সমস্যা চিনলে সমাধান অসম্ভব না

গত ২৭শে এপ্রিল চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় জঙ্গি আস্তানা থেকে এক নারী ও শিশুকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উদ্ধারকৃত নারী বাড়িটিতে থাকা জঙ্গি সংগঠন পুরোনো জেএমবির সদস্য আবুর স্ত্রী এবং শিশুটি এই দম্পতির সন্তান বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। আবুর স্ত্রী ও সন্তানকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার টিএম মোজাহিদুল ইসলাম। এ আস্তানায় অভিযান চলার সময় বিকেল পাঁচটার দিকে ওই নারী এবং এর আধাঘন্টা পর শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। (তথ্যসূত্র :দৈনিক প্রথম আলো )
গত বছর গুলশানের হলি আর্টিজেন রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার ঘটনা বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি জায়গায় র্যা ব ও পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টায় জঙ্গি দের বিরুদ্ধে সফল অভিযান সম্পন্ন হয়েছে। সরকারের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকজন জঙ্গি নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আতœসমর্পণ করেছে। তারপরও জঙ্গিবাদের ঘটনা নিয়মিত বিরতিতে বাংলার মাটিতে ঘটেই চলেছে। এর রাশ টানবে কে ? জঙ্গিরা আদতে একই সংগঠনের একই জালের একেকটা গিট্রু। একজনের মৃত্যুতে জালের একটা গ্রন্থি ছিড়ল বটে। তবে অন্যকেউ শিঘ্রই সেই ছেড়া সুতাটায় জোড়া লেগে জালের অংশ হবে। এভাবে জালটা দিনের পরদিন, বছরের পর বছর অটুট থাকে।জঙ্গি নিহত হয়কিন্তু জাল থেকে যায়।দলীয় বন্ধনে বাধা এই জাল ছিন্ন করে সাধ্য কার ?
পহেলা জুলাইয়ের গুলশান ট্রাজেডির পর পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান থেকে সরকারের উচু পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্রই জঙ্গি বিষয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে জঙ্গিবাদ এখন একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। এর আর এখন শুদ্ধ দেশজ চরিত্র নেই। প্রথমে সরকার জনগণের কোন ধরণের যুক্তির ও উদ্বেগের সরাসরি উত্তর না দিয়ে বারবার শুধু খেলো কথা বলে দায় সারার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাংলার আপামর জনগণ যখন জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধ করার জন্য বিপুল জনমত তৈরি করেছে তখন সরকার বুঝতে পেরেছে যে,  ইস্কাপনকে ইস্কাপনই বলতে হবে। রুইতন, হরতন বলে সমস্যা এড়িয়ে গেলে ক্ষতি হবে সবারই। এখন সরকার ও জনগণ একযোগে বলছে সংস্কৃতিই পারবে জঙ্গিবাদকে ঠেকাতে। এক্ষেত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে কিছু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে মন্ত্রণালয় শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে চলচিত্র প্রদর্শনী এবং শিক্ষা সপ্তাহ পালন করেছে। কিন্তু এভাবে কি জঙ্গিবাদকে ঠেকান যাবে ?
শুধু জঙ্গিবাদ কেন একটি সমাজ তথা দেশের ক্ষতি করতে পারে এমন সবকিছুই দূর করার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহন করার কথা ছিল তা স্বাধীনতা পরবর্তী কোন সরকারই আমলে নেয়নি। নিলে হয়ত আজকে আমাদের এমন ভয়ানক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হত না। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চাকে যুক্ত করার কথা আমাদের দেশের খ্যাতিমান মানুষেরা বহুদিন থেকে বলে আসছেন। কিন্তু কোন সরকারই সেসব কথায় কান দেয়নি। সঙ্গীত, চিত্রপ্রদশর্নী, নাটক ও চলচিত্র যে শক্তিশালী গণমাধ্যম এবং এর মাধ্যমে খুব সহজেই প্রয়োজনীয় ম্যাসেজ নিয়ে সমাজে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব, শহুরে-গ্রামিণ সকল ধরণের মানুষের দোর গোড়ায় পৌছান যায় তা আমাদের দেশের কোন সরকারই বোঝেনি অথবা বোঝার চেষ্টা করেনি। একেবারে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে যদি সঙ্গীত, নৃত্য, আর্ট, অভিনয়, লেখালেখি, কবিতাআবৃত্তি, গল্পবলা, নাটক ইত্যাদিকে যুক্ত করা যেত তবে শিশুকালের জীবনাচরণের প্রতিফলন কর্মজীবনে দেখা যেত। সংস্কৃতি চর্চার স্থান যে শুধু শিল্পকলা তা নয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি পরিবার ও সংস্কৃতি চর্চার আদর্শ স্থান হতে পারে।একটি শিশু বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ, ব্যারিস্টার, বিসিএস ক্যাডার, ভার্সিটির টিচার, ব্যাংকার, আর্মি ও পুলিশ অফিসার যাই হোক না কেন যদি ছোটবেলা থেকেই তার মনের মধ্যে সংস্কৃতির বিজ বপন করে দেয়া যায় তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, পরিণত বয়সে সে জঙ্গিবাদ তো দূরের কথা অনেক ছোট অপরাধ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। সমাজ-সংসার ও দেশ তার কাছ থেকে শুধু ভাল কিছুই পাবে। সংস্কৃতির সতেজ হাওয়া আমাদের ঘুণে ধরা সমাজে প্রচন্ড গতিবেগ এনে দিতে পারে এবং উপজাত হিসেবে জঙ্গিবাদের বিষ আমাদের দেশ থেকে উধাও হয়ে যেতে পারে।
প্রমথ চৌধুরি বলেছিলেন স্বশিক্ষিত লোক মাত্রই সুশিক্ষিত। কিন্তু আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বশিক্ষিত হওয়া একেবারেই অসম্ভব। কারণ আমরা ভুলে গেছি অর্থেপূর্ণ জীবন আর অর্থপূর্ণ জীবন এক নয়। অর্থপূর্ণ জীবনের চেয়ে অর্থপূর্ণ জীবনের প্রতি আমাদের ঝোক অনেক বেশী। এই ঝোক সীমা-পরিসীমা মেনে চলে না। আর তাইতো রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের সেই তপোধন শিক্ষার প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশ্বভারতি এখন কোন আকাঙ্খিত বিশ্ববিদ্যালয় নয়। শিক্ষার সাথে শিল্পের যোগসূত্র স্থাপিত না হওয়ায় ছাত্ররা শুধু পরীক্ষায় বেশী নাম্বার পাওয়ার দিকে মুখিয়ে থাকে।তাই আমাদের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ আর কেউ শিক্ষার্থী নেই, শিশু থেকে তরুণ সবাই মূলত আজ পরিক্ষার্থী। শুধু পরীক্ষায় ভাল নাম্বার পাওয়ার প্রতি জীবন বাজি রাখতে গিয়ে তারা শিল্প ও সাহিত্যের ছোয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে নিজের দেশ, নিজের শেকড়, নিজের সংস্কৃতিকে আকড়ে ধরে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার বদলে তারা হচ্ছে শুধুই ক্যারিয়ারমুখী।
প্রথমদিকে চিন্তা করা হয়েছিল যে, মাদ্রাসায় পড়ুয়া দরিদ্র পরিবারের ছেলেরা বড় হয়ে জঙ্গিবাদের সাথে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু গত বছরের জুলাইয়ের গুলশান ট্রাজেডি আমাদের চোখের উপরের কাল পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। অবাক বিষ্ময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সোনার চামুচ মুখে দিয়ে যেসব ছেলে জন্মগ্রহন করে, বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা লেখাপড়া করে তারাই কিনা জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত। সমাজবিজ্ঞানীরা এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছেন ধনী পরিবারের ছেলেরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় না পেয়ে পিংপং বলের মত এখানে সেখানে ছুটে বেড়ায়। পিংপং বল যেমন উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটে বেড়ায় তেননি এই ছেলেগুলোও জীবনবোধ তৈরি না হওয়ায় এক সময় জীবন ও জগতের প্রকৃত মজা নিতে ব্যর্থ হয়ে জঙ্গী হয়ে পড়ে।সমাজ বিজ্ঞানীরা ঔদার্ত আহবান জানিয়েছেন সমাজের ধনী বাবা-মায়েরা যাতে তাদের ছেলেদের যথেষ্ঠ পরিমানে সময় দেন এবং তাদের শিল্প ও সাহিত্য অনুরাগী করে গড়ে তুলেন। দামি ব্রান্ডের আলমারিতে শুধু বিখ্যাত লেখকদের বই সাজিয়ে রাখলে হবেনা, ছেলে বইগুলো পড়ছে কিনা সে বিষয়টাও নিশ্চিত হতে হবে।
ধর্মীয় উগ্রপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হওয়াকে বলা হয় যার্ডিকেলাইজেশন। এটি কোনভাবেই আমাদের কাম্য নয়। জঙ্গিবাদের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের বিন্দু মাত্র সহানুভূতি আছে ইশারা-ইঙ্গিতেও এ কথা কেউ বলছেন না। আর চরম বিভক্তির এদেশে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমাদের শক্ত হাতে এর মোকাবিলা করতে হবে।অনলাইনে, পুরো ইন্টারনেট ভুবনে প্রচার করতে হবে ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিপরীত ন্যারেটিভ।
সরকারকে বিনীত নিবেদন জানাই, সমস্যা আছে যখন তখন গোড়ায় হাত দিন না। শুধু দিবস আর সপ্তাহ পালন করে সবকিছু সামাল দেয়া যায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। আর জঙ্গিবাদের প্রতিরোধ হিসেবে স্কুলে সাংস্কৃতিক চর্চার পরিসরকে বড় করতে হবে। কারণ এর লাভ এত বেশী যে তা সব উদ্বেগ আড়াল করে দেবে। জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবায় আজ পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা তা কখনই চাই না।

লেখক-
কামাল পারভেজ (পাভেল)
উন্নয়নকর্মী

পুরোনো সংবাদ

মুক্তমত 1683502446191168242

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item