তিস্তায় চমক উজানের ঢলে থই থই

উজান ও ভাটিতে সমান সমান থই থই পানিতে ভাসছে তিস্তা নদী। অকাল বন্যায় শাক সবজী আর ফসলে  ভরা তিস্তার বালুচরের জমি গুলো তলিয়ে গেলেও  চরবাসীর মাঝে নেই কোন দুঃখ। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন তিনদিনের ভারত সফর ঘিরে হঠাৎ শুস্ক মৌসুমে উজানের ঢলের চমকে এলাকাবাসী হয়ে পড়েছে আনন্দে আতœহারা। নদীর বুকে চলতে থাকে শতশত নৌকা। যদিও তিস্তা চুক্তির বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়। তবে আশাহত বলা যায় না। গত রবিবার (২ এপ্রিল) রাতেই উজানের ঢল নেমে আসে তিস্তা নদীতে। গত সোমবার ও আজ মঙ্গলবার তিস্তার পানির গতি ভালই চলছে যেন।
 তিস্তাপাড়ের চরখড়িবাড়ি গ্রামের মশিয়ার রহমান (৫৫) ও তার স্ত্রী মমিনা বেগম(৪৫) বললেন সোমবার ভোরে ঘুম ভেঙ্গে দেখি তাদের  বালুচরের এক বিঘা জমির মিস্টি কুমড়ার ক্ষেত সহ এলাকার শতশত বিঘা জমির ফসল নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে হঠাৎ করে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায়  তারা অত্যান্ত খুশি । শুধু এই দম্পক্তি নয়  টাপুরচরের মমতাজ উদ্দিন(৪৫) ও তার স্ত্রী জামিলা বেগম(৩৮) সহ শতশত চরবাসী একই কথা বললেন।
তিস্তারপাড়ের ছোটখাতা গ্রামের নৌকার মাঝি জিনাত আলী (৫৬),শেখ সুন্দর গ্রামের খরকোস আলী(৫৫) বললেন বালুচরে পড়ে থাকা তাদের নৌকাগুলো তিস্তায় পানি পেয়ে চলতে শুরু করেছে। এ ছাড়া তিস্তাপাড়ের জেলেরা মাছ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তাদের জালে একে একে ধরা পড়তে থাকে তিস্তার বিখ্যাত মাছ বৈরালী, আইড়,বাগাইর মাছ।
তিস্তা ব্যারাজ কমান্ড এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ড - এর কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা রফিউল বারী  জানান, চলতি শুস্ক মৌসুমে এবার নদীতে গড়ে দুই হাজার কিউসেক পানি পাওয়া যায়। যা দিয়ে এবার খরিপ-১ মৌসুমে ২০ হাজার ২০২ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছিল। সোমবার ভোর হতে তিস্তায় পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১২ হাজার কিউসেকের উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এমন পানি নদীতে থাকায় ৬৫ হাজার হেক্টরে সেচ প্রদানে কোন বেগ পেতে হবে না। আর নদীর এমন পানিতে দেশের সর্ব বৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ কমান্ড এলাকা নীলফামারী,দিনাজপুর ও রংপুরের প্রতিটি সেচ ক্যানেল পানিতে ভরিয়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে উজানের ঢলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায়  তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে বলে জানালেন ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানান ধারনা করা হচ্ছে উজানে ভারী বর্ষনের কারনে ভারতের গোজলডোবা ব্যারাজের গেট খুলে দেয়ার কারনে ঢল এসে আগাম বন্যা দেখা দিয়েছে।
অপরদিকে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা ও পুর্বাভাস সর্তকীকরন কেন্দ্র সুত্র বলছে  রবিবার সকাল ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ ছিল ৫০ দশমিক ২০ মিটার। সোমবার সেটি এক লাফে বৃদ্ধি পায় দশমিক ৮৫ মিটার। যা বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানির স্থর ১২ হাজার হতে ১৩ হাজার কিউসেকে প্রবাহিত হওয়ায় অকাল বন্যার সৃস্টি হয়েছে। ফলে তিস্তার ধুধু বালু চরে পানি উঠেছে।
সরেজমিনে দেখা যায় তিস্তা চরে রোপন করা ভুট্টা ক্ষেত পানিতে ভরে উঠায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটলেও হঠাৎ পানি বৃদ্ধিতে  সবজিসহ মিষ্টি কুমড়া, পিয়াজ ও রসুনের ক্ষেত  ডুবে যাওয়ায় হতাশাও লক্ষ্য করা যায়।
তিস্তা পাড়ের সানিয়াজান এলাকার ভুট্টা চাষি কপিল উদ্দিন ও আলকাস উদ্দিন জানান, পানির অভাবে রুক্ষ ভুট্টা গাছগুলো পানি পেয়ে সতেজ হয়ে উঠছে।তবে পিয়াজ চাষি আলম মিয়া জানান, তার পিয়াজ ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। উঠতি এ ফসল হঠাৎ ডুবে যাওয়া চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
নির্ভরযোগ্যসুত্র জানায় আগামী ৭ এপ্রিল তিনদিনের সফরে  ভারত যাচ্ছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই সফরে এখনও তিস্তার পানি চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত নয়। তবে বিভিন্ন সুত্র জানায় প্রাথমিকভাবে ১৫ বছরের একটি অস্থায়ী চুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তো তারই আভাসে হঠাৎ করে তিস্তায় উজানের ঢল চমক সৃস্টি করতে পারে।
এখানে উল্লেখ যে শুস্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর পানি না থাকায় তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প কমান্ড এলাকার ৬৫ হাজার হেক্টর জমির স্থলে এবার খরিপ-১ মৌসুমে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছিল। কিন্তু নদীতে গড়ে দুই হাজার কিউসেক পানি পাওয়া যাওয়ায় চে পাচ্ছিল ২০ হাজার ২০২ হেক্টর জমি। আর সেচ সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হয় ৫৭ হাজার হেক্টর।
কিন্তু খাদ্যাভাবের কথা চিন্তুা করে কৃষকরা বসে থাকেননি। তাই তিস্তা সেচ কমান্ডার এলাকার কৃষকরা নিজস্ব সেচব্যবস্থা গড়ে তুলে বোরো আবাদে নামে।
জানা গেছে, তিস্তার পানি কমে যাওয়ায় তিন বছর ধরেই সেচ সুবিধার আওতাধীন জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমে আসে। বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানির প্রবাহ ১৯৯৭ সালে ছয় হাজার ৫০০ কিউসেক থেকে ২০০৬ সালে এক হাজার ৩৪৮ কিউসেক এবং ২০১৬ সালে মাত্র ৭০০ কিউসেকে নেমে আসে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১৪-১৫ সালে বোরো মৌসুমে রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তিস্তায় পানির অভাবে সেচ দেওয়া সম্ভব হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ ওই বছর সেচ সুবিধা থেকে বাদ পড়ে ৪৭ হাজার হেক্টর জমি। ২০১৫-২০১৬ সালে বোরো মৌসুমে আরো কমিয়ে সেচ সুবিধা দেওয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। চলতি ২০১৬-১৭ সালে তা আরো কমিয়ে মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দিনাজপুর ও রংপুরের কমান্ড এলাকা ৫৭ হাজার হেক্টর জমি সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে শুধু নীলফামারী জেলার ডিমলা, জলঢাকা, নীলফামারী সদর ও কিশোরীগঞ্জ উপজেলাকে সেচের আওতায় রাখা হয়েছে।
তিস্তা অববাহিকার পাঁচ হাজার ৪২৭ গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এই নদীর ওপরই নির্ভরশীল। তাই তিস্তার পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। তিস্তাা অববাহিকার আট হাজার ৫১ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকার পরিমাণ চার হাজার ১০৮ বর্গকিলোমিটার। যার প্রায় অর্ধেক পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। দুই দেশই তিস্তর পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময় নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ভারত এই মুহূর্তে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ তিস্তার পানি ব্যবহার করছে শুধু পরিকল্পিত সেচ দেওয়ার কাজে।
ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। তাই এবারের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে তিস্তাপাড়ের মানুষজন তিস্তা চুক্তির স্বপ্ন দেখছেন। 
-ঃপ্রতিবেদনটি লিখেছেন অবলোকনের প্রধান উপদেষ্টা ও দৈনিক জনকন্ঠের স্টাফ রির্পোটার  তাহমিন হক ববী

পুরোনো সংবাদ

প্রধান খবর 4566678721004279844

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item