ঠাকুরগাঁওয়ের তাঁতপল্লীতে অর্থের অভাব
https://www.obolokon24.com/2019/02/thakurgaon_10.html
আব্দুল আউয়াল,ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি : ঠাকুরগাঁওয়ের কিসমত কেশুরবাড়ি গ্রামে কান পাতলেই শোনা যেত তাঁতের খটখট শব্দ। বিভিন্ন বাড়িতে উঁকি দিলে দেখা যায়, আঙ্গিনায় কারিগররা নিপুণ হাতে বুনে চলেছেন কম্বল। এ তাঁতশিল্প এখানকার মানুষকে আর্থিক সচ্ছলতা দিয়েছিল। এখন সেই দিন অতীত। পুঁজির অভাবে তাঁতিরা এ ব্যবসায় আগের মতো আর বিনিয়োগ করতে পারছেন না। বেশির ভাগ তাঁতিই পুঁজি জোগাতে মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের সুদের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে সুদ পরিশোধেই চলে যাচ্ছে তাঁতির পুঁজির বড় অংশ।
সদর উপজেলার কিসমত কেশুরবাড়ি গ্রামের তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এখানে শুরু হয় তাঁতযন্ত্রের মাধ্যমে কম্বল তৈরির কাজ।গ্রামে প্রায় ৫০০ পরিবারের বসবাস। তাদের অধিকাংশই কম্বল বুননের কাজে জড়িত। তারা বলসুতা, পুরানো সোয়েটারের উল দিয়ে কম্বল, গায়ের চাদর, মাফলারসহ আরও অনেক কিছু তৈরি করেন।
খটখট শব্দে মুখরিত ঠাকুরগাঁওয়ের কেশুরবাড়ির তাঁতপল্লী। দিন-রাত শীতের কম্বল তৈরিতে এবার শীত কম হওয়ায় কম্বলের চাহিদা কম হওয়ায় সময় পার করছেন তাঁতি পরিবারের সদস্যরা। কম্বল কিনতে এরই মধ্যে গ্রামটিতে ভিড় জমাচ্ছেন পাইকাররা এবার নেই। তবে পুঁজির অভাবে চাহিদামতো কম্বল তৈরি করতে পারছেন না বলে জানান তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এখানকার ৫ শতাধিক পরিবারের প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ বংশানুক্রমে এখনও তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। তারা আগে শাড়ি-লুঙ্গি তৈরি করলেও বর্তমানে শুধু কম্বল তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই দুই থেকে ছয়টি পর্যন্ত তাঁত রয়েছে। এর কোনোটা চাকাওয়ালা, আবার কোনোটা একেবারেই বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরি। সকাল থেকেই বাড়ির নারী-পুরুষসহ সবাই লেগে পড়েন কম্বল তৈরির কাজে।
তাঁত কারিগর ধনেশ বলেন, শীত আসলে আমরা এই কম্বল তৈরি করে বিক্রয় করি আর সংসারের খরচ চালাই। কিন্তু গরমের সময় কম্বল তৈরি করার কাজ থাকে না। তখন শহরে গিয়ে রিকশা চালাতে হয় বা ইটভাটায় কাজ করতে হয়। কম্বল বিক্রয়ের টাকায় কিছু দিন ভালোভাবে চলা যায় তারপরে আবার কষ্ট শুরু। সরকার যদি কোন সহযোগিতা দিত তাহলে সারা বছর আমরা তাঁতের কাজ করতে পারতাম।
আরেক কারিগর সুরেন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘সুতার দাম এখন অনেক বেশি, কম্বলও বেশি বিক্রি হয় না। এলা মেশিনের কম্বল অনেক কম দাম দিয়া পাওয়া যাছে তাই হামার কম্বল কেহ নিবা চাহে না। এই কম্বল বিক্রির টাকায় কোনো মতে চলছে সংসারের খরচ।’
ছোট থেকেই বুননের কাজ করেন তাঁত কারিগর পরেন্দ্র দেবনাথ। বংশের সবাই এই কাজের সঙ্গে। বংশের চিহ্ন কষ্ট হলেও এই কাজ ধরে রাখতে চান তিনি। এতে প্রতিবন্ধক হয়ে আছে পুঁজির অভাব। এ প্রসঙ্গে পরেন্দ্র বলেন, আমাদের নিজের কোনো পুঁজি নেই। অর্থনৈতিকভাবেও আমরা এখনও সচ্ছল নই। ঋণ নিয়ে সুতা কিনে কম্বল তৈরি করছি। সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা পেলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
কম্বল কিনতে আসা একাধিক পাইকার বলেন, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়া হলে এই পুরনো দিনের শিল্পকে বাঁচানো যাবে বলে মনে করেন তারা। তাঁত কারিগরদের পুঁজি না থাকায় তারা বেশি সুদে ঋণ দিয়ে কম্বল তৈরি করে লাভবান হতে পারছেন না।
জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. তৈমুর রহমান বলেন, এখন তাঁতিদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা দরকার। এটা সরকারি তরফ থেকে যদি সহযোগিতা দেওয়া হয় তাহলে এই তাঁতি পরিবারগুলো তাদের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন।
ঠাকুরগাঁওয়ের তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক ড. কে এম কামরুজ্জামান সেলিম।