নীলফামারীতে তামাক চাষে আগ্রাসন

ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়, নীলফামারী প্রতিনিধি ৪ ফেব্রুয়ারি॥ তামাক আবাদে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হলেও নীলফামারী জুড়ে এখনও হচ্ছে তামাক চাষ। ভরা মৌসুমে তামাক চাষের আগ্রাসন চলছে জেলা জুড়ে।
আজ মঙ্গলবার(৪ ফেব্রুয়ারি/২০২০) জেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে  জেলা সদরের পলাশবাড়ি ইউনিয়নের কানাইকাটা বামনডাঙ্গা গ্রামে এলাকায় দেখা যায় পরিবারের নারী পুরুষ এমনকি শিশুরাও এক সঙ্গে নিজেদের তামাক ক্ষেতে সেচ প্রদানে ব্যস্ত সময় পার করছে। তাদের তামাক ক্ষেতের পরিচর্যা দেখে মনে হবে তাদের মধ্যে তামাক আবাদের উৎসব শুরু হয়েছে। অথচ বিষবৃক্ষ এই তামাক শারীরিকভাবে কত ক্ষতিকর করছে তা চাষীদের অজান্তই থেকে যাচ্ছে।
স্থানীয় কৃষি বিভাগের মতে, চলতি বছরে জেলার ছয় উপজেলায় তিন হাজার ৫ হেক্টরে তামাক চাষ হয়েছে। অপর দিকে স্থানীয় তামাক ব্যবসায়ীরা বলছে তাদের হিসাব মতে নীলফামারী জেলায় তামাক চাষ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে।
কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানানো হয়। কিন্তু এরপরের বিড়ি ও সিগারেট কো¤পানিগুলোর লোভনীয় আশ্বাসের কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। গ্রামের বিস্তীর্ণ জমিজুড়ে তামাকের চাষ বেড়েই চলেছে।
ইটাখোলা-লক্ষ্মীচাপ-কচুকাটা-টুপামারী-পঞ্চপুকুর-গোড়গ্রাম,খোকশাবাড়ি- কুন্দপুকুর-চাপড়া সরেমজামি-সোনারায়-সংগলশী, জলঢাকা উপজেলার খুটামারা-কাঠালী-কৈমারী- শৌলমারী-মীরগঞ্জ-গোলনা-বালাগ্রাম-ডাউয়াবাড়ি-গোলমুন্ডা, ডিমলা উপজেলার সদর-বালাপাড়া-নাউতারা, ডোমার উপজেলা সদর-হরিণচড়া-বোড়াগাড়ী-জোড়াবাড়ি-বামুনিয়া-কেতকীবাড়ি-ভোগডাবুড়ি ও কিশোরীগঞ্জ উপজেলার বড়ভিটা ও পুটিমারী এলাকায় সব থেকে বেশী তামাক আবাদ হয়েছে।
তামাকের ক্ষেতে ব্যস্ত জেলা সদরের পলাশবাড়ি ইউনিয়নের কানাইকাটা বামনডাঙ্গা গ্রামে চাষি আর্জিনা বেগম বলেন, দুই বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছি। এতে আমার খরচ হয়েছে ৮ হাজার টাকা।
কো¤পানি অগ্রিম ঋণে সার ও নগদ অর্থ দিয়ে থাকেন এবং ক্রয়ের শতভাগ নিশ্চিয়তা দেয়।
অপর চাষি মুক্তা আক্তার বলেন, দুই বিঘা জমিতে তামাক চাষে ৫-৭হাজার টাকা খরচ করে তা বিক্রি করে ৩০-৩৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়। কোন সময় ৫০হাজার টাকাও পাওয়া যায়। যা ধান, আলু, মরিচ, কপি ও সরিষা চাষ করেও পাওয়া যায় না।
বাবা-মা সাথে তামাক ক্ষেতে কাজ করা ছোট্ট ৭ বছরের শিশু সুমাইয়া আক্তার বলেন, আজ স্কুলে না গিয়ে মা বাবার সাথে জমিতে পানি দিতে সহযোগীতা করছি। ৫ বছরের শিশু মনি আক্তার বলেন, বাড়িতে আমরা তিনজনে থাকি। তাদের সাহায্য না করলে খাবো কিভাবে। 
একই গ্রামের সুলতান আলী বলেন, ৪ বিঘা জমিতে তামাক চাষে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সেলো মেশিন ভাড়া করে এনে জমিতে পানি দিচ্ছি। সেলো মেশিন ভাড়া নেয় এক হাজার টাকা।

সদরের রামনগর ইউনিয়নের রামনগর দোলাপাড়া গ্রামের চাষি শফিয়ার রহমান বলেন, এক বিঘা জমিতে তামাক চাষে খরচ হয় ৫ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘায় তামাকের ফলন হয় ৬ থেকে ৭ মণ। কো¤পানিগুলো প্রতিমণ তামাক ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় ক্রয় করে।
একই ইউনিয়নের চড়চড়াবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, চাষিদের সুবিধার জন্য কো¤পানিগুলো জেলার বিভিন্ন এলাকায় অনেক বড় বড় ক্রয় কেন্দ্র ও গোডাউন তৈরি করেছে। জমি থেকে সরাসরি সেখানেই চলে যায় কৃষকদের উৎপাদিত তামাক। নীলফামারীতে তামাক ক্রয়ের জন্য ঢাকা ট্যোবাকো, আবুল খায়ের ট্যোবাকো, নাসির ট্যোবাকো, আকিজ ট্যোবাকোসহ বেশ কয়েকটি তামাক কো¤পানি রয়েছে। এই তামাক কোম্পানীগুলোর  সুপারভাইজার ও কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ম তামাক চাষীদের খোঁজ খবর রেখে সহযোগীতা করে আসছে।

জেলা সদরে লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের ফসলি মাঠে যেমন সবজী আবাদ হয় তেমনি সবজীর চেয়ে তামাক চাষ বেশী হচ্ছে বলে জানালেন কৃষক গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্তমান মহা পরিচালক ডাঃ আবুল কালাম আজাদের গ্রামের বাড়ি এই লক্ষ্মীচাপে। তার ছোট ভাই আমিনুল ইসলাম ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান। তাদের পরিবারের সদস্যরাও তামাক চাষ করেন বলে জানান তিনি।


অভিযোগ উঠেছে, বেশ কিছু তামাক কো¤পানিগুলোর প্রলোভনে পড়ে চলতি মৌসুমে বোরো,গম,ভুট্টা সহ অন্যান্য রবিশষ্য আবাদ কমিয়ে দিয়ে তামাক চাষের প্রতি ঝুঁকেছে চাষিরা। শুধু নীলফামারী নয়, তামাক কো¤পানিগুলোর আর্থিক সহযোগিতায় দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে তামাক চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সচেতন মহল জানায়। কোম্পানীগুলো এর কারণ- বিনা মূল্যে বীজ, বিনা সুদে ঋণ সার ও নগদ অর্থসহ তামাক ক্রয়ের নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফা লাভের আশায় তামাকের ক্ষেতে মাঠে কাজ করছেন নারী ও শিশুরাও।
তামাক চাষ থেকে দূরে থাকতে শহর ভিত্তিক প্রচার প্রচারনা থাকলেও প্রত্যন্ত গ্রামে সাধারণ মানুষের কাছে এসব বার্তা পৌঁছে না। আর পৌঁছালেও তামাক চাষীদের কাছে আর্থিক বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পায়। তামাক আবাদে আর্থিকভাবে কৃষকরা যে হারে লাভবান হয়,অন্য কোন ফসলে তা হয় না।
কারন চাষে খরচ কম, লাভ বেশি। তাই অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ক্ষতির কথা চিন্তা না করে কৃষকরা দিন দিন ঝুঁকে পড়ছে তামাক চাষে। তাছাড়া তামাক চাষে কারগিল নামক সার প্রয়োগের ফলে চাষী ও তার পরিবারের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে ও ফসলি জমি উর্বর শক্তি হারাচ্ছে। সেই সঙ্গে কৃষকরা ভুগছে নানা ধরনের জটিল স্বাস্থ্য সমস্যায়।
গ্রামের চাষিদের মতে অর্থ সংকটে থাকেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিরা। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কো¤পানিগুলো ওই সব চাষিদের তামাক চাষে উৎসাহিত করেন এবং তাদের মধ্যে কার্ডের মাধ্যমে বিনামূল্যে তামাকের সার ও বীজ সরবারহ করে থাকেন। ফলে তামাক চাষ বেড়েই চলেছে।

চাষিরা জানায়, শর্ত ছাড়া নগদ অর্থ প্রদানসহ কো¤পানির নিজস্ব সুপারভাইজাররা প্রতিনিয়ত তামাক চাষিদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন পরামর্শ সহ বাজার দরে তামাক ক্রয়ের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিয়তাও দিয়ে থাকে। মূলত এ কারণেই তামাক চাষ স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর হলেও (জেনেও) অধিক মুনাফা লাভের আশায় মাঘের শীতকে উপেক্ষা করেও তামাক ক্ষেতে কাজ করছেন নারীসহ শিশুরাও।
তামাক চাষিরা আরো বলেন, তুলনামুলকভাবে এ দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছেন সরকারের কৃষি বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত মাঠ পর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা। তামাক কো¤পানির কর্মীরা প্রতিদিন মাঠে গিয়ে চাষির সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কখনও অন্য ফসল উৎপাদনের জন্য এধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি। চাষিদের দাবি- বোরোর মৌসুমে বীজতলা, সবজি ও ফসলের ক্ষেত নষ্ট হলেও কৃষি অফিসের লোকজনকে সংবাদ দিয়েও দেখা পাওয়া না।

সদরের তামাক-আড়তদার শফিকুল ইসলাম তুহিন বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের উৎপাদিত পণ্যের ৮৫ ভাগ আয় আসে তামাক থেকে। যা দিয়ে কৃষকরা সংসারের খরচ ও ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচের যোগান দেন। তিনি আরও বলেন, অন্যান্য ফসলের ক্রয়-বিক্রয়ের নিশ্চয়তাসহ ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু করা হলে তামাক চাষের প্রবণতা অনেকটাই কমে যাবে। #

পুরোনো সংবাদ

নীলফামারী 1858896450902709357

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item