মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল সুর ‘ভুবন মাঝি’


সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ‘ভুবন মাঝি’ নিয়ে আগ্রহ ছিল নানা কারণেই। এক, এই সিনেমার মাধ্যমেই বাংলাদেশের বড় পর্দায় অভিষেক ঘটছে ওপারের পরমব্রত’র; দুই, সিনেমাটির নির্মাতা এমন একজন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে যার নির্মিত তথ্যচিত্র। সুতরাং বড়পর্দায় এই জুটির রসায়নটা কেমন জমে, সেটাই ছিল দেখার বিষয়।

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বাংলাদেশে সিনেমা তৈরি হলে বাহবা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ভয় থাকে ইতিহাসকে বিকৃত করে কিংবা স্পর্শকাতর কোনো বিষয়কে বেঠিকভাবে উপস্থাপন করে দুয়ো শোনারও। তবে ‘ভুবন মাঝি’র নির্মাতা ফাখরুল আরেফিন তেমন আশঙ্কার সুযোগই রাখেননি। সত্য কাহিনির সূত্র ধরে কাল্পনিক এক গল্প তিনি দেখিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে অটুট ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল সুর।

‘ভুবন মাঝি’র গল্প কুষ্টিয়ার মুক্তিযোদ্ধা নহিরকে নিয়ে। সাহিত্যপ্রেমী এক ভীরু যুবক, কিন্তু ‘অস্থির’ রাজনীতির প্রতি যার রয়েছে ঘোর অনাস্থা। কিন্তু নহির-এর প্রেমিকা ফরিদা মেয়ে হয়েও রাজনীতি সচেতন। থিয়েটার পাগল প্রেমিকের হাতে তাই সে তুলে দেয় ‘জীবনের চিত্রনাট্য’- বাঙালির স্বাধীনতার প্রথম ইশতেহার, ছয় দফা দাবির বুকলেট!

ফরিদার প্রেরণাতেই একসময় নহিরও যুক্ত হয় রাজনীতির সঙ্গে এবং ক্রমেই জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধের ডামাডোলেও। কিন্তু তারপরও মানবিকতার কারণে মানুষ হত্যা করতে হাত কাঁপে তার, তা রাজাকারের মতো ঘৃণ্য জীব হলেও!

একই সমান্তরালে এগিয়ে চলে এই সময়ের নির্মাতা সোহেল-এর গল্প। ২০০৪ সালে কুষ্টিয়া গিয়ে যে তুলে এনেছিল বাউল আনন্দ সাঁইয়ের গল্প। ২০১৩ সালে, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে যখন উত্তাল শাহবাগ, জঙ্গিদের কোপে যখন বাড়ছে মুক্তমনা ব্লগারদের মৃত্যুর ঘটনা, তখন আনন্দ সাঁই-এর মৃত্যুকে ঘিরে রচিত হয় মৌলবাদিদের আরেক নাটক। এসব দেখে শান্ত থাকতে পারেনা সোহেল, আনন্দ সাঁইয়ের তথ্যচিত্রকে সে ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাতিয়ার হিসেবে।

ঢাকাই ছবির ইতিহাসে সমান্তরাল গল্পের সিনেমার সংখ্যা খুবই কম। হাতে গোনা কটি সিনেমাও যে সফলভাবে সমান্তরাল একাধিক কাহিনিকে চিত্রনাট্যে ঢোকাতে পেরেছে, সেটা নয়। সেদিক থেকেও ‘ভুবন মাঝি’ উৎরে গেছে অনেকটাই। এক গল্পের দৃশ্য থেকে আরেক গল্পে যাওয়ার সিকোয়েন্স ট্রানজিশন ক্ষেত্র বিশেষে কিছুটা গোলমেলে ছিল বটে, কিন্তু ‌শেষপর্যন্ত নন-লিনিয়ার স্টোরিটেলিং-এর দিক থেকে সফলই বলা যেতে পারে এই সিনেমার চিত্রনাট্যকে।

সিনেমার অন্যতম আকর্ষণ অবশ্যই কলাকুশলীদের দুর্দান্ত অভিনয়। পরমব্রত পারদর্শী জনপ্রিয় সিনেমায় পাশের বাড়ির ছেলের ইমেজ তৈরিতে, এই সিনেমাতেও সেই কাজটি করেছেন তিনি ভালোভাবেই। তবে সেই ‘লক্ষীছেলে’র খোলস থেকে যেভাবে নহিরের চরিত্রটিকে তিনি সংকল্পবদ্ধ এক মুক্তিযোদ্ধায় রূপান্তরিত করলেন, সেটি এক কথায় অসাধারণ।

নহিরের প্রেমিকা ফরিদার চরিত্রে অপর্না ঘোষও মানিয়ে গেছেন ভালোভাবেই। সেইসময়ের কলেজগামী নারীদের চলন-বলন সুচারুরূপেই তুলে ধরতে পেরেছেন তিনি।

পার্শ্ব চরিত্রগুলোতে মাজনুন মিজান, মামুনুর রশীদ সামর্থের সেরাটাই দিয়েছেন, তবে আলাদা করে বলতে হচ্ছে রাজাকার আসলামের চরিত্র রূপায়ণ করা শুভাশিস ভৌমিকের অভিনয়ের কথা। গোটা সিনেমার সকল অভিনয়শিল্পীই স্বাভাবিক অভিনয় করলেও এই একটি চরিত্রে দেখা গেল খানিকটা মেলোড্রামা। তবে গল্পের স্বার্থে ওইটুকু অতিঅভিনয় যথাযথ ছিল বলেই মনে হয়েছে সিনেমাশেষে।    

সিনেমার আরও একটি সাফল্যের জায়গা হলো এর সংলাপ। বেশ কিছু দৃশ্যের জটিলতা কেবল একটি-দুটি প্রতীকি সংলাপ দিয়ে তুলে ধরেছেন পরিচালক, সচতুরভাবে যেগুলো আড়ালে ব্যঙ্গ করেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই।

মুক্তিযুদ্ধের পরে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিষয়টি কতো বড় ভুল ছিল, এটা বোঝাতেই হয়তো একটি চরিত্রের মুখে শোনা যায়, ‘এরে (রাজাকার আসলাম) ক্ষমা করবেন না। তাইলে আল্লাহও মুখ ফিরায়ে নিবে।’

কিংবা আনন্দ সাঁইয়ের জানাজাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়ানোর নাটের গুরু ছোট হুজুরকে বড় হুজুরের শাসনের পর প্রত্যুত্তর হিসেবে ছোট হুজুরের ব্যঙ্গোক্তি, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে’ও তুলে ধরে নির্মাতার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে কটাক্ষকে।

তবে সিনেমার অন্যতম শক্তিশালী সংলাপটি ছিল ইতিবাচক। কুষ্টিয়ার পুলিশ ‌কার্যালয়ে সবাই যখন পাকবাহিনীদের প্রতিরোধে ঢাকার নির্দেশের অপেক্ষা করছে, নহির তখন ‘ঢাকা থেকে কিন্তু নির্দেশ দেওয়াই আছে’ বলে চালিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ যে ওই একটি ভাষণের মাধ্যমে বুনে দিয়েছিলেন শেখ মুজিবর রহমান- তাই যেন একবাক্যে বুঝিয়ে দিলেন পরিচালক।

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য’র সংগীত সিনেমাটির প্রাণ- একথা স্বীকার না করে উপায় নেই। সিনেমায় ব্যবহার হয়েছে মাত্র চারটি গান, যা মূলধারার বাংলা সিনেমার তুলনায় কমই বলা যেতে পারে। তবে এইকটি গান দিযেও সিনমাজুড়ে যে মায়াজাল তৈরি করেছেন কালিকাপ্রসাদ, তা এককথায় অনবদ্য।

‘আমি তোমারই নাম গাই’ গানটি ইউটিউবের সুবাদে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এরমধ্যেই; সহজ-সরল কথা আর একেবারেই আটপৌরে সুরের গানটি দিয়ে যেন চিরচেনা বাঙালির মধ্যবিত্ত প্রেমকে তুলে ধরেছেন কালিকাপ্রসাদ।

ওদিকে ‘ছিল ছায়া ঘেরা পাখি ডাকা’ গানটিতে বারবার যুদ্ধের আঘাতে বাঙালির শেকড়ছিন্ন হয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রার কষ্টই উঠে আসে গ্রামীন সুরের আবহে। গানটি ঘরের কাজ করতে করতে গুনগুন করে গেয়ে ওঠার গান, দীর্ঘ শোষণ আর বঞ্চনার কান্না লুকিযে প্রতিরোধের ডাক দেওয়ার গান।

আবার ‘বোতলে পুরেছি কান্না’ পুরোপুরি ভিন্ন মেজাজের গান; নাগরিক কপটতার কালে বিবেককে উজাড় করে ‍নির্মোহ সত্যকে তুলে ধরার গান যেন এটি। অ্যাকুস্টিক গিটারের সুর আর শহুরে কথার গানটি অনায়সেই জ্বালাতে পারে বিদ্রোহের আগুন।

তবে কালিকাপ্রসাদ-এর নিজের মেজাজের সঙ্গে যে গানটি সবচেয়ে সঠিকভাবে যায়, সেটি হলো ‘পদ্মা নদীর নৌকা ভিড়েছে হুগলি নদীর তীরে’। সিনেমার অভিনেতা পরমব্রত-র কণ্ঠ দেওয়া গানটি কথায় কিংবা সুরে, সব দিক থেকেই যেন তুলে ধরে দোহার-এর দর্শনকে। লালনের গানের কথার সঙ্গে তো মিলে যাবেই এই গানের কথাগুলো, সেই সঙ্গে ভালোবাসার বাঁধনে দুই বাংলার মানুষকে একই সমতলে নিয়ে আসার স্বপ্নের কথা বলে গানটি, যে স্বপ্ন অনেকের মতোই কালিকাপ্রসাদ নিজেও প্রবলভাবে দেখেছেন।

চিত্রগ্রহণের কাজটি রানা দাশগুপ্ত সুন্দরভাবেই করেছেন। গড়াই তীরের ‌সূর্যাস্ত, কিংবা কলকাতার অলিগলিও নান্দনিকভাবে উঠে এসেছে সিনেমার দৃশ্যগুলোতে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দৃশ্যায়ণ আরও ভালো হতে পারতো, এ কথা বলতেই হচ্ছে।

ইতিহাস নির্ভর সিনেমা হিসেবে কস্টিউম এবং সেট ডিজাইনের বিষয়টিও সুচারুরূপে করার বিষয়টি নির্মাতা খেয়াল রেখেছেন, ‘ভুবন মাঝি’র এই বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসার। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলোকস্বল্পতা দৃষ্টিকে পীড়া দিয়েছে খুব। বিশেষ করে ফরিদার সঙ্গে নহিরের শেষ দেখার দৃশ্যটির আবেগ অনেকটাই নষ্ট হয়েছে আঁধারের কারণে অপর্ণা ঘোষ-এর চেহারা পুরোপুরি দেখতে না পাওয়ায়।

এত ইতিবাচক বিষয়ের পরও ‘ভুবন মাঝি’ পুরোপুরি সফল সিনেমা হয়ে উঠতে পারেনি নির্দেশনা একটু বেশি থিয়েট্রিকাল হয়ে যাওয়ায়। সিনেমার বেশ কিছু অংশ দেখে একে মঞ্চনাটকের সঙ্গে তুলনা দর্শক করতেই পার, এবং সে দায অবশ্যই নির্মাতার।

তবে এরপরও ‘ভুবন মাঝি’র সঙ্গে সময় মন্দ কাটেনি। বরঞ্চ স্বাধীনতার মাসে পুরোপুরি দেশী স্বাদের ও চেতনার এই সিনেমা মন থেকে দূর করেছে বিদেশী সংস্কৃতির কাছে বাঙালিত্বের বিকিয়ে যাওয়ার ভয়কে। আর সে কারণেই পরমব্রত’র অভিষেকের ছবি বাহবা দিচ্ছি জোরগলাতেই।

পুরোনো সংবাদ

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি 7847182692892326966

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item