গুটিবাজদের কারখানা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

রিফাত রাজ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বিশ্ববিদ্যালয়। পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এটি অবস্থিত। ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করে নিরলসভাবে মেধার সাক্ষর রেখে যাচ্ছে স্বনামধন্য এ বিদ্যাপীঠটি। পাঠশালা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিনত হওয়া দেশের একমাত্র বিদ্যাপিঠ এটি। ১৮৫৮ সালে ব্রজসুন্দরমিত্র, অনাথবন্ধু মৌলিক, পার্বতী চরণ রায় ও দীননাথ সেনের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে ব্রাহ্ম স্কুলটি কালস্রোতে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। সময়ের হাত ধরে অনেকের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। বুড়িগঙ্গার বহমান স্রোতের সঙ্গে শিক্ষার্থীদেরকে গড়ে তুলেছে আলোকিত করে। সেসব শিক্ষার্থীরা আলোকিত হয়ে দেশ ও জাতিকে করেছেন আলোকিত।
এতে পড়ালেখা করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, কবি ও কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র, কাজী মোতাহের হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, নুরুল মোমেন, শিক্ষাবিদ ও গবেষক আনিসুজ্জামান, শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা, ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমকারী সাঁতারু ব্রজেন দাসের মত হাজারও গুণীজন কিন্তু সেই গুনীজন গড়ার কারখানার ইতিহাস ঐতিহ্য এখন ভেস্তে যেতে বসেছে।
জগন্নাথের সেসব গুণী শিক্ষার্থীরা হলেন, ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ, কথা শিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। এ ছাড়াও প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বিশারদ এবং শিক্ষাবিদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ, চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, লেখক ও সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, অভিনেতা জাহিদ হাসান, মীর সাব্বির, প্রবীর মিত্র, ফারুক, নায়িকা রতœা, সঙ্গীত শিল্পী হায়দার হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিখ্যাত শিল্পি ফকির আলমগীর, বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী কিরণ চন্দ্র রায় প্রমুখ এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেই সঙ্গে ১৮৫৮ সালের পাঠশালা ব্রাহ্ম স্কুল, জগন্নাথ কলেজ তথা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ককেও গৌরব ও মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন তারা।
১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুল পরিচালনার ভার ১৮৭২ সালে গ্রহণ করেন বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় চৌধুরী । তিনি এর নাম বদলে তার পিতার নামে রাখেন ‘জগন্নাথ স্কুল’। ১৮৮৪ সালে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজ এবং পরবর্তী সময়ে ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজের মর্যাদা লাভ করে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর জগন্নাথ কলেজই রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এখানেই ঢাকাবাসীর উদ্দেশ্যে তার বিখ্যাত ভাষণটি দেন। ঢাকায় এসে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম বক্তৃতা এই কলেজেই দিয়েছিলেন। এ সময় এটিই ছিল ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি কলেজ। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। নিউমার্কেট এলাকায় জগন্নাথের সম্পত্তির ওপর নির্মিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়।
জগন্নাথ কলেজে আইএ, আইএসসি, বিএ (পাস) শ্রেণি ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স এবং ইংরেজিতে মাস্টার্স চালু করা হলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কলেজটিকে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয় । পুরোনো ঢাকার নারী শিক্ষায় বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৯৪৯ সালে আবার এ কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় সহশিক্ষা চালু করেন। ১৯৬৮ সালে এটিকে সরকারিকরণ করা হয়।
২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। যাত্রার অল্প কয়েক বছরেই বিশেষত ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি উচ্চ শিক্ষার্থীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত এর ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেরাই বহন করেছে। ২০১১ সালে এটি প্রকৃত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা অর্জন করে।
বর্তমানে ৫ শতাধিক শিক্ষক, সাড়ে ৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ২০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে চলেছে। ২০১৩ সালের ২০ মার্চ চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে তিনি জানান, স্বপ্ন নয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন বাস্তবতা। এটাকে একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই তার প্রধান কাজ। অন্যান্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগন্নাথের পার্থক্য হলো, সরকারি একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। জন্ম থেকেই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এটি পথ চলা শুরু করেছে। তবে সব সমস্যা কাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে সুদীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস। শিক্ষক, ছাত্র ও সাংবাদিক রাজনীতি থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজনীতিতেও শুরু হয়েছে গুটি। ফলে সর্বস্থরে পরিণত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি গুটিবাজদের কারখানায়। মানুষ গড়ার কারিগর বিদ্যাপীঠটি ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সাড়া বিশ্বে যেভাবে সাড়া জাগিয়েছে সেই ইতিহাস বিলীন হওয়ার উপক্রম। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মাদ রফিকউদ্দিন (ভাষা শহীদ রফিক) আত্মত্যাগ করেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ভাষা আন্দোলন, ৬৯ গণঅভ্যুথান, ৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অগ্রণি ভুমিকা পালন করেছে।
ছাত্র রাজনীতিতে শুরু হয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। পরিণত হয়েছে মাদকসেবী ও চাঁদাবাজদের আড্ডাখানা। উপগ্রুপে সয়লাব হয়েছে ক্যাম্পাস। ফলে রাজনীতির মুল হোতারা ছাত্ররাজনীতি থেকে যুব রাজনীতিতে যাওয়ার আগ্রাহান্বিত হয়েছেন। কিন্তু কেন ? অন্যদিকে শিক্ষক রাজনীতিতে শুরু হয়েছে স্বার্থপরতা ও প্রতিহিংসা। সাংবাদিক রাজনীতিতে শুরু হয়েছে ব্যক্তি স্বার্থপরতা ও ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ।
এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে হয়তোবা একদিন ঐতিহাসিক এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাবে। তাই সকলের প্রতি আহ্বান ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করে ষড়যন্ত্র ও বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মান বজায় রেখে দেশ ও জাতিকে আলোকিত করতে হবে।
################
রিফাত রাজ
শিক্ষার্থী: গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

পুরোনো সংবাদ

শিক্ষা-শিক্ষাঙ্গন 3440193705678552691

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item