নীলসাগর দিঘির গভীরতা পরিমাপ করলো ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরীদল
https://www.obolokon24.com/2016/09/nilsagor_23.html
বিশেষ প্রতিনিধি ২৩ সেপ্টেম্বর॥
নীলসাগর দিঘি ঘিরে আজ শুক্রবার সকাল হতেই হাজারো মানুষের সমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। এ দিন দিঘি জুড়ে ফায়ার সার্ভিসের একদল ডুবুরি সকাল হতে দুপুর পর্যন্ত দিঘির গভিরতা পরিমাপ করতে নেমেছিল। আর এটি দর্শনে বিভিন্ন এলাকা হতে সমবেত হয়েছিল নারী পুরুষ শিশু সহ হাজারো মানুষজন। এরমধ্যে সনাতন ধর্মের মানুষজনই ছিল বেশী ।নীলসাগর উন্নয়নে সরকারিভাবে স্থানীয় জেলা প্রশাসন দিঘির গভিরতা পরিমাপের এই আয়োজন করেছিল।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) মুজিবুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকারিয়া রহমান, জেলা ত্রান কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাঃ বেলায়েত হোসেন, সহকারি কমিশনার (ভুমি) ফখরুল হাসান, নারী ভাইস চেয়ারম্যান আরিফা সুলতানা লাভলী, সদর উপজেলা প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম, মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াহেদ মন্ডল,ফায়ার সার্ভিস নীলফামারী জেলার উপ পরিচালক সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
রংপুর বিভাগের ফায়ার সার্ভিসের ডুবু দলের ৭ সদস্যের প্রধান আব্দুল মতিন জানালেন এতো বড় দিঘির পানির নিচে যাওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। দিঘি জুড়ে বিভিন্ন দিকে পরিমাপ করে এর গভীরতা পাওয়া গেছে গড়ে ৩০ ফুট। তবে পানির শেষ প্রান্তে পা রাখলেও তা ধরে রাখার সমস্যা হচ্ছিল। কারন দিঘির পানির নিচের শেষ প্রান্তের নিচে পা তলিয়ে যাচ্ছিল। এতে মনে হয় এর গভীরতা আরো রয়েছে। তিনি আরো জানালেন দিঘির পানি এতো স্বচ্ছ হতে পারে তা পানির নিচে গিয়ে এটিও দেখতে পেলাম। নেই কোন ময়লা আবর্জনা। স্বচ্ছ পানির নিচে বিশাল বিশাল মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মতে এক একটি মাছের ওজন ৫ হতে ২৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
ফায়ার সার্ভিসের এই ডুবুরের কথার সঙ্গে প্রমান পাওয়া গেল সৌখিন এক মৎস্য শিকারির ছিপে ধরা পড়লো সাড়ে ১৩ কেজি ওজনের গ্লাসকাপ জাতের মাছ। সেই সাথে ধরা পড়েছে ৫ কেজী ওজানের রুই ও কাতল।
ডুবুরী দলের প্রধান বললেন শুনেছিলাম এই দিঘির নিচে একটি মন্দির রয়েছে। কিন্তু সেই মন্দিরের কোন অস্তিত্ব দেখতে পাইনি। তার ধারনা হয়তো মন্দিরটি আরো নিচে তলিয়ে রয়েছে। ব্যাপক অনুসন্ধ্যান চালালে হয়তো মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া যেতে পারে।
জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন হোসেন বললেন দর্শনার্থী ও মৎস্য শিকারীদের জন্য নীলফামারীর ঐহিত্য প্রাকৃতিক সুন্দরর্য্যরে ধ্রুবতারা নীলসাগর দিঘিকে সরকারিভাবে আরো ঢেলে সাজাতে চেস্টা করা হচ্ছে। শীতকালে অতিথি পাখিদের অভ্যারন্য এই দিঘি সংরক্ষন করা হচ্ছে অতি যতœসহকারে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) মুজিবুর রহমান জানালেন সরকারি ভাবে আরো ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নীলসাগর দিঘি ও অবকাঠমোর সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলা হবে।
উল্লেখ যে,সদর উপজেলার জিরো পয়েন্ট চৌরঙ্গী মোড় থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে ১৪ কিলোমিটার দূরে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজায় ৫৩.৯০ একর জমির ওপর নীলসাগরের অবস্থান। এর জলভাগ ৩২.৭০ একর, এবং চারদিকের পাড়ের জমির পরিমাণ ২১ একর।
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর কোন এক সময়ে এ জলাশয়টির খননকাজ শুরু হয়েছিল। নীল সাগর বরাট দিঘি ও 'বিন্না দিঘি' নামেও পরিচিত। হিন্দুশাস্ত্রমতে, খ্রিস্টপূর্ব নবম হতে অষ্টম শতাব্দীতে পান্ডবরা কৌরবদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হন এবং মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানীর এ স্থানটিতে ছদ্মবেশে বসবাস শুরু করেন। মনে করা হয়, সেসময় নির্বাসিত পান্ডবদের তৃষ্ণা মেটাতে বৈদিক রাজা বিরাট এ দিঘিটি খনন করেছিলেন। বিরাট দিঘির অপভ্রংশ হিসেবে কালক্রমে এ দিঘিটি বিরাট দিঘি, বিন্না দিঘি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কারো কারো মতে, রাজা বিরাট তার বিশাল গরুর পালের জন্য পানির সংস্থান করতেই এ দিঘি খনন করেন এবং তার কন্যা বিন্নাবতীর নামে এর নামকরণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে নীলফামারীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও অবসর প্রাপ্ত সচিব এম.এ জব্বার কর্তৃক এই দিঘিকে পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ও নীলফামারীর নামানুসারে বিন্না দিঘির পরিবর্তে এর নামকরণ করা হয় নীলসাগর।
নীলসাগরের আকর্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই মূলত নীলসাগর বিখ্যাত। এর পাড়ে রয়েছে নারকেল, বনবাবুল, আকাশমণি, মেহগনি, শিশুসহ অজানা-অচেনা হরেকরকম ফুল ও ফলের সারি সারি বৃক্ষরাজি। শীতকালে বিভিন্ন দেশের রাজহাঁস, মার্গেঞ্জার, মাছরাঙা, ভুবনচিল, সবুজ চান্দি ফুটকি, বাচাল নীল ফুটকি ইত্যাদি অতিথি পাখিদের সমাগমও বৃদ্ধি পায়, এছাড়াও পাশেই রয়েছে একটি ছোট পার্ক। ১৯৯৮ সালে এ এলাকাকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। এখানে প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায় বারুণী স্লান উৎসবের আয়োজন করে থাকে। দিঘির পাশেই সরকারের অনুদানে একটি রেস্টহাউজ স্থাপন করা হয়েছে। এখানে নির্ধারিত ভাড়ায় দর্শনার্থীরা রাত্রী যাপন করতে পারেন।