উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার অপতৎপরতা এখনও অব্যাহত: প্রধানমন্ত্রী

 


অনলাইন ডেস্ক




স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী এই শুভেচ্ছা জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। এবার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। আমরা উদযাপন করছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। একইসঙ্গে উদযাপিত হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি- তিনি আমাদের এই সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের তৌফিক দান করেছেন।


 তিনি বলেন, এই শুভ দিন উপলক্ষে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আমি দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে বসবাসকারী বাংলাদেশের সব নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছি সেইসব বন্ধু রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিকে যারা আমাদের চরম দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫-পরবর্তী অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী অগণতান্ত্রিক শাসকেরা বাংলাদেশকে আদর্শচ্যুত করেছে। দীর্ঘ একুশ বছর এ দেশের মানুষকে ধোকা দিয়েছে তাঁরা। জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে তাঁদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে। বাংলাদেশকে ভিক্ষুকের দেশ হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিত করেছে। দীর্ঘদিন পরে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে দেশকে আবার উন্নয়নের পথে নিয়ে গেছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ২৪ বছরের নিরন্তর রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। আর এই সংগ্রামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলনে যে স্বাধিকারের বীজ বপন করেছিলেন, তাকেই লালন-পালন করে তিনি স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পরিণত মহিরূহে রূপান্তরিত করেন। শেখ মুজিব থেকে পরিণত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮’র আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন, ৬৬’র ঐতিহাসিক ৬-দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন এবং ৭১’র রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পাই স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নামের সেই মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। তাঁর জন্ম হয়েছিল বলেই আজ আমরা নিজস্ব দেশ, ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ করি।’

‘শেখ মুজিব একটি দেশ, একটি জাতি-রাষ্ট্রের স্রষ্টা’ উল্লেখ করে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী তথা জাতীয় জীবনের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক উদযাপনকালে স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার সুযোগ দেওয়ায় দেশের মানুষকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। 

সরকার প্রধান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ডেরই স্বপ্ন দেখেননি, তিনি স্বপ্ন দেখতেন এ জনপদের সাধারণ মানুষ যাঁরা শত শত বছর ধরে শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, না-খেয়ে না-দেয়ে, রোগে-শোকে মারা গেছেন, তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার। তাঁদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসার ব্যবস্থা করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করার। এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালে ২৮ জুন সিলেটে এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি করে তিনি বলেন, ‘‘... প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হবার জন্য আমি রাজনীতি করি নাই। আমি রাজনীতি করেছিলাম সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির জন্য। এখন আমার রাজনীতির মুক্তি হয়েছে। আমার অর্থনীতির মুক্তি প্রয়োজন। এইটা না হলে স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে। যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়, যদি বাংলার মানুষ সুখে বাস না করে, বাংলার মানুষ যদি অত্যাচার, অবিচারের হাত থেকে বাঁচতে না পারে তো এই স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে।”’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু স্বপ্ন দেখতেন না, কী করে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হয় তা তিনি জানতেন। স্বাধীনতার পর একেবারে শূন্য হাতে মাত্র সাড়ে তিন বছরে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, রেললাইন, পোর্ট সচল করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেন। ১২৬টি দেশের স্বীকৃতি ও ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে তিনি স্বল্পোন্নত দেশের কাতারভুক্ত করেন। কিন্তু তাকে সাড়ে তিন বছরের মাথায় সপরিবারে হত্যা করা হয়। থেমে যায় দেশের উন্নয়ন। হারাতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এক দশক আগেও বাংলাদেশকে যেখানে দারিদ্র্য আর অনুন্নয়নের উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো, আজ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা সেই বাংলাদেশকেই দারিদ্র্য-জয় এবং উন্নয়নের আদর্শ মডেল হিসেবে তুলে ধরছেন।’ তিনি ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কয়েকটি সূচকের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘২০০৫-০৬ বছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার। বর্তমানে যা ২০৬৪ ডলার। ওই সময়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ শতাংশ। জিডিপি’র আকার ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ০.৭৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ এক বিলিয়ন ডলারের কম; যা বর্তমানে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।’

‘২০০৫-০৬ বছরে বাজেটের আকার ছিল ৬১ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান অর্থবছরের আমাদের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। মানুষের গড় আয়ু ২০০৫-০৬ বছরের ৫৯ বছর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯-২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৭২.৬ বছর। শিশু মৃত্যুহার হার কমে প্রতি হাজারে ৮৪ থেকে ২৮ এবং মাতৃমৃত্যু হার প্রতি লাখে ৩৭০ থেকে ১৬৫ জনে দাঁড়িয়েছে।

‘ওই সময় সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৭৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি। দানাদার শস্যের উৎপাদন ২০০৫-০৬ বছরের এক কোট ৮০ লাখ মে. টন থকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৪৯০০ মেগাওয়াট থেকে ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।’—যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘আজকের এই অর্জন এ দেশের সাধারণ মানুষের। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-পেশাজীবী, প্রবাসী ভাইবোনেরা, উদ্যোক্তাগণ—তাঁদের শ্রম, মেধা এবং উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে দারিদ্র্য নিরাময়ের অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে তুলেছেন। আমার সরকার শুধু নীতি সহায়তা দিয়ে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। আপনারা প্রমাণ করেছেন, বাংলাদেশের মানুষ অনুকূল পরিবেশ পেলে যেকোনও অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘বিগত ১২ বছরে তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। গত মাসে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। গড় আয়ু, লিঙ্গ সমতা, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, নারীর রাজনৈতিক অধিকার, নারী ও শিশু মৃত্যুহার, স্যানিটেশন, খাদ্য প্রাপ্যতা ইত্যাদি নানা সূচকে বাংলাদেশ শুধু তার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে যায়নি, অনেক ক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে।’

আজকের এই উত্তরণের পথ মোটেই মসৃন ছিল না বলে মন্তব্য করেন সরকার প্রধান। তিনি বলেন, ‘দেশের ভিতরে-বাইরে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে নানা অপতৎপরতা চালিয়েছে। সে প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত আছে। কাজেই আমাদের সবাইকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশবিরোধী সকল অপতৎপরতা রুখে দিতে হবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা। মুক্তিযোদ্ধাদের একটাই প্রত্যাশা ছিল—এ দেশ স্বাধীন হবে। এ দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। সবাই মৌলিক অধিকার ভোগ করবে। আজকে আমরা তাঁদের সেই প্রত্যাশা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছি। সুবর্ণজয়ন্তীর এই শুভক্ষণে আমাদের শপথ নিতে হবে কেউ যেন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। দেশের গণতান্ত্রিক এবং উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে না পারে। আসুন, সবাই ভেদাভেদ ভুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলি। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। তবে এই উদযাপন যেন শুধু আনুষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব না হয়। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে আমাদের দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার নতুন করে শপথ নিতে হবে।

পুরোনো সংবাদ

প্রধান খবর 3303362889480022445

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item