দাদন সম্রাজ্ঞী নাজমার মামলার ফাঁদে নাজেহাল পার্বতীপুরের শতাধিক শিক্ষক
https://www.obolokon24.com/2020/07/d_9.html
দিনাজপুরের পার্বতীপুরে দাদন সম্রাজ্ঞী বলে পরিচিত এক প্রভাবশালী নারী দাদন ব্যবসায়ী নাজমার প্রতারনার ফাঁদে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছেন উপজেলার বিভিন্ন বে-সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতাধিক নিরীহ শিক্ষক-কর্মচারী। ঋণ দেয়ার নামে স্বাক্ষরযুক্ত ফাঁকা চেক বই, ষ্ট্যাম্প ও জমির দলিল জমা নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ইচ্ছেমত দেয় ঋণের ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি অংকের টাকা লিখে ভূক্তিভোগিদের নামে হয়রানি মূলক চেক জালিয়াতির মামলা দায়ের ও উকিল নোটিশ প্রদান করা হচ্ছে। এভাবে অনেক শিক্ষক-কর্মচারীকে দাবীকৃত টাকার পরিবর্তে জমি লিখে দিতে বাধ্য করা হয়েছে বলে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অভিযোগ। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ধরে চলে আসা পার্বতীপুরের কুখ্যাত দাদন ব্যবসায়ী নাজমা বেগম এসব বেআইনি কাজের ঘাটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে পার্বতীপুর উপজেলার সোনালী ব্যাংক, হুগলীপাড়া শাখা। এ শাখায় কর্মরত এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য ও কতিপয় ভাড়াটে ব্যক্তি তার এই অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করে আসছে। এ কাজে তাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করছে তার বড় ছেলে মো: নাবির শাহ নয়ন। সে ২০১২ সাল থেকে সোনালী ব্যাংক হুগলীপাড়া শাখায় চৌকিদার পদে কর্মরত রয়েছে। নিরাপত্তা কর্মী সরবরাহকারী আউটসোর্সিং কোম্পানী ফাইভ স্টার লিমিটেডের মাধ্যমে সে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে এ ব্যাংক শাখায় চাকুরীতে যোগাদান করে। সে-ই এই ব্যাংক শাখায় একাউন্ট ধারী শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যাংক হিসাবের খুঁটি নাটি তথ্য তার মা নাজমা খাতুনকে সরবরাহ করে থাকে। আর এসব তথ্য ব্যবহার করে তার মা নাজমা খাতুন ফাঁকা চেকে ইচ্ছেমত টাকার অংক বসিয়ে ভাড়াটে ব্যক্তিদের নামে চেক ইস্যু করে। তারা ঋণগ্রহীতা শিক্ষক-কর্মচারীদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলতে গিয়ে চাহিদামত অর্থ জমা না থাকার অজুহাতে চেক ডিজঅনার হয়। এভাবে চেক ডিজঅনারের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভূক্তভোগি শিক্ষক-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রথমে উকিল নোটিশ, পরে চেক জালিয়াতির মামলা করা হয়।
২০১৯ সালে ৫ নভেম্বর নাজমা খাতুন খোড়াখাই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক মো: হারুনুর রশিদ স্বাক্ষরিত একটি ফাঁকা চেক তার ঘনিষ্ট সহযোগি আমেজুল হক মন্ডলের নামে সাড়ে ৪ লাখ টাকার চেক ইস্যু করে। চেক (নং-৩৬২৭৪৬৯) টি ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংক, হুগলীপাড়া শাখায় জমা করা হলে সেটি ডিজঅনার হয়। এ অজুহাতে ওই ১১ ডিসেম্বর স্কুল শিক্ষক হারুনুর রশিদকে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। ওই সময় সোনালী ব্যাংক হুগলীপাড়া শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন মো: মোকাদ্দেস হোসেন।
মো: হারুনুর রশিদ জানান, ২০১৭ সালে তিনি স্বাক্ষর যুক্ত চেক বই, তিনশ’ টাকার নন জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্প ও খারিজসহ জমি দলিল জমা রেখে দাদন ব্যবসায়ী নাজমা খাতুনের কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহন করেন। ইতিমধ্যে এবাবদ তিনি ২ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। তা সত্বেও সে বর্তমানে চেক জালিয়াতির মামলা করে আমার কাছ থেকে আরও সাড়ে ৪ লাখ টাকা দাবী করেছেন।
২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর নাজমা খাতুন উপজেলা হাবড়া ইউনিয়নের ফকিরপাড়া সড়েয়াডাঙ্গা গ্রামের খলিলুর রহমানের ছেলে বেকার যুবক আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বাক্ষরিত একটি ফাঁকা চেক তার ঘনিষ্ট সহযোগি সুদুরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিয়ন কাম নৈশ প্রহরী মো: আল মামুনের নামে সাড়ে ৪ লাখ টাকার চেক ইস্যু করে। চেক (নং ১৬০৭৪৪৮) টি ওই বছরের ১৪ নভেম্বর সোনালী ব্যাক, হুগলীপাড়া শাখা জমা করা হলে সেটি ডিজঅনার হয়। এ অজুহাতে গত ১৯ নভেম্বর আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আদালতের মাধ্যমে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। ওই সময় সোনালী ব্যাংক হুগলীপাড়া শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন মো: মোকাদ্দেস হোসেন।
মো: আল মামুন জানান, ২০১৬ সালে নাজমা খাতুনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে ৬০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। তা সত্বেও সে বর্তমানে চেক জালিয়াতির মামলা করে আমার কাছ থেকে আরও ৫ লাখ টাকা দাবী করছেন।
২০১৯ সালে ২৭ মার্চ নাজমা খাতুন হামিদপুর প্রামানিকপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা লায়লা বানু স্বাক্ষরিত একটি ফাঁকা চেক তার নাজমার ঘনিষ্ট সহযোগি শাখাওয়াত হোসেন সাজুর নামে ৫ লাখ টাকার চেক ইস্যু করে। চেক (নং- ৬৩৬২৬০৫) টি ওই বছরের ১৪ মে সোনালী ব্যাংক, হুগলীপাড়া শাখা জমা করা হলে সেটি ডিজঅনার হয়। এ অজুহাতে গত ২ জুন/২০২০ স্কুল শিক্ষিকা লায়লা বানুকে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। ওই সময় সোনালী ব্যাংক হুগলীপাড়া শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন মো: মোকাদ্দেস হোসেন।
লায়লা বানু জানান, ২০১৭ সালে তিনি চেক বই ও জমির দলিল জমা রেখে দাদন ব্যবসায়ী নাজমা খাতুনের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ গ্রহন করেন। ইতিমধ্যে ৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। তা সত্বেও সে বর্তমানে চেক জালিয়াতির মামলা করে আমার কাছ থেকে আরও ৫ লাখ টাকা দাবী করেন।
শিক্ষকরা জানান, তৎকালিন ব্যাংক ম্যানেজার চেক প্রতি ৫শ’ টাকা ও প্রতি ডিজঅনারের ঘটনায় নাজমার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করেছেন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে সোনালী ব্যাংক, হুগলীপাড়া শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক প্রদীপ রায় বলেন, আমি অল্পদিন হলো এ ব্যাংক শাখায় যোগদান করেছি। পূর্বের ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কে কিভাবে জড়িত ছিলতা আমার জানা নেই। তবে ব্যাংকের চৌকিদার পদে কর্মরত নাজমা খাতুনের ছেলে মো: নাবির শাহ নয়ন কোন ভাবে ওইসব বেআইনি কাজে জড়িত প্রমাণ পাওয়া গেলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
একই পন্থা অবলম্বন করে মধ্যে নাজমা খাতুন প্রতারনা, মামলার হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ফ্লাট বাড়ীসহ একাধিক বাসাবাড়ী, আবাদী জমি ও নগদ অর্থসহ কয়েক কোটি টাকার অর্থ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে ২৪ মার্চ মোটা অংকের বিনিময়ে সদ্য বিদেশ ফেরত তিন প্রবাসীকে তার রাজাবাসর ছোট হরিপুর মুন্সিপাড়ার ফ্লাটবাড়ীতে গোপনে বসবাসের সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগে পার্বতীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহনাজ মিথুন মুন্নী নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয়। এসময় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানকালে ভ্রাম্যমান আদালত তার নিকট থেকে পার্বতীপুর শহরের বিভিন্ন ব্যাংকের চেক, জমির দলিল, স্বর্ণ অংলকার উদ্ধার করে। উদ্ধার হওয়া নথিপত্রের মধ্যে ভূক্তভোগি শিক্ষক-কর্মচারীদের স্বাক্ষরযুক্ত ফাঁকা চেক বই, তিনশ’ টাকার নন-জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্প ও জমির দলিলও ছিল। দাদন ব্যবসায়ী নাজমা খাতুনের হয়রানির হাত থেকে প্রতিকার চেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষক-কর্মচারীগন গত ২৪ জুন (২০২০) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।
এ ব্যাপারে পার্বতীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহনাজ মিথুন মুন্নী বলেন, একজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের পক্ষে দাদন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনগত ভাবে তেমন কিছু করার নেই। তা সত্বেও ভূক্তভোগি শিক্ষক-কর্মচারীদের সুবিধার্থে তার কাছে পাওয়া পার্বতীপুরের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের ম্যানেজারের সীল ও বিভিন্ন ব্যক্তির স্বাক্ষরযুক্ত ফাঁকা চেক বই ও দলিলসহ বিভিন্ন পরিমান নথিপত্র উদ্ধার করা হয়। পরে সেগুলো ভূক্তভোগি ব্যক্তিদের কাছে ফেরত দেয়ার জন্য ‘মুচলেকা’ দিতে রাজী করা হয়। আগামীতে ভূক্তভোগি শিক্ষক-কর্মচারী ও নাজমা খাতুনকে ডেকে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
স্বাক্ষরযুক্ত ফাঁকা চেক বই ও তিনশ’ টাকার নন জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্প, জমির দলিল জমা নিয়ে ঋণ প্রদান ও এসব নথি ব্যবহার করে প্রতারনা হয়রানি, মামলার হুমকি, চেক জালিয়াতির মামলা করে ঋণ গ্রহনকারী শিক্ষক-কর্মচারীর কাছ থেকে ঋণের ১০ থেকে ২০ গুন বেশি অর্থ আদায় ও জমি লিখে দিতে বাধ্য করার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে নাজমা খাতুন বলেন, আমি তাদের টাকা লোন দিছি, আমি আমার টাকা ফেরত চাই। যত টাকা চাই, তা যদি দিতে না চায় তবে তারা চাইলে আমার সাথে যোগাযোগ করে কত দিতে পারবে আলোচনা করে তা নিষ্পত্তি করতে পারে।