আজ ২৮মার্চ ঐতিহাসিক রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস

হাজী মারুফ-আজ ভয়াল ২৮ মার্চ। রংপুরে ১৯৭১’র এই দিনে পাকিস্তানি হায়েনাদের আবাসস্থল রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে আদিবাসীসহ কয়েক হাজার বাঙ্গালি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই আক্রমণ নিরস্ত্র মুক্তিকামীদের জোটবদ্ধ লড়াইয়ের অনন্য উদাহরণ। সেদিন তীর-ধনুক নিয়ে পাক হানাদারদের ওপর হামলা চালায় রংপুরের সাধারণ আপমর সাধারন মানুষ। পাক হানাদারের গুলিতে নিরস্ত্র মুক্তিকামী হাজারো মানুষ সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়। শহীদ হয় দেড় হাজারের বেশি বাঙ্গালি। এমন আক্রমণের ঘটনা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই নজিরবিহীন ঘটনা। যা ঘটিয়েছিলেন রংপুরের আপামর বীর জনতা। তাই রংপুরে আজকের এই দিনটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দিন।
১৯৭১’র ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণই আদিবাসীসহ, সর্বস্তরের মানুষকে করেছিল একজোট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রংপুর সফরে এসে ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই এক জনসভায় অংশ নিতে রংপুরের নিসবেতগঞ্জের বাঁশহাটিতে এসেছিলেন। সেই দিন জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন,‘‘বাঁশহাটির বাঁশের লাঠি নিয়ে তৈরি থেকো। ছয় দফা নয়, এক দফা প্রতিষ্ঠার খবর পাবে।’’সেই খবর তাঁরা পেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে নিরস্ত্র আদিবাসী সাওতাল ও সাধারণ মানুষ ২৮ মার্চ আদিবাসী সাওতালসহ সাধারণ জনগণ তীর-ধনুক, বাঁশের লাঠি, দা, কুড়াল নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে আক্রমণ করে। সেদিন বলদীপুকুর এলাকা থেকে আসে ওঁরাও উপজাতিদের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বুদু ওঁরাও এর নেতৃত্বে কয়েক হাজার ওঁরাও। সবার মুখে ছিল গগনবিদারী স্লোগান ‘‘এস ভাই অস্ত্র ধর, ক্যান্টনমেন্ট দখল কর।’’
২৮ মার্চে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানান, রংপুরে মূলত দুই দিন আগ থেকেই যুদ্ধ হয়েছিলো। ২৪মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক ডিভিশনের পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনসহ তিন জওয়ানকে হত্যার মধ্য দিয়ে ২৪মার্চই স্বাধীনতার যুদ্ধ আরম্ভ করে রংপুরের মানুষ। তৎকালীন সময়ের রংপুরের সাতগাড়া ইউনিয়নের (বর্তমানে রংপুর সিটি কর্পোরেশন এর অন্তর্ভূক্ত এলাকা) দামোদরপুরের সাধারণ দিনমজুর ও অনাহারী জীর্ণশীর্ণ মানুষরা সেদিন যে সাহসিকতার পরিচয় দেখিয়েছিলেন তা এক গর্বের ইতিহাস। এঘটনার পর পাকিস্তানী হায়েনার দল রংপুরে জ¦ালাও পোড়াও শুরু করে। ২৫মার্চ মধ্যরাতে ক্যান্টনমেন্টের পাশের গ্রাম নিসবেতগঞ্জ, দামোদারপুরে পাকিস্তানি বাহিনী সিরিজ হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। একই সাথে ৩২ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পরের দিন জুমার নামাজের সময় লাহিড়িরহাটের কাছে একটি মাঠে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় সাধারন মানুষদের। এ ঘটনায় মানুষ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে রংপুর। বিক্ষুব্ধ মানুষকে সংগঠিত করেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিদ্দিক হোসেন, আব্দুল গণি, তৈয়বুর রহমান (মরহুম), মজিবর রহমান, মুকুল মোস্তাফিজ, ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম


গোলাপ, মুখতার ইলাহী (শহীদ), মান্নান, আবুল মনসুর, ইসহাক চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল টুকু, ন্যাপ নেতা শামসুজ্জামান, কমিউনিস্ট নেতা ছয়ের উদ্দিনসহ আরো অনেকেই।
এরই মধ্যে চলতে থাকে জেলার প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে ক্যান্টনমেন্ট আর ইপিআর বাহিনীর কিছুসংখ্যক বাঙ্গালি অফিসারের সাথে গোপন যোগাযোগ। এক পর্যায়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে অবাঙ্গালি সৈন্যদের বন্দী করে ক্যান্টনমেন্ট দখল করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এই পরিকল্পনা ও অবাঙ্গালি সৈন্যদের গোপনে সংগঠিত করার গুরু দ্বায়িত্বটি পালন করেন রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ এবং ওয়ারলেস অপারেটর নুরুজ্জামান ও ইপিআর বাহিনীসহ ট্যাংক ডিভিশনের বাঙালি সৈন্যরা। কর্নেল ডাঃ. এম হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করে ওয়ারলেস অপারেটর নুরুজ্জামান সব খবর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের গোপনে পৌঁছে দিতেন। ধীরে ধীরে রংপুর উত্তপ্ত হতে থাকে।
কিন্তু ২৮ মার্চ যে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হবে তা আগে থেকে পরিকল্পিত ছিল না। তবে এতটুকু আলোচনা ছিল যে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হবে। সাধারণ মানুষের বিক্ষুব্ধতা ২৮মার্চ ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ২৬ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদার মোল্লা মাষ্টার সকাল বেলা শেখ আমজাদকে তার বাড়িতে এসে খবর দেন যদি বিক্ষুব্ধ বাঙ্গালিরা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে তা হলে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্যাংক ডিভিশন বেরিয়ে এসে অস্ত্রসহ বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ শুরু করবে। এ খবর পেয়ে অসীম সাহসী হয়ে উঠে গ্রামবাসী।
পাকিস্তানি সেনারা কিছু আঁচ করতে পেরেছিলো, একারণে সকল বাঙ্গালি সৈন্যদের ২৭মার্চ রাতে আটক রেখে অস্ত্র জমা নিয়ে রাত ৮টার দিকে ইপিআর ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ খবর বাইরে আসা মাত্রই গ্রামের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ তীর ধনুক-বল্লম, দা-কুড়াল আর বাঁশের লাঠি হাতে ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নিসবেতগঞ্জহাট ও তার আশপাশ এলাকাসহ ঘাঘট নদীর তীর ঘেষে জমায়েত হতে থাকে।বেলা বাড়ার সাথে সাথেই মিঠাপুকুরের বলদিপুকুর, রাণীপুকুর, বদরগঞ্জ, শ্যামপুর,  মানজাইল, তামপাট, পালিচড়া, রামজীবন, বনগাঁও, বুড়িরহাট, হারাগাছ, গংগাচড়া, দমদমা, লালবাগ, গনেশপুর, দামোদরপুর, দেওডোবা পাঠানপাড়া, পাগলাপীর, তারাগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকা থেকে মানুষ ক্যান্টনমেন্ট এলাকয় জমায়েত হতে থাকে হাজার-হাজার মূক্তি কামী মানুষ। শুরু হয় সম্মুখ লড়াই। সেদিন বলদিপুকুর এলাকা থেকে আসে ওঁরাও উপজাতিদের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বুদু ওঁরাও এর নেতৃত্বে কয়েক হাজার ওঁরাও। সবার মুখে ছিল গগনবিদারী স্লোগান ‘‘এস ভাই অস্ত্র ধর, ক্যান্টনমেন্ট দখল কর।’’ সাঁওতাল তীরন্দাজ বাহিনীরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিলো। এমন সময় বৃষ্টির মত ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি। অসম সেই লড়াইয়ে সেদিন পাক বাহিনীর ছোঁড়া মেশিন গানের গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েক শতাধিক লাশে সেখানে পড়েছিলো। এর মধ্যে কিছু মানুষের লাশ পাওয়া যায়। অন্যদের পাওয়া যায়নি। কিছু লাশ ক্যাম্পে পুড়িয়ে ফেলে হায়েনারা। সেই ঐতিহাসিক ২৮মার্চের স্মরণে এবং সেই সব বীর শহীদদের সম্মান জানিয়ে রংপুর শহরের

প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত মডার্ন মোড়ে শুধুমাত্র একটি স্মৃতিস্তম্ভ ‘‘অর্জন’’ নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ, এই দিনে ঠিক কত জন শহীদ হয়েছেন সে সম্পর্কে কোন অনুসন্ধানই আজও শুরু হয়নি।
রংপুর শহরের প্রবেশদ্বার মডার্ন মোড় দিয়ে শহরে প্রবেশের পথে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি উঁচু স্থাপনা, যা একটি স্মারক ভাস্কর্য। নীল আকাশের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে একটি লাল ও একটি ধূসর স্তম্ভ, বেশ উঁচু। সবুজ ঘাসের গালিচা, তার উপরে লাল ভিত্তি, তার উপরে ধবধবে সাদা আর নিকষ কালো বেদিমূলের উপরে খাড়া লাল ও ধূসর স্তম্ভ দু’টি। যেন রংপুর শহরে আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছে এই স্থাপনা। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে চোখে পড়বে কমলা রঙ্গের বাঁকানো ধনুকাকৃতি কাঠামো। একটু গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হবে পুরো ব্যাপারটা। আসলে লাল কালো স্তম্ভ দু’টি তীর, আর কমলা রঙ্গের বাঁকানো কাঠামোটি হচ্ছে ধনুক। এই ভাস্কর্যের নাম ‘‘অর্জন’’!
রংপুরেরই কৃতি সন্তান ও দেশ বরেণ্য ভাস্কর অনিক রেজার অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম এই ভাস্কর্য। এটাকে বলা হয়েছে ‘‘স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য’’। ১৯৯৯ সালের ২৪ জুলাই ভাস্কর্যটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অর্জন নামের এই ভাস্কর্যটি ধারণ করে আছে রংপুরবাসীর সব চাইতে গৌরবের ঘটনাটি। আজও রংপুর শহর ও শহরতলীর কোন প্রবীণ ব্যক্তিকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে, দেখা যাবে একথা সে কথা বলার সাথে সাথে অবধারিত ভাবে আসবে রংপুরে বীর জনতার ঐতিহাসিক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও প্রসঙ্গ ‘‘ও বাহে, কি কান্ডটায় না ঘটছিল বাহে, “বাউংকা-লাঠি, বল্লম-কোঁচা আর তীর ধনুক ধরি হামরা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কইবার গেছিনু” মিলিটারীর ঘরের মাইরবার, জয় বাংলা স্বাধীন কইরবার।’’
এদিকে ঐতিহাসিক নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে “রক্ত গৌরব” নামে স্মৃতিস্তম্ভটি যা আজও নিরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রতি বছর এই দিনে স্থানীয় জনগনের উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পালিত হয় ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস।
দিবসটি উপলক্ষ্যে জেলা প্রসাশন এবং ৬নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে শহরের উপকন্ঠে নিসবেতগঞ্জে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত রক্তগৌরবে দিনভর বিস্তারিত কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
এছাড়াও মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের মানুষের বীরত্বগাঁথা আজকের এই দিনটি ঘিরে বীর মুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয় ও কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম সমর্থক গোষ্ঠী বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেন কুরআন তেলওয়াত, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন, আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত,  আলোচনা সভা, ২৮শে মার্চ ১৯৭১ এর প্রামান্য দলিল ও স্থির চিত্র প্রদর্শণ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্শি এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রংপুর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, এ্যাড. রেজাউল করীম রাজু, মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি সাফিউর রহমান সফি, সাধারণ সম্পাদক

তুষার কান্তি মন্ডল, জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. ইলিয়াস আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান তুহিন, গনেশপুর বায়তুর মামুর জামে মসজিদের সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুর রইচ উদ্দিন আহমেদ, বিশিষ্ঠ সমাজ সেবক আলহাজ্ব আবু নূর মোহাম্মদ আহ্সান হামিদ ও ২২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান মিজু। 

পুরোনো সংবাদ

রংপুর 5735568191900606043

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item