কুড়িগ্রামে অস্তিত্ব নেই ৭৪টি আনন্দ স্কুলের

হাফিজুর রহমান হৃদয়, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:
ঘরের উপর ছাউনি নেই। চারদিকে বেড়ায় ঘেরা। বাইরে ‘সাহেবের খাস আনন্দ স্কুল’র সাইনবোর্ড। কিন্তু ভিতরে স্কুলের চিহ্ন নেই। পাশে হাজীপাড়া আনন্দ স্কুল। সাইনবোর্ড না থাকলেও ঘরের ছাউনি বেড়া ঠিক আছে। কিন্তু ঘরের ভেতর খড়ের স্তুপ। দীর্ঘদিন থেকে খড় রাখা হয়। এমন অবস্থা নাগেশ্বরী উপজেলার ৭৪টি আনন্দ স্কুলের। কোথাও ঘর নেই। শিক্ষার্থী নেই। পড়ালেখার বালাই নেই। খাতা-কলমে সব স্কুল সচল দেখানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, উপকরণ, পোশাক, শিক্ষকের বেতন, ঘরভাড়ার কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া হচ্ছে। স্কুলগুলোর সভাপতি হয়েছেন প্রভাবশালী মহল। রস্ক প্রকল্পের ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর, পুল শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের পকেটে যাচ্ছে প্রকল্পের টাকা।
হতদরিদ্র ও ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলমুখী করতে ‘রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন’ (রস্ক) প্রকল্প-২ এর আওতায় পাঁচ বছর মেয়াদে ২০১১সালে নাগেশ্বরী উপজেলার ১ম দফায় চালু হয় ৩শ ৯৫টি আনন্দ স্কুল। শুরুতেই প্রয়োজনীয়তা হিসেব না করে টাকার বিনমিয়ে প্রভাবশালী মহলের হাতে চলে যায় এসব স্কুল। প্রথম দফার স্কুলগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০১৪সালে আবারও ৮৪টি আনন্দ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসব স্কুল করা হয় চরাঞ্চলে। এরমধ্যে ১০টি স্কুল বন্ধ হয়ে গেলেও খাতা-কলমে সচল দেখানো হচ্ছে ৭৪টি স্কুল। উপজেলার কেদার ইউনিয়নে ১২টি, কচাকাটায় পাঁচটি, নারায়নপুরে নয়, নুনখাওয়ায় ১৫, বল্লভেরখাসে ১৬, বেরুবাড়ী ইউনিয়নের সাত, কালিগঞ্জে তিন, রায়গঞ্জে একটি এবং বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে তিনটি। বাকি তিনটি স্কুল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব স্কুল পরিদর্শণ ও সমন্বয়ের জন্য উপজেলায় একজন ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর রয়েছেন শুরু থেকে। গত বছরের শেষে সাত জন পুল শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। তারা প্রতিদিন স্কুলগুলোর সরেজমিন পরির্দশণ করবেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কয়েকটি স্কুলের বাইরে সাইনবোর্ড ঝুললেও ভিতরে স্কুলের কোন চিহ্ন নেই। কোন কোন ঘর ব্যবহার হচ্ছে অন্যকাজে। শুরুতে বেশিরভাগ স্কুলে মেয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে প্রায় শিক্ষক বিয়ে হয়ে অন্যত্র চলে গেছে। সাহেবের খাস আনন্দ স্কুলের শিক্ষক নারজুমান আক্তারের বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়ীতে থাকেন। তার বাবা আব্বাস উদ্দিন বলেন মেয়ের বদলে আমি স্কুল চালাই। দু’একজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি দিতে পারেনি। হাজিরা খাতাও নেই।
বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের পোশাক তৈরীতে পাওয়ার কথা চারশ’ টাকা। প্রতি মাসে শিক্ষা উপকরণ বাবদ ১ম-৩য় শ্রেণি দু’শ’ এবং ৪র্থ-৫ম শ্রেণি তিনশ’ টাকা। পরীক্ষা বাবদ একশ’ টাকা। প্রতিমাসে শিক্ষকের বেতন ৩হাজার এবং স্কুল ঘর ভাড়া ৪শ’ টাকা। ঘর মেরামতের জন্য বরাদ্দ এক হাজার টাকা। কিন্তু  বাস্তবে গত পাঁচ বছরে কোন কোন শিক্ষার্থী দু’একশ টাকা পেলেও বেশির ভাগের কপালে জোটেনি। পোশাক ও উপকরণ কিছুই মেলেনা পায়নি কেউ কেউ। হাজীপাড়া আনন্দ স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে নাম আছে এমন মাজেদা খাতুন মিনা, ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভে উঠেছি। ফাউভের বই এখনো পাইনাই। ক্লাশ টু-এ একবার পোশাক পাইছি। ওই বার টাকা পাই একশ’ আর একবার পাইছি দুইশ’। একই কথা বলেন পঞ্চম শ্রেনির আতাউর রহমান। চতুর্থ শ্রেণির সাহিদা বলেন, পোশাক একবারও পায়নি। কেদার ইউনিয়ন পুল শিক্ষক নুর মোহাম্মদ, হাজী স্কুলে গিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন নিয়মিত স্কুল চলে। পরে অবস্য তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করলে তারসহ শিক্ষকদের বেতন বন্ধ হতে পারে। এবারের মত বিষয়টি ছেড়ে দেয়ার জন্য বলেন তিনি। কেদারের সাতানা আনন্দ স্কুলে কোন শিক্ষার্থী নেই।
স্থানীয়রা জানান, শুরুতে এসব স্কুল টাকার বিনিময়ে দেয়া হয়। শিক্ষক নিয়োগেও টাকা নেয় প্রশাসন। প্রথম দিকে সাইনবোর্ড টানানো হলেও ধীরে ধীরে সেগুলো হারিয়ে যায়। সরেজমিনে ১০টির বেশি স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে স্কুলের কোন অস্তিত্য নেই। খাতা-কলমে ১৫-৩০ জন করে শিক্ষার্থী দেখানো হলেও বাস্তব ভিন্ন। একটি নুরানী মাদরাসার শিক্ষক হাবিবুল্লাহ জানান, প্রায়ই পাশের আনন্দ স্কুলের শিক্ষকরা মাদরাসা গিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে আসে। অফিসার যাওয়ার পর তাদের পাঠিয়ে দেয়। এতে মাদরাসার পড়ালেখার ক্ষতি হয়। আনন্দ স্কুলের শিক্ষকরা নিজেরা পড়ায় না আমাদের ডিস্ট্রাব করে। শিবেরহাটের ইসমাইলে হোসেন বলেন, স্কুল খোলেনা। টাকা আসলে দুই চারজনকে টাকা দেয়। যার যাদের নাম আছে তারা গেলে কয় নাম কাটা পড়েছে। অভিভাবক গেলে একশ টাকা হাতে দিয়ে বলে এমনি দিলাম। চার বছরে তার ভাগিনা উপবৃত্তির টাকা পায়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। অভিভাবক কুলছুম আক্তার বলেন, ছেলেটাক আনন্দ স্কুলত দিছি পড়া পড়বে; উপবৃত্তিও পাইবে। কয়দিন স্কুল চলিল। পরে স্কুল খোলেনা। অফিসার আসলে ডাকে নেয়। পোশাকও দেয়না, টাকাও দেয়না। এজন্য মাদরাসাত ভর্তি করি দিছি। চরাঞ্চলবাসীরা দাবী জানান, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার জন্য সরকারের নেয়া প্রকল্পে দূর্নীতিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে কথা বললে প্রথমে দূর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন রস্ক প্রকল্পের উপজেলা টেনিং কো-অর্ডিনেটর (টিসি) মো. আল মামুন। তিনি বলেন, কত জায়গায় কত দূর্নীতি হচ্ছে এগুলো ছোট বিষয়। তার কাছে তেমন কোন অভিযোগ নেই। তিনি নিজেই অভিযুক্ত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা কেউ বলতে পারবেনা আমি টাকা নেই।
আনন্দ স্কুলের নানা অভিযোগ রয়েছে স্বীকার করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, আনন্দ স্কুলে অভিযোগ ছিল। রক্স প্রকল্পের কর্মকর্তা, পুল শিক্ষকদের কড়াভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোন প্রকার অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

পুরোনো সংবাদ

নিবিড়-অবলোকন 6485915128614872188

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item