মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় কমিউনিটি ক্লিনিক ;প্রত্যশা ও প্রাপ্তি "


শিরিন আক্তার আশা
-   সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশের তৃনমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক ধারণার প্রবর্তন করেন। তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছরেই দেশের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে তদানীন্তন মহকুমা ও থানা পর্যায়ে স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। জাতির পিতার স্বপ্নকে আরও একধাপ এগিয়ে নেয়ার প্রয়াসে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শুরুতেই প্রতি ৬ হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে দেশব্যাপী মোট ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল।


স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়,   ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল জাতির পিতার জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতী ইউনিয়নে দেশের সর্বপ্রথম ‘গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক’ প্রতিষ্ঠা করে এর শুভ সূচনা এবং ২০০১ সালের মধ্যেই  ১০ হাজার ৭ শত ২৩টি অবকাঠামো স্থাপনপূর্বক প্রায় ৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চালু করতে সমর্থ হয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর আবার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম শুরু করা হয়। নতুন নতুন ভবন নির্মাণের মাধ্যমে গত ১২ বছরে মোট ১৩ হাজার ৮ শত ৮১টি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে বাকি প্রায় ৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করতে অঙ্গিকারবদ্ধ  ।


কমিউনিটি ক্লিনিক সরকার ও জনগণের সম্মিলিত অংশীদারিত্বমূলক একটি কার্যক্রম। গত ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন’ প্রণয়ন করা হয়। এ সকল ক্লিনিক থেকে সারা দেশের প্রান্তিক জনপদ স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও  মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ে প্রাথমিক সেবাসমূহ পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এসকল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে ২৭ প্রকারের ঔষধ ও স্বাস্থ্য-সামগ্রী প্রদান করা হচ্ছে। 


বিভিন্ন সূত্রে জানা,   পূর্বে ৫ শতাংশ জমিতে কমিউনিটি ক্লিনিকের অবকাঠামো নির্মাণ করা হতো, দিন দিন সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বর্তমানে ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৮ শতাংশ জমিতে চার-কক্ষ বিশিষ্ট নতুন নকশার কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছে।  উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেসের মাধ্যমে যানা যায়,   জনগণের স্বাস্থ্য-তথ্য সংগ্রহের জন্য ১০৬টি উপজেলার প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক সংলগ্ন এলাকার জন্য ৫/৭ জন করে মোট ২৪ হাজার মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ার (এমএইচভি) নির্বাচন করা হয়েছে। ৯টি উপজেলার থানা পর্যায়ে স্বাস্থ্য তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিটি নাগরিকের জন্য হেলথ আইডি প্রদান কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।

সরকারের এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্য খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে।স্বাস্থ্যখাতে সরকার সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ এমডিজি পুরস্কার, সাউথ- এশিয়া  পুরস্কার ও গ্যাভি পুরস্কার এবং ভ্যাক্সিন হিরো পুরস্কারের মত অনেক সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে। যা বৈবিশ্বে  দেশের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল করতে সামর্থ  হয়েছে। দেশের গ্রামীন জনপদে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে গেলেও চোখে পড়বে এসব দৃশ্যমান  কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রায় একই নকশায় তৈরি  ক্লিনিক। 

অন্তত মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, সাধারণ অসুখ-বিসুখে দোরগোড়ায় সহজেই প্রাথমিক সেবাটুকু পাওয়া যায় কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে। একজন কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রভাইডার বা সিএইচসিপি এই কমিউনিটি ক্লিনিকের মূল দায়িত্ব পালন করে থাকেন সপ্তাহের ছয় দিন সকাল ৯ থেকে ৩ টা পর্যন্ত। প্রথমে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকল্পটি পরিচালনা করা হলেও ২০১৮ সালের নতুন আইনের মাধ্যমে এই কমিউনিটি ক্লিনিক এখন চলছে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের আওতায়। শুরুতে কমিউনিটি ক্লিনিকে ডেলিভারির ব্যবস্থা না থাকলেও পরবর্তী সময়ে ঘরের কাছে সহজে সন্তান প্রসবের নিরাপদ স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।


মণিভূষণ চক্রবর্তী  এসিস্ট্যান্ট হেলথ ইন্সপেক্টর( AHI)   জলঢাকা।তিনি বলেন  উত্তরের জনপদ নীলফামারীতেও আশার আলো জাগিয়ে তুলেছে কমিউনিটি ক্লিনিক ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা। 

কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রতিদিন চার লাখের বেশি মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও পুষ্টিসেবা পায়। প্রয়োজনীয় ২৭ ধরনের ওষুধ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মানুষ বিনা মূল্যে পাচ্ছে। এক কথায় গ্রামের মানুষের ঘরের দোরগোড়ায় পরম বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্লিনিকগুলো।


 তিনি আরও বলেন  জলঢাকা উপজেলা   ১১ ইউনিয়ন  সহ পৌরসভায়  ৪৩ কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রাম পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্বাস্থ্য সহকারীরা তাঁদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা প্রদান করছেন।তারে ধারাবাহিকতায়   উপজেলা শিমুলবাড়ী ইউনিয়ন ঘুঘুমারী কমিউনিটি ক্লিনিকে তৃণমূল পর্যায়ে দরিদ্র মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছেন  কর্মরত (সিএইচসিপি) সাহাবুল আলম।তিনি বলেন, আমার ক্লিনিকে মাতৃ স্বাস্থ্য সুরক্ষা  নিশ্চিত করতে আমি নিজের টাকা ব্যয় করে একজন নারী স্বাস্থ্য আপাকে নিয়ে এসে গর্ভবতী মায়েদের চেকাপ করা, নিরাপদ প্রসব বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া এবং প্রসব যাতে বাড়ীতে না করাই, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র নিয়ে যায়।  আমার ক্লিনিক এর ব্যবস্থা না থাকায়  প্রতি মাসেই ডেলিভারির জন্যে আমি প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং সচেতনতা সৃষ্টির ফলে গ্রামের কেউ আর বাড়িতে সন্তান প্রসব করান না। প্রসব বেদনা শুরু হলেই ক্লিনিকে নিয়ে আসেন গর্ভবতী মায়েকে  নিরাপদ  ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার  পরিকল্পনা কেন্দ্র নিয়ে যাওয়ার জন্য  পরামর্শ দিয়ে থাকি।বর্তমান  নীলফামারী জেলায় ছয়টি উপজেলায় কমিউনিটি ক্লিনিক-১৯৫ টি। 

  এখন স্বাস্থ্য নিয়ে কেউ ঝুঁকির মধ্যে থাকতে চান না। গ্রামীণ জনগণের অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সেবা বিতরণে প্রথম স্তর হিসেবে নীলফামারীর কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো যেন আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ব্যাপক সারা ফেলেছে নিরাপদ প্রসব কেন্দ্র হিসেবেও। প্রয়োজনীয় পরামর্শ, চেকআপ করাসহ প্রতি মাসে মাসে গিয়ে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) সহযোগিতা নিচ্ছেন গ্রামীণ জনপথের গর্ভবতী মায়েরা।


দেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম আলোচিত বিষয় ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্প বা কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প। জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছে "স্বাস্থ্য মানুষের অমূল্য সম্পদ"। প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী উদ্যোগ কমিউনিটি ক্লিনিক। নীলফামারী সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায়, জেলার ১৯৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ১৬টি নিরাপদ প্রসব কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদান, প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে সিএইচসিপিদের।  জলঢাকা উপজেলা খুটামারা ইউনিয়নের  হরিচন্দ্রপাঠ ক্লিনিকের সিএইচসিপি খাদিজাতুল কোবরা জেমি জানান, আমার এখানে প্রতি মাসে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচজন করে গর্ভবতী মায়ের সন্তান প্রসব করে থাকি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে এখানে এ কর্মসূচী শুরু হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণের ফলে দক্ষতার সঙ্গে মায়েদের সেবা কার্যক্রম দেয়া হয়। তিনি আরো বলেন, গর্ভবতী মায়েদের খোঁজ খবর রাখার জন্য মোবাইল ফোন নম্বর খাতায় লিখে রাখা হয়েছে। কোন মাসে যদি না আসেন তাহলে ফোন করে খোঁজ খবর  নেই।


পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা মিমি বেগম জানান, আমি প্রতি মাসে মাসে ক্লিনিকে গিয়ে আপার সঙ্গে পরামর্শ নিয়ে আসি। চেকআপ করা, খাদ্যগ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন আপা।  গর্ভবতী হওয়ার পর থেকেই আমি ক্লিনিকে নিয়মিত যাতায়াত করে সেবা গ্রহণ করি। এবং  আমার সন্তান প্রসব হয় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনার কেন্দ্র । এখন আমি ও আমার সন্তান ভাল রয়েছে।


শিমুলবাড়ী ইউনিয়ন ঘুঘুমারী কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিবার পরিকল্পনা( FWA) খাদিজা আক্তার সুমি আপার কাছে মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন গ্রামীণ নারীদের প্রলম্বিত প্রসববেদনা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কারণে বিষয়টির প্রতি আমার সত্যিকার একটা দায়বদ্ধতা জন্মেছে। এটা কেবল আমার পেশাগত নিষ্ঠা নয়। কারণ আমি জানি, প্রসবকালে নারীদের দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা এবং যত্ন পাওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার অন্তসন্তাকালে ও প্রসবকালে যথাযথ সেবা পেয়েছি এবং এটা সব নারীরই পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাই আমাদের এমন এক ব্যবস্থা তৈরি রাখতে হবে, যা প্রত্যেক নারীরই যত্ন নেবে। শুভ সংবাদ যে বাংলাদেশ প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে আনতে পেরেছে। কিন্তু এখনো অনেক নারীর মৃত্যু দুঃসংবাদই বটে। যে সময়টায়    আপনার সাথে  কথা বলতেছি, ততক্ষণে বাংলাদেশে অন্তত আরও দুজন নারী প্রসবের সময় মারা যাবেন। আমরা কি বছরে সাত হাজারেরও বেশি মায়ের মৃত্যু বন্ধ করতে পারছি? অথচ এই মৃত্যুর ৯০ শতাংশই ঠেকানো যেত। এই মৃত্যু ঠেকানোর কর্মসূচিই আসল কর্মসূচি।

 তিনি আরও বলেন প্রসূতি নারীরা যেসব রোগে মারা যান, সেগুলোর চিকিৎসা আমরা করতে পারি না, তা নয়। তাঁরা মারা যায়, কারণ তাঁদের জন্য আমরা নিয়মিত সেবা ও পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারিনি বা তা করাকে আমাদের প্রধান অগ্রাধিকারে পরিণত করিনি। যতক্ষণ না আমরা মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিনিয়োগ করছি, মাতৃস্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিককে গুরুত্বপূর্ণ করে ভাবছি, ততক্ষণ পর্যন্ত এ সমস্যা টিকেই থাকবে। মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেহেতু প্রতিটি গর্ভই ঝুঁকিপূর্ণ, তাই নারীরা যত কম সন্তান নেবেন, প্রসূতি অবস্থায় তত কম মারা যাবেন। তাই নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে তাঁরা নিরাপদে সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। এটাই আজকের মূল বার্তা।


একটি  নিউজ    ড. হাসিনা বেগম একটা পরিসংখ্যান অনুযায়ী  বলেন বাংলাদেশে মাতৃস্বাস্থ্যের বাস্তব অবস্থা, অর্জন, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ করণীয়ের ওপর আলোকপাত করব। গত নয় বছরে মাতৃমৃত্যুর হার (এমএমআর) কমেছে ৪০ শতাংশ। মৃত্যুঝুঁকিও প্রতি ৫০০ জনে একজনে নেমে এসেছে।১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম কমিউনিটি ক্লিনিক বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করাহয়।


  জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (রিপোর্ট) জরিপে দেখা যায়, বাড়ির পাশের ক্লিনিক থেকে বিনা মূল্যে ওষুধ ও পরামর্শ পেয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) জরিপ বলছে, সেবা নিয়ে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট থাকলেও জলঢাকা উপজেলা কিছু কমিউনিটি ক্লিনিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে।এই কমিউনিটি ক্লিনিক গুলো রাস্তার পাশে, যেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা সেবা নিতে আসচ্ছে।এসব ভবনগুলোর অবস্থান বেশিরভাগই রাস্তার পাশে বা খোলা মাঠে। এছাড়াও ক্লিনিকগুলোতে নেই কোন নাইটগার্ডের ব্যবস্থা। সোমবার সরেজমিনে পৌরসভাধীন দুন্দিবাড়ী কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়- রাস্তার পাশে কমিউনিটি ক্লিনিকের অবস্থান। ঝুঁকি নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসে এরমধ্যে বেশিরভাগই গর্ভবর্তী নারী ও শিশু। কথা হয় ওই ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আইরিন আক্তার। তিনি জানান, দীর্ঘদিনের পুরাতন ভবনে ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। বর্ষাকালে ভবনের ছাদ বেয়ে মেঝেতে পানি জমে। সেসময় স্বাস্থ্যসেবা দিতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়।


সেবাসমুহঃপ্রাপ্তি

সরকারি হিসাবে সারা দেশে ১৩ হাজার ৮৮১টি ক্লিনিক চালু অবস্থায় আছে। এসব ক্লিনিক থেকে দৈনিক গড়ে ৩০ জন মানুষ সেবা নেয়। আরও ১৪৬টি ক্লিনিক চালুর অপেক্ষায় আছে। ক্লিনিক থেকে: মা, নবজাতক ও অসুস্থ শিশুর সমন্বিত সেবা (আইএমসিআই), প্রজননস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা এবং সাধারণ আঘাতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রতিটি ক্লিনিকে শিশু ও মায়েদের টিকাদানের ব্যবস্থা আছে। ক্লিনিকে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগ শনাক্ত করা হয়। মাতৃস্বাস্থ্য  সুরক্ষা,  স্বাস্থ্যশিক্ষার পাশাপাশি দেওয়া হয় পুষ্টিশিক্ষা। বয়স্ক, কিশোর–কিশোরী ও প্রতিবন্ধীদের লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্লিনিক থেকে ২৭ ধরনের ওষুধ ছাড়াও শিশুদের অণুপুষ্টিকণার প্যাকেট দেওয়া হয়।


আমরা জানি রাষ্ট্রের কাছে জনগণের অন্যতম মৌলিক চাহিদার একটি হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। আর স্বাস্থ্য মানবসম্পদ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। সংবিধানের ১৫(ক) এবং ১৮(১)- অনুচ্ছেদে চিকিৎসাসেবা এবং জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আর মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে করোনাভাইরাস রোগ ২০২০ (কোভিড-১৯) ছড়িয়ে পড়ার কারনে সাধারন স্বাস্থ্যসেবায় বড় ধরনের সংকট সৃস্টি করেছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস রোগের মহামারী বলতে বাংলাদেশে এটির প্রাদুর্ভাব ও দ্রুত বিস্তারে চলমান ঘটনাটিকে নির্দেশ করে, যা বর্তমানে চলমান বিশ্বজুড়ে মহামারীর একটি অংশ।

করোনাভাইরাস রোগ ২০২০ (কোভিড-১৯) নামক একটি রোগ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কারণে এই বৈশ্বিক মহামারীটির সৃষ্টি হয়েছে। গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলণ সমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস ২ (সার্স-কোভ-২) নামক সংক্রামক ধরনের একটি জীবাণুই প্রকৃতপক্ষে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়ে মানবদেহে এই রোগটি সৃষ্টি করে।

প্রাণঘাতী করোনা যুদ্ধেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নীলফামারীর তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা দিতে গিয়ে অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এরপরেও দেখা গেছে সাধারন রোগের চিকিৎসায় স্বাস্থকর্মীরা চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে। নীলফামারী সিভিল সার্জন অফিস সুত্র মতে, করোনাকালিন স্বাস্থ্য সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসক সহ ১৬ করোনা আক্রান্ত হয়।

প্রত্যশাঃ সাধারণ মানুষের- 

*  সব স্তরে মাতৃস্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে হবে

*  হাসপাতালে ল্যাব সুবিধা ও ওষুধপত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

*  প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ সৃষ্টি ও তাঁদের সেবা প্রদানের সুযোগ করে দিতে হবে।

*  বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি কর্মসূচির সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন।

*  গর্ভবতী মায়ের রেজিস্ট্রেশন, গর্ভকালীন সেবা ও ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।

*  যথাসময়ে হাসপাতালে উপস্থিত করতে গর্ভবতী মাকে বিনা মূল্যে অ্যাম্বুলেন্স–সেবা দিতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ১৭৬ জন মারা যান। ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ৭০ বা তার নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।

কারা সেবা নেয়

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সব স্তরের মানুষ ক্লিনিক থেকে সেবা নেয়। তবে সেবা গ্রহণকারীদের ৪৮ শতাংশ দরিদ্র বা অতিদরিদ্র। সেবাগ্রহীতাদের ৭৭ শতাংশ নারী। সব বয়সী মানুষই ক্লিনিকে আসে। বেশি আসে ৩০ থেকে ৫৯ বছর বয়সী নারী ও পুরুষ। এঁরা প্রায় ৪২ শতাংশ। ৬০ বছরের বেশি রোগী ১৭ শতাংশ

সেবা পরিস্থিতি

  সাধারণ জনগণ বলেন   ঘুঘুমারী কমিউনিটি ক্লিনিকের  কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)  সাহাবুল আলম হচ্ছেন মূল ব্যক্তি। সপ্তাহে ছয় দিন তাঁর ক্লিনিকে বসেন। তাঁকে সহায়তা করেন মাঠপর্যায়ের একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও মাঠ পর্যায়ের একজন পরিবারকল্যাণ সহকারী। এঁদের সপ্তাহে তিন দিন করে ক্লিনিকে বসার কথা। কিন্তু জলঢাকা উপজেলা কিছু কিছু কমিউনিটি ক্লিনিক  এঁরা সপ্তাহের ঠিক কোন দিন বসেন, তা মানুষের জানা নেই। 

 একটি বিষেষ প্রতিবেদন বলছে, ১০ শতাংশ হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের পদ খালি পড়ে আছে। অর্থাৎ সারা দেশে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কমিউনিটি ক্লিনিক চলছে মূল ব্যক্তি ছাড়াই। অনেক জায়গায় স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারীর পদও খালি আছে। এত পদ খালি থাকার কারণে অনেক ক্লিনিক থেকে মানুষ ধারাবাহিকভাবে সেবা পায় না। এতে করে সাধারণ মানুষের সেবায় বাধাগস্ত হচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করেন।এসডিসি-২০৩০ অর্জনে এই ক্লিনিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

সুশীল সমাজ কি মনে করছেনঃ-

চলমান করোনা ভাইরাস কালিন সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোর স্বাস্থ্য সেবা অব্যাহত রাখাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

 নীলফামারী জেলার জলঢাকা শিমুলবাড়ী ইউনিয় আওয়ামীলীগ সহ সভাপতি প্রতাপ অধিকারী বলেন,   প্রথম দিকে জেলার স্বাস্থ্য সেবা বেশ ঝিমিয়ে পড়েছিল। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল আতংক। সেই আতংক এখনও রয়ে গেছে। এরপরেও এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি হাসপাতালগুলোর চেয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গ্রামে গ্রামে ভাল সেবা প্রদান করছে।

এ বিষয়ে ঘুঘুমারী সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের কমিটি সভাপতি জি এম কামরুল হাসান শামীম সাথে কথা বললে তিনি জানান, মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯ (কোভিড-১৯) ছড়িয়ে পড়ার কারনে সাধারন স্বাস্থ্যসেবায় বড় ধরনের সংকট সৃস্টি করেছে। এরপরেও নীলফামারী জেলায় সরকারী হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সেবা প্রদান করছে। এটি একটি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ভাল দিক। তিনি আরো জানান, সরকারী চিকিৎসা যতখানি চলছে তার বিন্দুমাত্র সেই সেবা দিতে পারছেনা (বর্তমান সময়) বেসরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো।


সাধারন মানুষ কতটুকু সেবা পাচ্ছেঃ-


কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে গর্ভবতী মা,কিশোরীদের শারীরিক সমস্যা সহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা প্রদান চলছে। তবে চিকিৎসা সেবায় সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা হয়েছে। বিশেষ করে জলঢাকা উপজেলার  শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের স্বাস্থ্য সেবা কিছুটা ভাটা পড়েছে। সেখানে করোনা পজেটিভ রোগীর সংখ্যা ৪ জন। এরমধ্যে সেখানে  এক জন মৃত্যু বরন করেছেন। ফলে ওই এলাকাটির মানুষজন নিজেরাই সচেতনা সৃস্টি করে সাবধানতা অবলম্বন করে বসবাস করছেন বলে জানালেন সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান হামিদুল হক।

জলঢাকা উপজেলা   শিমুলবাড়ী ইউনিয়ন বাশদাহ্ কমিউনিটি ক্লিনিকে চলমান করোনাকালিন ০৯ দিনের নবজাতক শিশু কোলে নিয়ে এসেছিলেন মা রুজিনা বেগম। তিনি জানান, দুইদিন ধরে মেয়ের পাতলা পায়খানা ও জ্বর। তাই সন্তানকে নিয়ে ক্লিনিকে আসলাম। ডাক্তার দেখালাম। তিনি কিছু ঔষধ দিয়েছেন। তবে আগের মতো যত্ন করে দেখেননা। ডাক্তারের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে বলতে হয় রোগের সমস্যা। তারপরেও পরামর্শ ও ঔষধ দিচ্ছে এটাই বড় কথা।

ধর্মপাল  ইউনিয়নের কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা গৃহবধু আফরোজা, শিরিনা ও বিথি জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক না থাকলে স্বাস্থ্যসেবা পেতে তাদের অনেক দূরে যেতে হত, যাতে সময় ও অর্থ ব্যয় হত এবং দুর্ভোগও বাড়তো। এখন হাসপাতালে যেতে হয়না। করোনাকালে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে জ্বর, সর্দি, কাশি, আমাশয়, কাটা, পোড়া, গ্যাষ্টিক, এলার্জী, ওজন মাপা, প্রেসার মাপা ইত্যাদি স্বাস্থ্য সমস্যার সেবা পেয়েছি।

কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার  মনিরুজ্জামান বলেন, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা শিশু ও গর্ভবতীসহ নানা ধরনের রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সাধারণ মৌসুমি জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যাথা, পেট ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, বমি ও পাতলা পায়খানা এ ধরণের সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসেন আমাদের কাছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তাদের সেবা দেওয়ার।

জলঢাকা কৌমারী রতবাজার  কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) নিরান্জন রায়  সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলা হলে তিনি জানান, করোনার সংক্রমণ রোধে কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীরা সার্বক্ষনিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। শরীর খারাপ লাগলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নির্দেশাবলী মেনে চলতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। করোনাকালে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে আগের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।

 জলঢাকা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকতা ডাঃ রেজারুল করিম বলেন  আগের তুলনায় মাতৃত্বকালীন সেবার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এর চেয়ে অধিক প্রত্যাশা করা হয়। দেশের জন্য এটা ভালো লক্ষণ যে অনেকে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করা শুরু করেছেন।

 তবে   জলঢাকায় জনপ্রনিধিরা বলেন  কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো রক্ষণাবেক্ষন ও সংস্কারের অভাবে স্বাস্থ্যসেবা অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় কমিউনিটি ক্লিনিকের ভবনগুলো ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহাবুব হাসান বলেন প্রতি বছরে  এল জি এস পি যে বরাদ্দ দেওয়া হয় সেটা দিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক গুলো সংস্কারের ব্যবস্থা করা যাবে। 

পুরোনো সংবাদ

স্বাস্থ্য-চিকিৎসা 5087198757836791780

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item