হামার ঠাকুরগাঁও- আব্দুল ওয়াফু তপু

হামার ঠাকুরগাঁও জেলার উত্তরে পঞ্চগড়, দক্ষিণে ও পূর্বে দিনাজপুর ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অবস্থিত। ঠাকুরগাঁও জেলাতে রয়েছে ৩ টি পৌরসভা, ৬ টি থানা (ঠাকুরগাঁও সদর, বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুর, রাণীশংকৈল, পীরগঞ্জ ও রুহিয়া), ৫৩ টি ইউনিয়ন ও ৫৭০ টি গ্রাম। ঠাকুরগাঁও নামটি এসেছে প্রাচীন জমিদার নারায়ন ঠাকুর এবং তার ভাই জোতিষ ঠাকুরের নামানুসারে। ঠাকুর অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের সংখ্যাধিক্যের কারণে স্থানটির নাম ঠাকুরগাঁও হয়েছে। ঠাকুরগাঁও এর পূর্ব নাম নিশ্চিন্তপুর। গত দশ বছরে ঠাকুরগাঁও এর ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে যেমন- রাস্তা ঘাট(সব ধরনের যোগাযোগ ব্যাবস্থা),ব্রীজ কালভার্ট,ধর্মীয়,প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল কারখানা,আয়-ব্যায়,ব্যাবসা-বানিজ্য সহ সব ক্ষেএে অনেক পরিবর্তন হওয়ার ফলে বর্তমান ঠাকুরগাঁও একটি আধুনিক শহরে পরিনত হয়েছে। এই শহরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে টাংগন নদী। টাঙ্গন নদীর পাড়ে অপরাজেয় ৭১ ভাস্কর্য। ঠাকুরগাঁও একটি ছোট্ট শহর। কিন্তু এর  ভেতরে ও আশেপাশে অনেক গুরুত্বপুর্ণ স্থান রয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলায় বাংলাদেশ প্রতœতত্ত্বর অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত দুটি প্রতœতাত্ত্বিক স্থাপনা যেমন-ঢোলরহাট মন্দির ও জামালপুর জামে মসজিদ।এছাড়া আরো রয়েছে ঠাকুরগাঁও সদরে ঐতিহ্যবাহী বালিয়া মসজিদ, ও রানীসাগর,রায়পুর ইউনিয়নে অছে দু'শত বছরের পুরাতন ঈমাম বাড়া ঐতিহাসিক পুরাতন জামে মসজিদ। হরিণমাড়ির পুরোনো শিবমন্দির, মোঘল আমলে নির্মিত সনগাঁও জামে মসজিদ, ফতেপুর সিক্রি, বলাকা উদ্যান,ঠাকুরগাঁও রোডে বঙ্গবন্ধুর মূড়্যাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পুরোনো বিমান বন্দর, সালান্দর ইউনিয়নে রেডিও সেন্টার এ ছাড়াও রয়েছে ১৩ নং গড়েয়া ইউনিয়নে আন্তর্জাতিক স্কন মন্দির ও লস্করা গৌড়িয় মঠ মন্দির ইত্যাদি এছাড়াওগরুত্ত্বপূর্ণ স্থাপনা হচ্ছে হরিপুর রাজবাড়ি। রাণীশংকৈল রাজবাড়ি। হরিপুর থানার ভাতুরিয়া গনেশবাজার বাড়ি।হরিপুরে মেদনীসাগর গ্রামে অবস্থিত একটি সোনার মসজিদ রয়েছে।আরো আছে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় আমগাছ বালিয়াডাংগী থানায় অবস্থিত। পীরগঞ্জের ফানসিটি।প্রধান শস্য- ধান,গম,আলু, ভুট্টা,পাট, আখ। রপ্তানী পণ্য-- ধান,চাল,আলু,আম।শীতকালে হরেক রকমের পিঠা তৈরি হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঠাকুরগাঁও রোডে অবস্থিত ঠাকুরগাঁও চিনি কল অন্যতম।হামার প্রানের ঠাকুরগাঁওয়ে রয়েছে দৃষ্টি নন্দিত আরো অনেক দর্শণীয় স্থান। সদর উপজেলা আকচায় আছে কল্পনা পিকনিক স্পট,স্বপ্ন জগৎ, চিটাগাং পার্ক, বুড়ির বাধ ও লোকায়ন জীবন বৈচিএ জাদুঘর যা ঠাকুরগাঁও এর জনগনের কাছে একটি জনপ্রিয় স্থান বিভিন্ন জেলার মানুষ লোকায়ন জীবন বৈচিএ জাদুঘর দেখতে আসে। ভারতীয় সীমন্ত ঘেষা নাগর নদীর তীরে গড়ে ওঠেছে দৃষ্টিনন্দন চা বাগান রনবাগ টি স্টেট যেটা বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বহুল জনপ্রিয়।ঠাকুরগাঁওয়ে অনেকগুলো নদী রয়েছে । সেগুলো হচ্ছে টাঙ্গন নদী, শুক নদী, ছোট সেনুয়া নদী, আমনদামন নদী, লাচ্ছি নদী, ভুল্লী নদী, সোজ নদী,ছোট ঢেপা নদী,কুলিক নদী, পুনর্ভবা নদী, তালমা নদী,পাথরাজ নদী,কাহালাই নদী,তীরনই নদী,নাগর নদী,তিমাই নদী এবং নোনা নদী।এছাড়াও আছে পুরো জেলা জুড়ে গড়েয়া হাট দিঘি, লস্করা দিঘি, টুপুলী দিঘি, শাসলা ও পোয়ালা দিঘি, ঠাকুর দিঘি, আঠারো গান্ডি পোখর, আধার দিঘি, হরিণমারী দিঘি, রতন দিঘি, দুওসুও দিঘি, রামরাই দিঘি, খুনিয়া দিঘি, রানীসাগর, মেদিনীসাগর দিঘি।শিক্ষার দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই হামার ঠাকুরগাঁও।আমাদের  জেলার অনেক কৃতিসন্তান দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় কৃতিত্বের সাথে অনেক অবদান রেখে যাচ্ছে। ঠাকুরগাঁও এর মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বুকে লালন করে উন্নয়নে কাজ করে। শুখানপুখরী ইউনিয়নে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্বৃতি বিজরিত জাঠিভাঙ্গা সেখানে ১৯৭১ সালে ২৩ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা সদর উপজেলার ১৫টি গ্রামের তিন হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষকে জাঠিভাঙ্গায় জড়ো করে হত্যা করেছিল। এই রকম অনেক মুক্তিযুদ্ধের স্বৃতিবিজরিত স্থান ঠাকুরগাঁও এর বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে।১৯৭১ সালে
স্বাধীনতা লাভের পর ঠাকুরগাঁও এর তরুন যুবকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম গড়ে তোলার যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়ন কচুবাড়ি-কৃষ্টপুর গ্রাম দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পায়।যা বাংলাদেশের সর্বপ্রথম নিরক্ষর মুক্ত গ্রাম কচুবাড়ির কিষ্টপুর হামার ঠাকুরগাঁও জেলায় অবস্থিত। এখানে বসবাস করে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষ যেমন: পলিয়া, মুন্ডা, সাওতাল, রাজবংশী, মালধরিয়া, কোচ ইত্যাদি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে ওয়াজ মাহফিল, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা, ধামের গান, সত্যপীরের গান, কবি গান,বৈশাখী মেলা, বানিজ্য মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পালাগান , ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়।খেলাধুলার মধ্যে রয়েছে মার্বেল, লুডু, হা-ডু-ডু, কেরাম, বউচি, চৌপাতি, গোল্লাছুট, চোরপুলিশ, ফুটবল এবং ক্রিকেট। আমাদের জেলার অথর্নীতির সীমানা ডিঙ্গিয়ে কিছু শিল্পপতি সমগ্র দেশে বিচরণ করছে। এদের মধ্যে ইকো সোশ্যাল অর্গানইজেশন ইএসডিও,রাজ্জাক গ্রুপ, ইজাব গ্রুপ,বাবলু এন্টারপ্রাইজ, পল্লীবীর ইন্ডাষ্ট্রিজ, দেশের এক মাএ বেসরকারি স্টোডিয়াম পল্লীবীর স্পোর্টস সেন্টার রহিমানপুর ইউনিয়নে অবস্থিত,কাজী ফার্ম,সুপ্রিয় গ্রুপ,সেলিম রেজা গ্রুপ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।অনেক বরেণ্য ব্যক্তিরও জন্ম হয়েছে হামার ঠাকুরগাঁও জেলায়। তারা দেশে ও দেশের বাইরে কৃতিত্বের সাথে অবদান রেখে যাচ্ছেন। হামার ঠাকুরগাঁও জেলার মানুষ সহজ সরল। এ জেলার মানুষের জীবন যাপন নিয়ে লিখলে অনেক কিছু লিখা যায়।ঠাকুরগাঁও এর মানুষের অতিতে পাকা ঘর ছিলনা বললেই চলে ছিল খড়ের/কাশের ছাউনি ঘর ও বাঁশের তৈরি বেড়া অথবা মাটির দেওয়াল। এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। প্রচুর পাকা ও আধা পাকা বাড়ি।বেশির ভাগ পরিবার কৃষি নির্ভরশীল।    ব্যবসা বানিজ্যেরও প্রসার লাভ হয়েছে। শহর অথবা গ্রামের হাট-বাজার পর্যন্ত দোকান, পাইকারী ইত্যাদি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেক মানুষ। চাকরিও করছেন অনেকে। শিক্ষকতা, চিকিৎসা, সরকারি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত সব মিলিয়ে চাকরিজীবীর সংখ্যায় কম নয়।ঠাকুরগাঁও এর মানুষ প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ
ঠাকুরগাঁও এর মানুষ প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ, মাংস ও বিভিন্ন রকমের সবজি। পাটশাক ও লাফা শাকের ঝোল, সিদলের ভর্তা, চেং বা টাকি মাছের ভর্তা, কচু পাতার ভর্তা, পেল্কাশাক, এগুলো সবার প্রিয় খাবার। কাঁচা আমের তরকারি, কাঁচা কাঁঠালের তরকারি, আমসি বা টমেটোর। শীতকালে নতুন ধানের ভাঁপা, নুনিয়া পিঠা, তেল পিঠা,  চিতুয়া, গুলগুলিয়া পিঠা ইত্যাদি। আঁখের নতুন গুড় দিয়ে তৈরি হয় খৈ এর মুড়কি, মুড়িয়া নাড়ু, চিড়ার চিপড়ি। এগুলো খুবই সুস্বাদু। ঠাকুরগাঁও এর মানুষ অতিথিপরায়ন। গ্রামাঞ্চলে চা-নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করা সম্ভব না হলেও গুয়া-পান, বিড়ি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করে থাকে। অতীতে হুঁকার প্রচলন ছিল, এখন তা বিলুপ্ত প্রায়। তার স্থান দখল করে নিয়েছে বিড়ি ও সিগারেট।সাধারণ মানুষের পোশাক লুঙ্গি, গেঞ্জি, সার্ট, পায়জামা, পাঞ্জাবী ও ধুতি। শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের লোকেরা সার্ট, প্যান্ট, পায়জামা, পাঞ্জাবী, জুতা ব্যাবহার করে। নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন লোকেরাও এখন অনেকে সার্ট, প্যান্ট, সোয়েটার ও কোট পরিধান করে। শীতকালে মানুষ গায়ে চাঁদর, সোয়েটার, কোট, মাফলার ইত্যাদি পরিধান করে। এ জেলায় অতিতে যাতায়াত অথবা মাল পরিবহনের একমাত্র বাহন ছিল গরুর গাড়ি। কিন্তু এখন গরু মহিষের গাড়ির প্রচলন আর নেই। কেননা, গরুর গাড়ির জায়গা দখল করে নিয়েছে রিকশা ভ্যান। এখন মাল পরিবহন থেকে শুর করে আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া, হাটে বাজারে পণ্য আনা নেওয়া সবই সম্পন্ন হচ্ছে রিকশা/ভ্যানে অথবা ছোট/বড় ট্রাক। এছাড়া যাতায়াতের জন্য এখন মিশুক, টেম্পু ও মিনিবাসের থাকায় সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। ঘরে ঘরে প্রত্যেকের হাতে হাতে এখন মোটরসাইকেল দেখা যায়। এখন বাইসাইকেল খুব কম দেখা যায়। আগে ধান কুটা হতো ঢেঁকিতে বা ছাম-গাহিনে। এখন আর ঢেকি বা ছাম গাহিনের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। গ্রামে বিদ্যুৎ আসায় অনেক ছোট বড় চাল কল গড়ে উঠেছে। চাল, চিড়া, মুড়ি, চালের আটা এমনকি মরিচ ও হলুদের গুড়া কলের মাধ্যমে পাওয়া যায়।হামার ঠাকুরগাঁও এর মানুষ ভাষা হিসেবে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেন। শহর ও গ্রামের শিক্ষিত পরিবারে কেউ কেউ শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করেন। আঞ্চলিক ভাষা জেলার সর্বত্র প্রায় একই রকম হলেও দূরত্ব ভেদে উচ্চারণে বা কথা বলবার ভঙ্গিমায় সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।আমি আমার জেলাকে ও আমার  আঞ্চলিক ভাষাকে ভীষণ ভালোবাসি।গর্ববোধ করি। অহংকার করি। আসুন সবায়মিলে ঐক্য বদ্ধহয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ি।হামার ঠাকুরগাঁও জেলার উন্নয়নে সবাইমিলে একসাথে কাজ করি।

লেখক, আব্দুল ওয়াফু তপু
ঠাকুরগাঁও রোড, ঠাকুরগাঁও।

পুরোনো সংবাদ

ঠাকুরগাঁও 1781328322932391030

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item