রংপুরাঞ্চলে রোরোর বাম্পার ফলনেও কৃষকের মনে হতাশা

হাজী মারুফ,রংপুর প্রতিনিধি ॥
রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও বাজার মূল্য পাচ্ছেনা সাধারণ কৃষকেরা। খরচে মনপ্রতি ৩’শ থেকে সাড়ে ৩’শ টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের। বাম্পার ফলন হলেও হাসি নেই কৃষকের মুখে । এদিকে, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করে দেনা পরিশোধ করতে না পারায় কৃষকের চোখে-মুখে এখন হতাশার গ্লানি। তবে সরকার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান বা চাল সংগ্রহ করলে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সব চেয়ে বেশি শস্য উৎপাদন করে খাদ্য চাহিদা পূরণে বড় অবদান উত্তরাঞ্চলের। এ বছর রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে রংপুর জেলায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৫০ হেক্টর, গাইবান্ধা জেলায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ১২৫ হেক্টর, কুড়িগ্রাম জেলায় ১ লাখ ১৮ হাজার ১’শ' হেক্টর, লালমনিরহাট জেলায় ৫৭ হাজার ৪১৫ হেক্টর, নীলফামারী জেলায় ৭৭ হাজার ৯৫৫ হেক্টর, দিনাজপুর জেলায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ১’শ হেক্টর, ঠাকুরগাঁও জেলায় ৬৬ হাজার ৪১৫ হেক্টর এবং পঞ্চগড় জেলায় ৪৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমি।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং তেমন কোন রোগবালাই না হওয়ায় ধানের ফলন হয়েছে বাম্পার। এ বছর  হেক্টর প্রতি ধানের ফলন হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ ৪ দশমিক ৭৯ মেট্রিক টন। চলতি বোরো মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ ৩৪ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। যা দেশের মোট চাল উৎপাদনের ২১ ভাগ। রংপুর বিভাগে চালের চাহিদা মাত্র ৮ লাখ মেট্রিক টন হলেও বাকি ২৫ লাখ মেট্রিক টন দেশের অন্যান্য জেলার চাহিদা মেটাতে সহায়তা করছে। এত বড় অবদানের পরও রংপুর অঞ্চলের কৃষকরা ধান চাষ করে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। এদিকে খাদ্য বিভাগ সরকারি ভাবে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় না করে বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাল কেনার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না অথচ কম মূল্যে ধান কিনে ব্যবসায়ীরা চাল বানিয়ে সরকারি খাদ্য গুদামে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর সাধারণ কৃষকরা ধান বিক্রি করতে গেলে খাদ্য কর্মকর্তারা নানান অজুহাত দেখিয়ে ধান ক্রয় করতে অনীহা প্রকাশ করে আসছে।
সরেজমিন রংপুর অঞ্চলের মিাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,  যেখানে মণপ্রতি ধান উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে ৭শ' থেকে সাড়ে ৭শ' টাকা। সেখানে  বর্তমানে মণ প্রতি  ধান ৪ থেকে সাড়ে ৪শ' টাকা দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। ফলে উৎপাদন খরচ না ওঠায় কৃষকদের দুশ্চিন্তা এখন আরো বেড়ে যাচ্ছে। চড়া সুদে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করে এখন ধার শোধ করবে কিভাবে দুশ্চিন্তা ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। স্থানীয় হাটবাজার গুলোতে ধান নিয়ে গেলে ক্রেতা পাওয়া যায় না,  ক্রেতা থাকলেও সর্বোচ্চ সাড়ে ৪’শ টাকার উপরে ধান বিক্রি হচ্ছে না। এ জন্য সরকারের ধান-চাল কেনার ভূল সিদ্ধান্তকেই দায়ী করলেন মাঠ পর্যায়ের শ্রমজীবি কৃষকরা। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ গ্রামের প্রান্তিক কৃষক রুহুল আমিন, নুরুল হক, সালামসহ অনেকেই জানালো সারের দাম বেড়েছে সেই সঙ্গে জমিতে সেচ দেয়ার জন্য ডিজেলসহ অন্যসব সামগ্রীর দাম বেড়েছে। এমনকি ধান রোপণ করা থেকে কাটা পর্যন্ত কৃষাণ মজুরদের মজুরি বেড়েছে অনেক। ধান কাটতে একজন মজুর কমপক্ষে আড়াইশ  থেকে তিনশত টাকা মজুরি নেয়। অথচ ধান চাষ করে যে টাকা খরচ হয়েছে সেটাই উঠছে না। তারা জানান, দাদন ব্যবসায়ী এনজিওসহ বিভিন্ন স্থান থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করে এখন বিক্রি করতে হচ্ছে অর্ধেক দামে। বর্তমান সময়ের খরচ অনুযায়ী একমণ ধানে কমপক্ষে ৯শ' থেকে হাজার টাকা হওয়া উচিৎ ছিল। তবে তারা মনে করেন, সরকার তাদের কাছ থেকে সরসরি ধান চাল সংগ্রহ করলে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবে।
এদিকে খাদ্য বিভাগ ধান কেনার দাম নির্ধারণ করেছে ৭৪০ টাকা মণ হিসেবে আর চাল কিনবে ৩২ টাকা কেজি দরে। কিন্তু তারা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান না কিনে মিল ও চাতালসহ বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাল কেনেন। ফলে ওইসব ব্যবসায়ী সুযোগ বুঝে ধান ক্রয় করে কম মূল্যে। বাধ্য হয়ে কৃষকরা কমদামে ধান বিক্রি করতে  হয়।
কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, খাদ্য বিভাগ ধান কাটামাড়াইয়ের পরপরই যদি কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করত তাহলে কৃষকরা একটু হলেও লাভবান হতো। যেহেতু তারা আগস্ট মাস পর্যন্ত চাল কিনবে সে কারণে বড় বড় ব্যবসায়ী কমদামে ধান কেনার আশায় ধান কেনা থেকে বিরত রয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক কৃষকরা যেহেতু ধান কাটার পরপরই চড়া সুদে নেয়া ঋণ পরিশোধ করার জন্য ধান পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এ সুযোগটা নেয় ব্যবসায়ীরা। এতে তারাই লাভবান হয়, কৃষকরা নয়। মূলত কৃষকরা যাতে ন্যায্য মূল্য পায় বলে ধান-চাল কেনার কথা খাদ্য বিভাগ বললেও এতে তাদের পকেট ভারি হয় আর লাভবান হয় ব্যবসায়ীরা। সে কারণে কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পায় তা নিশ্চিত করা না গেলে ধান চাষে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে আর এর প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এমনটাই মনে করেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। এদিকে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এস.এম সাইফুল ইসলাম জানান- এ বছর বোরো মৌসুমের চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। তবে বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২২ ও ৩২টাকা। ১ মে থেকে চাল কেনার কথা থাকলেও সম্ভব হয়নি। ওই কর্মকর্তা জানান আসলে এভাবে ধান-চাল সংগ্রহ করলে কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায় তা নিশ্চিত করার জন্য সু-নির্দিষ্ট উপায় বের করা দরকার।

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item