পাটপণ্য উৎপাদনে ভাগ্য বদলেছে সৈয়দপুরের রাজিয়ার
খুরশিদ জামান কাকনঃ উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স। সংক্ষেপে 'উই' নামেই বেশি পরিচিত। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের নারী উদ্দ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় অনলাইন প্লাটফর্ম। নারীদের অার্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করাই এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য। উইয়ের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে সারাদেশে এখন অনেক নারীই উদ্দ্যোক্তা হিসেবে সফলতা পেয়েছেন।সামাজিকভাবেও কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তেমনি একজন রাজিয়া সুলতানা। যিনি উইয়ের মাধ্যমে অল্প কিছুদিনের প্রচেষ্টায় উদ্দ্যোক্তা হিসেবে আলোর মুখ দেখেছেন।
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার নিয়ামতপুর মুন্সিপাড়ার গৃহবধূ রাজিয়া সুলতানা। স্বামী মালেকুজ্জামান পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তাদের দুই ছেলে-মেয়ে। রাজিয়ার দ্বীর্ঘদিনের ইচ্ছে ঘরসংসার সামলানোর পাশাপাশি কিছু করবেন। অল্পকিছু হলেও উপার্জনক্ষম কাজের সাথে যুক্ত থাকবেন। কিন্তু কিভাবে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একদিন তার ফেসবুকের এক বন্ধু তাকে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স গ্রুপে যুক্ত করেন। এই গ্রুপে সফল নারী উদ্দ্যোক্তাদের পোষ্টে রাজিয়া অনুপ্রেরণা খুজে পান৷ অন্যদের দেখে তার নিজের মধ্যেও উদ্দ্যোক্তা হওয়ার তাগিদ জন্মায়।
ধীরেধীরে রাজিয়া হস্তশিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। বেছে নেন পাটজাত পণ্যের উৎপাদন। একে একে পাট দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরি করা শিখতে শুরু করেন। কখনো ইউটিউব দেখে দেখে কখনোবা অভিজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে বিভিন্ন পাটজাত পন্য তৈরি করার চেষ্টা করেন। পরে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে পাটজাত পন্য উৎপাদনের কাজ পুরোপুরি আয়ত্ব করে ফেলেন। এরপরই শুরু হয় উদ্দ্যোক্তা হিসেবে রাজিয়া সুলতানার পথচলা।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে মাত্র পাচ হাজার টাকা পুজি দিয়ে রাজিয়া শুরু করেন পাটের পণ্য উৎপাদনের কাজ। এসময় তিনি বেচাকেনার সুবিধার্থে 'নান্দনিক ক্রাফট' নামে ফেসবুকে একটি পেজ খুলেন। প্রথমদিকে রাজিয়া শুধু পাটের ব্যাগ ও শিকা তৈরি করতেন। নিজের ফেসবুক পেজ ও উইয়ের অফিসিয়াল গ্রুপে পণ্যের প্রচারণা চালাতেন। ধীরেধীরে এভাবেই রাজিয়ার নান্দনিক ক্রাফট গ্রাহক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে।
সময়ের সাথে রাজিয়া জোর দেন নান্দনিক ক্রাফটে। যুক্ত করতে থাকেন নিত্যনতুন পণ্যসামগ্রী। বৈচিত্র্য আনেন কাজে। বর্তমানে নান্দনিক ক্রাফটের পাটপণ্যের মধ্যে রয়েছে ব্যাগ, পার্স, শোপিস, শিকা, টেবিল ম্যাট, মানিব্যাগ ও দোলনা। ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনে আরো আছে পাটের তৈরি রুম ডেকোরেট মিরর, ওয়ালমেট, ড্রিমক্যাচার, ম্যাগাজিন হোল্ডার, ফোন চার্জিং হোল্ডার সহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি। এসবের পাশাপাশি রাজিয়ার উল সুতার কারুকাজেরও প্রচুর চাহিদা অনলাইন মার্কেটে।
প্রথমদিকে নান্দনিক ক্রাফটের সকল কাজ রাজিয়া একহাতে সামলাতেন। তাকে টুকটাক সহযোগিতা করতেন তার স্বামী। ধীরেধীরে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় তিনি দুইজন নারীকে নিয়োগ দিয়েছেন। তাদেরকে তিনি নিজ হাতে কাজ শিখাচ্ছেন। সেই সাথে তাদের আয়ের পথও সুগম করেছেন। অল্প পুজি দিয়ে শুরু করা রাজিয়ার ব্যবসা এখন লাখ টাকার উপরে। বর্তমানে তার মাসিক আয় প্রায় ২০,০০০ টাকা। স্বামীর উপার্জনের পাশাপাশি রাজিয়ার এই বাড়তি আয় তার পারিবারিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সৈয়দপুরের নারী উদ্দ্যোক্তা হিসেবে সফল রাজিয়া সুলতানা শুধু অনলাইনে থেমে থাকেননি। ব্যবসার পরিধি বাড়াতে স্বামীর সহযোগিতায় সম্প্রতি গড়ে তুলেছেন নান্দনিক ক্রাফটের নিজস্ব শো-রুম। বর্তমানে তার শো-রুমে শোভা পাচ্ছে পাটের তৈরি বৈচিত্রপূর্ণ সব পণ্য। নিত্যদিনই শৌখিনপ্রিয় মানুষের অনেকেই তার শো-রুমে ভিড় জমাচ্ছেন। ক্রয় করছেন দেশীয় সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত থাকা পাটপণ্য।
উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স থেকে অনুপ্রাণিত উদ্দ্যোক্তা রাজিয়া সুলতানা জানান, 'উদ্দ্যোক্তা হিসেবে আমার পথচলার শুরুটা উইয়ের মাধ্যমে। ব্যবসার সূচনালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত যতো অর্ডার পেয়েছি তার বেশিরভাগই উইয়ের গ্রুপের কল্যাণে। গ্রুপে প্রতিদিনই আমার পাটপণ্যের ছবিসহ বর্ননা দিয়ে পোষ্ট করি। একারণে উইয়ের গ্রুপে এখন যেমন কিছুটা পরিচিতি পাচ্ছি। সেই সাথে ব্যবসাটাকেও বড় করতে পারছি।'
নান্দনিক ক্রাফটের স্বত্বাধিকারী রাজিয়া সুলতানা আরো জানান, 'পাটজাত পণ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পাটের উপর অন্যরকম একটা ভালোলাগা জন্মেছে। ভবিষ্যতে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আমাদের উৎপাদিত পাটপণ্য বিদেশের বাজারে রপ্তানি করতে চাই। এজন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।'