যোগ্যতা ও মেধায় টাকা ছাড়াই নীলফামারীতে ১২৯ জনের পুলিশে চাকুরী পেল

ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়,নীলফামারী  ॥ লোকে বলেন সরকারী চাকুরী পেতে টাকা/রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া হয়না। সরকারি চাকরিতো সোনার হরিণের মতোই। কিন্তু নীলফামারীতে পুলিশে চাকুরী পাওয়া ১২৯ জন বলছে টাকা-রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াও যে চাকুরী হয় তার জলন্ত প্রমান তারা নিজেরাই। কোনো ধরনের ঘুষ বা অনৈতিক সুবিধা ছাড়াই পুলিশে নিয়োগের যে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তার বাস্তবায়ন করেছেন নীলফামারী পুলিশ মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন। স¤পূর্ণ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জেলায় পুলিশ কনস্টেবল পদে ১২৯ জনকে চাকরি দিয়ে দৃষ্টান্ত দেখালেন তিনি। মঙ্গলবার (৯ জুলাই) দুপুরে এই নিয়োগ নিয়ে পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন।
তবে পুলিশে চাকুরী পাওয়াদের মধ্যে জেলা সদরের এক যুবক চাকুরী পেয়েও তাকে চাকুরীটি হারাতে হয়েছে। চুড়ান্তদের মেডিকেল টেস্টে ওই যুবক মাদকাসক্ত ধরা পড়ে যায়। নিজেও স্বীকার করেছে সে ইয়াবা সেবন করে। সে বাদ পড়ে যাওয়ায় তার স্থানে অপেক্ষামান তালিকায় এগিয়ে থাকা একজন সংযুক্ত হয়েছে।
নীলফামারীতে এই নিয়োগে রিক্সাচালকের ছেলে, কৃষি শ্রমিকের ছেলে মেয়ে, এতিম ছেলে ও অসহায় পরিবারের বেকার ছেলেরা নিজেদের মেধা বিকশিত করে চাকুরির প্রতিযোগীতায় পুলিশে চাকুরী পেয়েছে এটি এলাকায় স্পস্ট হয়ে ফুটে উঠে।
ঘুষ বানিজ্য ও রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই পুলিশে চাকুরী পেয়ে চোখে পানি চলে আসে তাদের। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, চাকুরী মানে সোনার হরিণ। এই সোনার হরিণ পেয়ে আমরা সৎভাবে চাকরি করে দেশ ও জনগণের সেবা করতে চাই। এমনকি শপথ নিয়েও জানায় ঘুষ খাব না, অসৎপথে যাব না। ১০০ টাকায় চাকরি পাওয়ায় তারা দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নীলফামারী পুলিশ সুপারে প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়।
রিক্সাচালক মিজানুর রহমানের ছেলে সুমন রানা। তার বাড়ি জেলা সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের বাহালিপাড়া গ্রামে। বাবা রিক্সা চালিয়ে ঠিকমতো সংসারের খরচ বহন করতে পারেনা। তাই সে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে প্রাইভেট পড়াতো। আবার কখনো কৃষি শ্রমিক সেজে ফসলি জমিতে কামলাও খাটতো। খেয়ে না খেয়ে এ ভাবে নিজের শিক্ষা জীবন সে গড়ে তুলছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর নীলফামারী সরকারী কলেজে গণিত বিভাগের অনার্স ভর্তি হয়। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সেই বড়।
সুমন জানায়, নীলফামারী জেলায় চলতি বছরের পুলিশ কনস্টবল পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২২জুন। এর আগে সারা জেলায় মাইকযোগে এই নিয়োগের জন্য প্রকাশ্যে প্রচারনা চালানো হয় পুলিশের পক্ষে। প্রচারনায় দালাল প্রতারকের কবল হতে চাকুরী প্রত্যাশীদের সর্তক সহ অর্থ লেনদেন করতে নিষেধ করা হয়। প্রচারনায় বলা হয় সরকারী কোষাগারে-ব্যাংকের মাধ্যমে ১০০ টাকা জমার চালান কপি সঙ্গে রাখতে। পুলিশের পক্ষে এই প্রচারনা চাকুরী প্রত্যাশীদের কতখানি সচেতন করতে পারে সেটিও অবাক করার মতো বিষয় ছিল। তাই পুলিশের চাকুরী জন্য দাড়িয়ে পড়ি। টাকায় বা মামা চাচার প্রভাবে নয় নিজের মেধায় পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এভাবে যে চাকুরীটা পাবো কল্পনাই করিনি। এ জন্য আমার খরচ হয় ১০৩ টাকা।
জেলার জলঢাকা উপজেলার পাঠানপাড়া গ্রাম। এই গ্রামের এতিম ছেলে রবিউল ইসলাম। ছোটকালেই বাবা মিরাজুল ইসলাম সহ মা কে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলে। ঠাই হয়েছিল এতিমখানায়। সেখানে তার বেড়ে ওঠা। এই রবিউল ইসলাম নিজেকে চিমটি কেটে নিজের কাছেই জানতে চায় আমার কি সত্যিই পুলিশে চাকুরী হয়েছে? প্রশ্নের উত্তরটি আবার নিজেই বলে দেয় হ্যা-সত্যিইতো আমার পুলিশে চাকুরী হয়েছে। টাকা-রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই মেধা শক্তিতেই চাকুরী হয়েছে। কথা গুলো ঠিক এ ভাবেই উপস্থাপন করছিল এতিম  রবিউল। 
আরেক চাকুরী পাওয়া মাসুদা আক্তার। জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা ইউনিয়নের ভবনচুর এলাকার গোলাম মাসুদের বড় মেয়ে সে। বাবা দিনমজুর। সেও গ্রামে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের লিখাপড়া চালিয়ে আসছে। জলঢাকা ডিগ্রী কলেজ থেকে এবারে (২০১৯সালে) উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে মাসুদা। বাবাকে কিছু না জানিয়ে নিজেই ট্রেজারী চালান ফরম সংগ্রহ করে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারী খাতে ১০০ টাকা জমা করে। ১০০ টাকা জমা দিতে খরচ হয় ৩ টাকা।
এরপর ২২জুন শারীরীক পরীক্ষার দিনে পুলিশ লাইন্সে গিয়ে দাড়িয়ে প্রথম স্তরে সফলতা পেয়ে যায়। এরপর লিখিত পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষা শেষে  চাকুরীর জন্য নির্বাচিত হয়। ঘুষ ছাড়াই পুলিশে চাকুরি পেয়ে মাসুদা ইতিহাসের একজন সাক্ষি হিসাবে মনে করছে।
নীলফামারী সদর উপজেলার চড়াইখোলা বসুনিয়াপাড়া গ্রামের ওবায়দুর রহমানের ছেলে লাবু ইসলাম। বাবা পেশায় একজন কায়িক শ্রমিক। দুইভাই এক বোনের মধ্যে সে বড়। লিখাপড়ার পাশাপাশি ফসলি জমিতে কামলা খেটে টাকা উপার্জন করতো সে। লাবু জানায় নিজের উপার্জনের অর্থেই নীলফামারীর মশিউর রহমান ডিগ্রী কলেজে বিএ শ্রেনীতে অধ্যায়নরত সে। পুলিশে চাকুরীর পূর্বে সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একাধিকবার আবেদন করে। পাশও করে। কিন্ত মৌখিক পরীক্ষার পর চাকুরী তার ভাগ্যে জোটেনা। লাবুর পুলিশে চাকুরী হওয়ায় অপর ভাই ও বোনের পড়া-শুনার খরচ আর বন্ধ হবেনা বলে জানালো লাবু।
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার পশ্চিম চিকনমাটি দোলাপাড়া গ্রামের কবির হোসেনের চতুর্থতম কন্যা শাম্মি আক্তার লিজা। বাবা পেশায় একজন কৃষি শ্রমিক। ডোমার সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ ও সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে। লিজা জানায় পুলিশে চাকুরি ১০০ টাকায়। ব্যাংকে ট্রেজারী চালানে ওই টাকা জমা করতে হয় ৩ টাকা। এই প্রচারনায় আমি আগ্রহী হয়ে লাইনে দাড়িয়ে আজ সফলতা পেলাম। লিজা জানায় আমার ইচ্ছে ছিলো পুলিশে চাকুরী করবো সেটি পূরণ হয়েছে।
 উপজেলার বোড়াগাড়ি ইউনিয়নের নিবাস চন্দ্র রায়ের মেয়ে রীতা রানী রায়, জোড়াবাড়ী ইউনিয়নের মির্জাগঞ্জ গ্রামের মো: আব্দুর রহিমের মেয়ে রওনক জাহান, বড় রাউতা গ্রামের মো: নুরুল ইসলামের মেয়ে রওরীন জাহান প্রমি, বামুনিয়া ইউনিয়নের খামার গ্রামের প্রেম কুমার রায়ের মেয়ে বিথী রানী,সৈয়দপুর উপজেলার ছইল খিয়ালপাড়া গ্রামের মো: জিয়ারুল হকের ছেলে দীন মোহাম্মদ জয়, মাঝাপাড়া বাড়াইশালপাড়া গ্রামের রনজিৎ কুমার রায়ের ছেলে রঞ্জন কুমার রায়, নীলফামারী সদর উপজেলার  ইটাখোলা ইউনিয়নের ম্যাকরটারি গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে আবু সায়েম, সদর উপজেলার দারোয়ানী জয়চন্ডী সুজপাড়া গ্রামের মো: আল আমীনের ছেলে মিশকাত নুর আহমেদ, পলাশবাড়ী ইউনিয়নের খলিশাপচা গ্রামের লেবুজার রহমানের ছেলে নুর আলম, ছোট সংগলশী ইউনিয়নের আলাল ইসলামের ছেলে সুজন আলী, গোড়গ্রাম ইউনিয়নের সামসুল ইসলামের ছেলে আবুল হাসান সেলিম, টুপামারী ইউনিয়নের টেংনারগড় গ্রামের মো. হামিদুল ইসলামের ছেলে মো. শাহাজাদ হোসেন, দুবাছরী মালিপাড়া গ্রামের প্রমথ চন্দ্র রায়ের মেয়ে শিবানী রানী রায় সহ চাকুরী পাওয়া সকলেই এক বাক্যে বলেছেন ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া পুলিশের চাকুরী হয় তার বড় প্রমান আমরাই।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে নীলফামারী পুলিশ লাইন্স মাঠে প্রায় দুই হাজার ৫’শ জনের মধ্য থেকে শারীরীক বাছাই শেষে(প্রাথমিক বাছাই) ৭৭৮জনকে লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করা হয়।
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৩৪৬জনকে নির্বাচন করা হয় মৌখিক পরীক্ষার জন্য। মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২৭জুন  প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ততের তালিকা। নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতিনিধি হিসেবে নীলফামারীতে ছিলেন এসপি ও অতিরিক্ত এসপি পর্যায়ের দু’জন কর্মকর্তা। এ ছাড়া চাকুরী প্রদানের ক্ষেত্রে কোন সুপারিশ  গ্রহণ করা যেমন হয়নি তেমনি সরকারী কোন নিয়মকে উপেক্ষা করা হয়নি। জেলা পুলিশ সুত্র জানায়, ১২৯জনকে নির্বাচিত করা হয়। দীর্ঘদিন থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ না হওয়ায় সেগুলো পূরণ করেও অবশিষ্ঠ অপুর্ণ পদগুলো পূরণ করতে মেধাবীদের নেয়া হয়েছে ।

 পুলিশ সুপার তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত বিষয়ে সাংবাদিকদের  বলেন, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের উদ্দেশ্যে এক মাস আগ থেকে প্রচার-প্রচারণা, লিফলেট বিতরণ  করা হয়। যা আর্থিক লেনদেনসহ সব অনিয়ম ও সুপারিশ পরিহার করে সুষ্ঠুভাবে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের বিষয়টি স¤পন্ন করতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। শতভাগ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া স¤পন্ন করতে পেরে খুব ভালো লাগছে আমার। আগামীতেও এমন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে তিনি আরো জানান এই নিয়োগে কোন তদবির ছাড়াই ১০৪ জন পুরুষ ও ২৫ নারী চাকুরী পেয়েছে। #

পুরোনো সংবাদ

নীলফামারী 7773509333999800894

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item