যক্তি অপহরন মামলা রয়েছে। দাদন ব্যবসায়ীদের আর্থিক সচ্ছলতায় এলাকাবাসীর চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দাদন ব্যবসায়ী কাজল মিয়া জানান, এই ব্যবসা (সুদ) এখন ছেড়ে দিতে হবে। মানুষের উপকার করতে গিয়ে যদি বিপদ হয়, সে ব্যবসা তো করা যাবে না। আমরা এখন টাকাগুলো উত্তোলন করবো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দাদন ব্যবসায়ী বলেন, ক্লাবগুলোর প্রায় ৭ কোটি টাকা মাঠে ঋণ দেয়া আছে। আমরা জুনের মধ্যেই টাকা তুলে নেব।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার রামচন্দ্রপুরের গরু ব্যবসায়ী বাদল মিয়া ‘মডেল ক্লাব’ থেকে ৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ঋন নিয়ে সুদে-আসলে (জমিসহ) ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। মডেল ক্লাবের সম্পাদক কুমেদপুর ইউপি’র সাবেক ইউপি সদস্য ভুজুবাড়ী গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক মিয়া ৬২ শতক জমি নিজের নামে লিখে নিয়েছে। মডেল ক্লাব কর্তৃপক্ষ আরও ১০ লাখ টাকার জন্য ভাড়াটে অপহরনকারী দিয়ে গত ১৬ মে রাতে ব্যবসায়ী বাদলকে অপহরন করে। ওই ঘটনায় মামলার পর পুলিশ অপহৃতকে উদ্ধার এবং হাতেনাতে ৪ অপহরনকারীকে গ্রেফতার করে। ওই মামলার ঘটনায় পুলিশী ঝুটঝামেলা এড়াতে ডায়মন্ড ক্লাবসহ অন্যান্য ক্লাব থেকে রাতের আঁধারে বস্তাভর্তি ফাঁকা ষ্ট্যাম্প ও চেক বহি সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেছে।
হাজীপুরের আব্দুল লতিফ মিয়া মডেল ক্লাব থেকে ৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ২০ হাজার পরিশোধের পরও তার কাছে আরও টাকা দাবী করা হয়। আব্দুল লতিফ এতে ব্যর্থ হলে মডেল ক্লাবের সম্পাদক সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক মিয়া তার একটি গরু ধরে ভুজুবাড়ী গ্রামে নিয়ে যায়। আপোষরফা বৈঠকের ৭ দিন পর ১২ হাজার টাকার নিয়ে গরুটি ফেরত দেয়।
অপরদিকে বিদেশী বাবলু ও শাহাদাত হোসেন নামের দু’দাদন ব্যবসায়ীর কাছে ভেন্ডাবাড়ীর শ্রী কার্তিক চন্দ্র চড়া সুদে ঋণ নেয়ার পর সুদাসল পরিশোধ করতে গিয়ে কার্তিক তার ১৭ বিঘা জমি বিক্রি করে এখন পথে বসেছে। ওই সুদের টাকার স্বাক্ষী মহেশপুরের মিজানুর রহমানকেও ঘরে আটকে রেখে টাকা আদায় করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মিজানুর জানায়, সুদখোররা আমাকে ঘরে বেঁধে মারধর করেছে। ডায়মন্ড ক্লাবের ঋণের দায় মেটাতে চৈত্রকোল ইউনিয়নের দানিশনগর গ্রামের মৃত. ওসমান গনীর ছেলে শফিকুল ইসলাম তার ভিটেমাটি বিক্রি করে পরিবারের ৬ সদস্য নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঋণীরা জানান, ক্লা থেকে ৩০ জুনের মধ্যেই টাকা পরিশোধের জন্য নির্দেশ দিয়েছে। না দিলে আমাদের বাড়ীতে এসে কিংবা রাস্তাঘাট থেকে ধরে নিয়ে যাবে। আমরা আসলের ৩/৪ গুন টাকা পরিশোধ করেছি। আর সুদ দিতে পারছি না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভেন্ডাবাড়ী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এক র্কর্মকর্তা বলেন, ভেন্ডাবাড়ীহাটে বেশকিছু ক্লাব চড়াসুদে টাকা বিনিয়োগ করছে। পাশাপাশি কিছু অর্থশালী ব্যক্তিও পর্দার অন্তরালে থেকে সুদে টাকা খাটাচ্ছে। গত মে মাসে বাদল মিয়া নামে এক ঋণী ব্যক্তিকে অপহরনের পর অনেক ক্লাব তাদের সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলেছে। অফিসও বন্ধ করেছে। এমনকি দেয়ালে লেখা দাদন ব্যবসায়ীদের মোবাইল নম্বরগুলোও ঘষে মুছে তুলে ফেলেছে। তবে শুনছি, ক্লাবগুলো গোপনে টাকা আদায়ে হালখাতা বা জুন ক্লোজিংয়ের প্রস্তুতি নিয়েছে। পীরগঞ্জ থানার ওসি রেজাউল করিম বলেন, ভেন্ডাবাড়ীতে সুদের রমরমা ব্যবসার খবর জেনেছি। ওই এলাকায় দাদন ব্যবসায়ীদের নামে অপহরনের মামলার অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখছি, অপহরনের সাথে কার কার সম্পৃক্ততা রয়েছে।