বিজয় মাসে পণ্যবাহী রেল দিয়ে চালু হলো চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সংযোগ॥ মাহেন্দ্রক্ষণ ঘিরে দুইপারে জনসমুদ্র


ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়, চিলাহাটি থেকে॥
দীর্ঘ ৫৫ বছর বন্ধ থাকার পর আবারও চালু হয়েছে বাংলাদেশের চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ি রুটে ট্রেন চলাচল। বিজয়ের মাসে পন্যবাহী মালগাড়ি দিয়ে চালু হওয়ার রেলপথটি আবারও প্রাণ ফিরে পেল। এই মাহেন্দ্রক্ষণটি ঘিরে এপার বাংলা ও ওপার বাংলা ঘিরে জনসমুন্দ্রে পরিনত হয়।
আজ বৃহস্পতিবার(১৭ ডিসেম্বর/২০২০) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ মোদি ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলন থেকে এ রেলপথ উদ্বোধনের পর দুপুর আড়াইটায় চিলাহাটি রেলস্টেশন থেকে পণ্যবাহী একটি ট্রেন ভারতের হলদিবাড়ির উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
বাংলাদেশের একটি রেল ইঞ্জিন ভারতীয় ৩২টি খালি ওয়াগন নিয়ে এ যাত্রা করে। এসব ওয়াগন হলদিবাড়ি রেলস্টেশনে রেখে পুনরায় বিকাল সাড়ে ৪টায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশে ফিরে আসবে বাংলাদেশের রেল ইঞ্জিনটি।
এই মহেন্দ্রক্ষণের ২৫ বছরের ট্রেন চালানোর অভিজ্ঞ চালক বিএম শহিদুল আলম সাংবাদিকদের বলছিলেন আমার জীবনে ট্রেন চালানোর আজ স্বার্থকতা খুঁজে পেলাম। ৫৫ বছর আগে এই পথে ট্রেন চলতো শুনেছিলাম। তখন আমার জন্মই হয়নি। আজ নিজেই ট্রেন চালিয়ে ভারতের হলদিবাড়ি যাচ্ছি।
এমন কথা ভাবতেই গা শিহরিত হয়ে উঠছে। ৬৫২৬ নম্বর ইঞ্জিনের এই চালকের সঙ্গে সহকারি চালক ছিলেন তিনজন। এরা হলেন সাইফুল ইসলাম, কমল সরকার ও শাহজাহান। তারাও জানালো ভাগ্যে যে এমন দিনটি পাবো কোন দিন ভাবতেই পারিনি।
হলদিবাড়ি থেকে তারা ফিরে এসে আনন্দের সাথে উচ্ছেসিত হয়ে আরো জানায়, হলদিবাড়িতে ভারতীয় রেলের পক্ষে আমাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে আপায়ন করেন।
ব্রিটিশ আমল থেকেই চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথ যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দার্জিলিং থেকে খুলনা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত এ রেলপথে নিয়মিত একাধিক যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করত। তবে ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে সময় এ রেল যোগাযোগকে ঘিরে চিলাহাটিতে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মার্চেন্ট সমিতি। সেই স্মৃতি বহন করছে চিলাহাটি মার্চেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়।
আবার এ রেলপথ চালু হওয়ায় উৎসুক মানুষ দুপুরে ট্রেনের যাত্রা দেখতে চিলাহাটি স্টেশনের দুইপাশে ব্যাপক ভিড় করে।

তাদের মধ্যে ছিলেন ৬৫ বছর বয়সী স্থানীয় বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাবা-দাদার কাছে গল্প শুনেছি। এ পথ দিয়ে আগে ট্রেন যেত ভারতে। প্রায় ৫৫ বছর পর আমি তা নিজে দেখতে পেলাম।
চিলাহাটি বাহারের এলাকার আশিকুর রহমান (৫৫) বলেন, আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথ এবং চিলাহাটি স্থলবন্দর চালু করার। সেই দাবির প্রেেিত আজ রেলপথ উদ্বোধন হল।
স্থানীয় সাংবাদিক আশরাফুল হক কাজল (৫৮) গেজেট হয়ে থাকা চিলাহাটি স্থলবন্দর দ্রুত চালু করার দাবি তোলেন। ৬৫ সালের যুদ্ধের পর রেল যোগাযোগ বন্ধ হলেও স্বাধীনতার পর চিলাহাটিতে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেকপোস্ট চালু হয়। তবে ২০০২ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্থবির হয়ে পড়ে উত্তরের এ জনপদের ব্যবসা-বাণিজ্য।
নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান জেলা ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ সরকার বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিল পূর্ণাঙ্গ একটি স্থলবন্দর। বর্তমান সরকার সেটি স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারই আলোকে রেলসংযোগ স্থাপনের কাজটি স¤পন্ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ রেল পথ চালু হওয়ায় উত্তরবঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের যুগান্তর ঘটবে বলে আশা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
এ রেলপথ উদ্বোধনে চিলহাটিতে এসে রেলপথ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরল ইসলাম সুজন এমপি জানান, এ পথে দিয়ে আপাতত দুই দেশের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করবে। দুই দেশের সম্মতিক্রমে আগামী ২৬ মার্চ থেকে ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি পর্যনমশ যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের বিশ্বাস উভয় দেশের সব কিছু ঠিক থাকলে ২৬ মার্চেই যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করতে পারব।
আর বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সী এমপি আশা করছেন, আমরা এ পথ দিয়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে পারব। বাণিজ্য সম্প্রসারণ হলে এই অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেল সংযোগ পুনরায় চালুর উদ্বোধনের জন্য চিলাহাটি রেল স্টেশনকে বর্ণিল সাজানো হয়।
উদ্বোধনের সময় স্টেশন ও আশপাশের বাজার এলাকা জনারণ্যে পরিণত হয়। স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় স্থাপন করা হয় এক হাজার মানুষ ধারণ ক্ষমতার বিশাল আকারে প্যান্ডেল।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভিটিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ওই রেল যোগাযোগের উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি বড়পর্দায় দেখানো হয় চিলাহাটিতে স্থাপিত প্যান্ডেলে।
সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নীলফামারী-১(ডোমার-ডিমলা) আসনের সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার, নীলফামারী-৪ (সৈয়দপুর-কিশোরীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান, সংরক্ষিত ২৩ আসনের সংসদ সদস্য রাবেয়া আলিম, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা, রেলের মহাপরিচালক শামছুজ্জামান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক(অবকাঠামো) ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার, রেলের মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিমাঞ্চল) মিহির কান্তি গুহ, অতিরিক্ত মহাপরিচালক(অপারেশন সরদার সাহাদাত আলী, প্রধান প্রকৌশলী আল ফাত্তাহ্ মোঃ মাসউদুর রহমান, রেল বিভাগের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুর রহীম, জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরী, বিজিবি ৫৬ ব্যাটালিয়ন নীলফামারীর অধিনায়ক লে. কর্ণেল মো. মামনুল হক, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান(বিপিএম,পিপিএম) প্রমুখ।
এছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, নীলফামারী জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ, বাংলাদেশ রেলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী(পশ্চিম) কুদরত-ই-খুদা, বিভাগীয় রেল ব্যবস্থাপক(প্রাকশী) শহিদুল ইসলাম, রেলের প্রধান সংকেত এবং টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী(পশ্চিম) সুশীল কুমার হালদার, রেলের প্রধান বানিজিক কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ ভুঞা, রেলের প্রধা বৈদ্যুতিক কর্মকর্তা(পশ্চিম) শফিকুর রহমান, রেলের প্রধান চিকিৎসা(পশ্চিম) সুজিত কুমার রায়, রেলের চীফ কমান্ডের(পশ্চিম) আশলাফুল ইসলাম, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের মহাসচিব সরকার ফারহানা আক্তার সুমি সহ জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমল থেকে অবিভক্ত ভারতে যোগাযোগের প্রধানতম রেলপথ ছিল চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুট। এই পথ দিয়ে নিয়মিত চলাচল করত দার্জিলিং থেকে খুলনা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত একাধিক যাত্রিবাহি ও পণ্যবাহি ট্রেন। ওই রেল যোগাযোগকে কেন্দ্র করে চিলাহাটিতে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সে সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীদের আনাগোনায় মুখরিত চিলাহাটিতে গড়ে ওঠেছিল মার্চেন্ট সমিতি। সেই মার্চেন্ট সমিতর হাত ধরে এলাকায় হয়েছিল বিভিন্ন উন্নয়ন। তারই নিদর্শণ চিলাহাটি মার্চেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পথটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়ে আলাদা দুইটি দেশ হলে এই চিলাহাটিতে চালু করা হয় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেকপোস্ট। এর ছয় বছর পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান ভাগাভাগি হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পর ভারতে প্রবেশের জন্য চালু করা হয় চিলাহাটিতে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চোক পোস্ট। যা চালু থাকে ২০০০২ সালের আগ পর্যন্ত। কিন্তু ২০০২ সালে সেটি বন্ধ করা হয় চিলাহাটির উমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেকপয়েন্ট। স্থবির হয়ে পড়ে নীলফামারীসহ আশপাশ জেলার ব্যবসা বানিজ্য। তখন থেকেই ব্যবসায়ীসহ এলাকার মানুষের দাবি ছিল পুণরায় রেলপথ চালুর। এমন দাবিতে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পালন করা হয় মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি। এরই প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ৫৫ বছর পর পথটি পুণরায় চালুর উদ্যোগ নেয় দুই দেশের সরকার।
২০১৮ সালে ভারত অংশে তিন কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ অংশের ৬ দশমিক ৭২ কিলোমিটার রেলপথ পূর্ণঃস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় দুই দেশের সরকার। নীলফামারীর চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ি সীমান্ত পর্য়ন্ত বাংলাদেশ অংশের ৬ দশমিক ৭২ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ৮০ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পে রেল লাইন স্থাপন ছাড়াও বসানো হয়েছে চার কিলোমিটার লুপ লাইন, আটটি লেভেল ক্রসিং ও নয়টি ব্রীজসহ অন্যান্য অবকাঠামো। সকল নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়েছে বাংলাদেশ অংশে। চিলাহাটিতে একটি আধুনিক আর্ন্তজাতিক রেল স্টেশনও নির্মান করা হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশের পাশাপাশি বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত হলদিবাড়ি থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ করে তাদের অংশে চালিয়েছেন পরীক্ষামূলক ট্রেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে তাদের অংশেও নেওয়া হয়েছে নানা প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশদ্বাড়ে (তাদের অংশে) রেলপথের ওপর স্থাপন করা হয়েছে স্থায়ী তোরণ। ট্রেন চলাচলের উদ্ধোধন উপক্ষে ওই তোরণকে সাজানো হয়েছে রঙ্গিন সাজে।
চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেল লিংক স্থাপনের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুর রহীম বলেন, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর এ পথটি বন্ধ হয়। এরপর বর্তমান সরকার ২০১৫ সালে বন্ধ থাকা রেল লিংক পুণরায় চালুর উদ্যোগ নেয়। সে লক্ষ্যে ২০১৮ সালে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেল লিংকটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন বর্তমান রেলপথমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. নুরুল ইসলাম সুজন এমপি এবং ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাংগুলি। আমরা জোরেসরে মেইন রেললাইনসহ আনুসঙ্গিক কাজগুলো আমরা সম্পন্ন করি। ভারতও তাদের অংশের কাজ শেষ করে। এরপর উভয় অংশে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়।

পুরোনো সংবাদ

হাইলাইটস 2715050392017313024

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item