ঐতিহ্যের মনুমেন্ট বধ্যভূমি রংপুর টাউন হল

মামুনুররশিদ মেরাজুল
-এক শতাব্দীর ঐতিহ্য ও স্মৃতি জড়িয়ে আছে রংপুর টাউন হলের শরীর জুড়ে। শুধু আনন্দ, চিত্ত বিনোদন বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত নয় এই হলটি। এর পিছন ফিরে তাকালে শোনাা যায় অনেক বেদনা ও কষ্টের স্মৃতি বিজজড়িত গল্প। হলের ইট পাথরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে একাত্তরের মহান মুক্তিযদ্ধের স্মৃতিকথা। বীরাঙ্গনাদের আর্ত চিৎকার। গুমোট চাপা ধর্ষিতার কান্না।

পাক হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই টাউন হলকে বানিয়েছিল 'নারী নির্যাতন' কেন্দ্র। যুদ্ধের বিভীষিকায় অসংখ্য নারী এখানে সম্ভ্রম হারিয়েছে। এখানে হত্যা করা হয়েছে অনেক মুক্তিকামী নিরাপদ মানুষকে। আর সেই বিভীষিকাময় দিনের স্মৃতি ধারণ করে এখনও দাঁড়িয়ে আছে রংপুর টাউন হল।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে ৫০ জন বিবস্ত্র নারীকে উদ্ধার করা হয় এই টাউন হল থেকে। যাদের একজন মেয়ে নিজের আঙ্গুল কামড়ে রক্তাক্ত করে সেই রক্তে দেয়ালে লিখেছিলেন ‘আমি বাঁচতে চাই।’ নরপশুরা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় এই টাউন হলকে পাক হানাদার বাহিনী বানিয়েছিল “গণ নির্যাতন কেন্দ্র।” বৃহত্তর রংপুরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে আনা হতো নিরপরাধ মুক্তিকামী বাঙ্গালী মানুষজনকে। যাদের একটি বড় অংশ ছিল কম বয়সী নারী। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধরে আনা সেই সব নারীদের উপরে দিনের পর দিন চলতো পাশবিক নির্যাতন।

মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস এই টাউন হলে চলেছে মানুষ রুপি হায়েনাদের নজিরবিহীন গণধর্ষণ, গণনির্যাতন আর গণহত্যা। যে হলে একদা মানুষ ছুটে আসতো সুরের মূর্ছনায় সেই হলের গ্রীণ রুম, রিহার্সাল রুম আর মঞ্চে ধর্ষিতার ক্রন্দন আর বুকফাটা আর্তনাদে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে পুরো শহরের মানুষ।

রংপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া তথ্য মতে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসালামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমানে ছাত্রশিবির) রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি এবং কুখ্যাত আল-বদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার এটিএম আজহারুল ইসলাম (যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত এবং কারারুদ্ধ) ৭০ জনের একটি সশস্ত্র আল-বদর স্কোয়াডের নেতৃত্ব দিতেন। সেই স্কোয়াডের ঘাঁটি ছিল রংপুরের টাউন হল এলাকায়। আজহারুল এবং তার সহযোগীরা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনের জন্য ভয়-ভীতি দেখিয়ে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের, এমন কি অপেক্ষাকৃত নিরীহ মুসলিম পরিবারের সুন্দরী তরুণী এবং গৃহবধূদের ধরে এনে সরবরাহ করতো টাউন হল গণনির্যাতন কেন্দ্রে।


প্রতিটি জাতীয় দিবসে এই টাউন হল ক্যাম্পাসেই অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদী ভরে ওঠে ফুলে ফুলে। অনেকে আসেন শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। বিনম্র চিত্তে স্মরণ করেন আমাদের জন্য একটি স্বাধীন- সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মাহুতি দেয়া অজস্র শহীদের।

কিন্তু শহীদ মিনারের ২০০ গজের মধ্যে যে বধ্যভূমি, সেখানে দাড়িয়ে নিরবতা পালন, ফুলেল শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দৃশ্য চোখে পড়ে না। যদিও পাঁচেক আগে টাউন হলের পিছনে শিল্প কলা একাডেমী ভবনের সামনে বেসরকারী উদ্যোগে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে নিজ শহরে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন টাউন হল বধ্যভূমির প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। দেখেছেন সেই বিভীষিকাময় দৃশ্যটি। তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর  টাউন হলের পিছনে শিখা সংসদে গিয়ে পাকবাহিনীর নৃশংসতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। তখনও হলের ভিতর থেকে ভেসে আসছিল অসংখ্য নারীর করুণ আর্তনাদ। রঙ্গমঞ্চের গ্রীণ রুমের সামনে থেকে কে যেন একজন “পানি পানি” বলে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। শিখা সংসদের পিয়ন নির্মল এগিয়ে যান গ¬াস হাতে। এক ঢোকে পানি পান করে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারালেন সেই যুবতী মেয়েটি। তাঁর জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। জানা যায়নি তাঁর পরিচয়।

সেদিন ৫০ জন বিবস্ত্র নারীকে উদ্ধার করা হয় হলের ভিতর থেকে। কম বয়সী একটি মেয়ে নিজের আঙ্গুল কামড়ে রক্তাক্ত করে সেই রক্তে দেয়ালে লিখেছিলেন “আমি বাঁচতে চাই।” নরপশুরা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি।

আকবর হোসেন এগিয়ে যান হলের পিছনের দিকের ইঁদারার কাছে। সেখানে ইঁদারার ভিতরে পড়ে ছিল অগণিত মানুষের মৃত দেহ। সরে আসলেন তিনি, এগিয়ে গেলেন কৃষি ফার্মের (বর্তমান শিল্প কলা একাডেমী হলের পিছনে চিড়িয়াখানায়) ঝোপ জংগলের দিকে। সেখানেও অজ্ঞাত পরিচয়ের বেশ কয়েক জনের দেহাবশেষ নিয়ে টানা হেঁচড়া করছিল কুকুর-শেয়াল। পুরো কৃষি ফার্মে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল নাম না জানা শহীদদের মাথার খুলী।

এর পরদিন আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে তিনি আবারও যান টাউন হলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গলিত-অর্ধ গলিত-ছিন্ন ভিন্ন দেহাবশেষ গুলো মাটি চাপা দিলেন তাঁরা। ১৯ ডিসেম্বর সেখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন ১৬৭টি মাথার খুলি। পরে মাথার খুলিগুলো টাউন হলের পাশে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরীর ভবনে রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদের একটি কক্ষে স্থাপিত মুক্তি সেনানী সংস্থার অফিসে। অত্যন্ত লজ্জাজনক যে, একদিন সে সব চুড়ি হয়ে গেলো। যা হলে পারতো মুক্তিযুদ্ধের স্মারক।

কালের পরিক্রমায় বন্ধ করে দেওয়া হয় সেই ঐতিহাসিক ইঁদারা। বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনকে জায়গা দেয়া হলো ব্যবহারের জন্য। এখনও সেখানে সংস্কৃতির চর্চা হয়, মহড়া হয় নাটকের। কিন্তু আজকের প্রজন্মের  তরুণরা জানে না তারা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা জানেনা তাদের বিচরণ ক্ষেত্রের মাটির নীচে রয়েছে অসংখ্য নাম না জানা শহীদের দেহাবশেষ। ভরাট করা ইঁদারায় রয়েছে নিরপরাধ মানুষের নর কঙ্কাল।

উৎসাহী সাংস্কৃতিক কর্মীরা টাউন হলের পিছনে অনেক বৃক্ষের চারা রোপণ করেছে। হয়তো একদিন সেখানে ফুলও ফুটবে। কিন্তু সেই ফুলের সুবাস কি আমাদের অন্তরে নাড়া দিতে পারবে? নর কঙ্কালের উপরে বেড়ে ফুল গাছের ফুল কি তার সুবাস ছড়াতে পারবে?

পুরোনো সংবাদ

রংপুর 6240014671544758919

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item