বনবিভাগের কালো থাবায় লন্ডভন্ড চৈতুর পরিবার

মোঃ আব্দুর রউফ,উন্নয়ন কর্মী-“সারা দিন খাটা খাটুনীর পর নিজের ভিটাত শান্তিতে নিন পারোমো সেই কপালো হামার নাই। কখন বাড়ী ভাঙ্গীদেয় সেই ভয়ে দুই চউখের পাতা একঠে করির পাও না”। কথা গুলো বলছিলেন, নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার ৩ নং গোমনাতী ইউনিয়নের দক্ষিণ গোমনাতী মৌজার বাসিন্দা হতদরিদ্র ভ্যান চালক রফিকুল ইসলাম (চৈতু) (৫৫) পিতা মৃত মফিজার রহমান। চৈতু বলেন ৪ ভাই ৩ বোনের মধ্যে সে তৃতীয়, ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। চৈতুদের ছিল যৌথ পরিবার, কৃষি নির্ভর এই পরিবারের আর্থিক অনটন থাকলেও পরিবারে ছিল পারিবারিক বন্ধন, সুখ দুঃখে একে অপরের পাশে ছিলেন, কিন্তু  বন বিভাগের কালো থাবায় পৈত্রিক ভিটা থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায় চৈতুর পরিবার। চৈতুর  বড় ভাই দিন মজুর শহিদুল ইসলাম (৬৫) স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পাশ্ববর্তী কলোনী পাড়ায় সরকারী খাস জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তৃতীয় ভাই আলম (৫০) সৈয়দপুর শহরের হাতিখানা এলাকার একটি বস্তিতে ভাড়া থেকে শহরে রিক্সা-ভ্যান চালায়। ছোট ভাই আলাল (৪০) পরিবার নিয়ে উঠেছে সরকারী গুচ্ছ গ্রামে। বৃদ্ধ মা নুরনাহার বেগম (৯০) এর কোন ঠিকানা নেই। আমার কোন উপায় না থাকায় অনেক কষ্ট করে বাবার বসত ভিটার সেই পুরানো বাড়ীতে কোন রকম মাথা গোজার জায়গায় করে পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ আতঙ্কে নির্ঘুম রাত্রী যাপন করছে। বাবা একজন কৃষক ছিলেন ৫০ দশকে আমাদের আবাদী জমি জোতদাররা নিয়ে নিলে আমরা ভূমিহীন হয়ে পরি, পরবর্তিতে জোতদারের কৃষি জমি বর্গা চাষবাস করে ১৯৬৩ সালে বসত ভিটার জমিটি জোতদার বছির উদ্দিন ও ছপির উদ্দিনের নিকট থেকে দুই দাগে ৯০ শতক জমি ক্রয় করি।
কিস্তিতে মুল্য পরিশোধ ও দলিল খরচ জোগার করতে অনেকদিন চলে যায় ফলে জোতদার ছপির উদ্দিন ২৫/১/ ১৯৭৮ সালে ৭২৭ খতিয়ানের ৩৪৩৫ দাগে ৭.৭২ একর জমির মধ্যে ৭৫ শতক এবং জোতদার বছির উদ্দিন ৬৮৪ খতিয়ান ভুক্ত ৩৪৩৪ দাগে ১.৮৭ একর জমির মধ্যে ১৫ শতক জমি আমার বাবা মফিজার রহমানের নামে ১৪/১০/১৯৭৮ সালে দলিল সম্পাদন করে দেন। আমাদের পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত নিজ নামে খতিয়ান ভুক্ত জোত জমা বন বিভাগ কতৃপক্ষ সরে জমিন তদন্ত না করিয়া আমাদের সাথে কোন প্রকার আলোচনা না করে বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ ইচ্ছায় আমাদের আবাদী কৃষি জমি, বসত বাড়ীসহ নিজ নামে সিএস, আরএস খতিয়ান ভুক্ত জমি পতিত দেখিয়ে একটি তালিকা প্রণয় করেন এবং ২১ জানুয়ারী ১৯৬৫ সালে সমাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১০০(একশত) বছরের জন্য এক তরফা একটি গেজেট তৈরী করেন। ১৯৬৯ সালে বন বিভাগের লোকজন জমি চিহ্নিত করতে আসলে বিষয়টি প্রাথমিক ভাবে জানা জানি হয়, সেই সময় জোতদারদের কিছু জমি পতিত ছিল। আমরা জানি জোতদারদের পতিত জমি বন বিভাগ লীজ নিয়ে বন করবে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৮ সালে বন বিভাগ গাছ লাগানো শুরু করে। বন বিভাগের লোকজন সামাজিক বনায়ন নীতিমালা ভঙ্গ করে এলাকার কিছু উৎশৃঙ্খল যুবক ও প্রভাবশালী লোকদের নিয়ে উপকারভোগী দল তৈরী করে এবং জমির মালিক পক্ষকে ৪০% শেয়ার দেয়ার মৌখিক আশ্বাস দিয়ে পুলিশি প্রহরায় দিনে রাতে চারা রোপন শুরু করেন। আমি প্রতিবাদ করলে আমার জমিতে গাছ লাগানো বন্ধ রাখেন। আমাকে উপকারভোগী দলের সদস্য করা হয়, তবুও আমি আমার জমিতে গাছ লাগাতে দেই না কিন্তু ১৯৮০ সালে আমি রিক্সা চালাতে ঢাকা গেলে ঐ সময় রাতে আমার জমিতে গাছ লাগান এবং বাড়ীর অঙ্গিনায় গাছ লাগানোর চেষ্টা করেন  । জমির উপর আমাদের অনেকেরই বাড়ী আছে,  চাষ আবাদ করি। এখন কি হবে উপায় না পেয়ে তখন প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রশাসক নীলফামারী বরাবরে ৮ ফেব্রুয়ারী’ ১৯৮৬ সালে লিখিত আবেদন করি, আবেদনের প্রেক্ষীতে জেলা প্রশাসক মহোদয় সহকারী কমিশনার নীলফামারীকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির পক্ষ থেকে ২৫/৮/৮৮ তারিখ সহকারী কমিশনার ও তদন্ত কর্মকর্তা নীলফামারী কর্তৃক স্বাক্ষরিত সা¦ারক নং বন ৪/৮৮ নোটিশের মাধ্যমে জমির মালিক পক্ষ ও রেঞ্জ বন কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ গোমনাতী ইউনিয়ন পরিষদে ২/৯/৮৮ তারিখ বেলা ৩:০০ টায়  উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করেন। আমরা জমির মালিকগণ উপস্থিত হলেও সহকারী কমিশনার ও তদন্ত কর্মকর্তা নীলফামারী ও রেঞ্জ বন কর্মকর্তা অজ্ঞাত কারনেই অনুপস্থিত থাকেন, সেই থেকে আমরা সরকার পক্ষের কাছ থেকে ন্যয় বিচার প্রাপ্তী থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছি। পরবর্তিতে আমার বাড়ী ভাঙ্গার জন্য বনবিভাগের পক্ষ থেকে প্রতিদিনই চেষ্টা করে ১৮/৬/২০০৫ তারিখে জমির দখল ছেরে দেয়ার জন্য নোটিশ করেন, আমি ২৩/৭/২০৫ তারিখে একটি লিখিত জবাবসহ তার সাথে দেখা করি এবং ঘটনা খুলে বলি তখন তিনি আমাকে নির্ভয়ে বাড়ীতে থাকতে বলে। ১৩/৩/২০০৭ তারিখে বিট কর্মকর্তা নোটিশ করেন. নোটিশে জরুরী আইনের আওতায় বাড়ীঘর ও স্থাপনা ভাঙ্গার হুমকি দেন।  বন বিভাগের এই বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে আমাদের মত শতাধিক পরিবার ভুমিহীন হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে অতি কষ্টে জীবন যাপন করছি। বিগত বিশ বছরে বন বিভাগ অধিকাংশ গাছ কর্তন করে বিক্রি করলে আমরা জমির মালিকগণ কোন অংশ পাই নাই। বন না থাকায় অধিকাংশ কৃষি জমি বন বিভাগের কর্মচারী ও কর্মকর্তাগণ বার্ষিক লীজ দিয়ে অবৈধ ভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে আসছেন। আমরা জমির মালিকগণ বিগত ৩৫ বছরে জমির ক্ষতিপুরণ কিংবা গাছ বিক্রির শেয়ার কোনটাই পাই নাই। উপকারভোগীদের মাঝে শেয়ারের টাকা বন্টন কালে বন কর্মকর্তা কমিটির  সভাপতির মাধ্যমে ৫০০০ টাকা ঘুষ দাবী করেন, আমি ভ্যান চালিয়ে যা আয় করি তা দিয়ে আমার সংসার চলে না ৫০০০ টাকা কোথায় পাব! সেই ঘুষের টাকা দিতে পারি নাই বলে আমাকে শেয়ারের টাকা দেয়া হয় নাই। বিগত মাঠ জরিপে বন বিভাগ কথিত গেজেট দেখিয়ে বন মন্ত্রণালয়ের নামে আমাদের জমি রেকর্ড করিয়ে নিয়েছেন। “সরকার কি হামার বসত ভিটা নিয়া নিবেন! হামরা কি হামার পৈত্রিক সম্পত্তি আর ফেরত পামো না! তা হইলে হামার ছাওয়াছোট কোনঠে যায়া দারাইবে? কায় দিবে ওমাক থাকির জায়গা? হামরা ন্যায় বিচার চাই!

পুরোনো সংবাদ

নিবিড়-অবলোকন 7595727099913025745

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item