মহালয়া ঘিরে নীলফামারীর বিন্ন্যা দিঘির পাড়ে তিল তর্পনে সনাতন ধর্মের জলদান

বিশেষ প্রতিনিধি ৮ অক্টোবর॥
সনাতন ধর্মের আসন্ন শারদীয়া দুর্গাপূজার মহালয়া ঘিরে শুধু মন্ডবে মন্ডবে নয়, মন্ডবের বাহিরেও প্রকৃতির খোলা আকাশের নিচেও হিন্দু সংস্কৃতির রিতিনীতি পালন করা হয়ে থাকে। শারদীয় দুর্গাপূজার এক সপ্তাহ আগে দেবী দুর্গার আরাধনা বন্দনায় আজ সোমবার (৮ অক্টোবর) পালিত হলো মহালয়া।
মহালয়ার দিন ভোর হতে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের সঙ্গে একটি অমাবস্যা তিথি, এ তিথিতে সাধারণত পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ তিলতর্পণ বা পার্বন শ্রাদ্ধ করা হয়। এ দিন তর্পণ করলে পিতৃপুরুষরা নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে উত্তরসূরিদের  আশীর্বাদ প্রদান করেন। এছাড়া মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গার বোধন করা হয়। বোধন অর্থ জাগরণ। তাই মহালয়ার পর দেবীপক্ষের/শুক্লপক্ষের প্রতিপদে ঘট বসিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজার সূচনা করা হয়। তাই সনাতনের ধর্মের সদস্যদের  এদিন ঢল নেমেছিল নীলফামারী সদরের গোড়গ্রাম ইউনিয়নের বিরাটরাজার খননকৃত সেই বিন্ন্যাদিঘির পাড়ে।  নীলফামারী ছাড়াও পাশ্ববর্তী অন্যান্য জেলা হতেও সনাতন ধর্মের জড়ো হয় এখানে। বিন্ন্যাদিঘির পাড়ে তর্পণ দিয়ে শুরু হয়েছিল দিন। ঢাকে কাঠির শব্দে উৎসবের কাউন্টডাউন্ড শুরু হয়ে যায়। সেই সঙ্গে মন্ডবে মন্ডবে  পুজোয় প্রতীমার গায়ে রংতুলির আঁচর লাগালোও শুরু হয়ে যায়। প্রথমে মূর্তির চোখ আঁকেন প্রতীমা শিল্পীরা।  পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের শুরু হিসেবে দিনটিকে শুভ বলে গণ্য করা হয়।

বিন্ন্যা দিঘির (নীলসাগর) সনাতন সংঘের সাধারন সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা বাসুদেব রায় পুঁজোয় মূর্তির চোখ আঁকেন তিনি। তিনি জানালেন দুর্গাপুজোর সাতটি কল্প। যে কোনও একটি মেনে কেউ পুজো করতে পারেন। যার প্রথমটি শুরু হয় কৃষ্ণা নবমী থেকে। তিনি জানান পিতৃপক্ষে দুর্গাপুজোর সূচনা অশাস্ত্রীয় নয়। পিতৃপক্ষের তর্পণ স¤পর্কেও তাঁর অভিমত হল, আশ্বিন মাসে কৃষ্ণপক্ষের পনেরো দিন অর্থাৎ পনেরোটি তিথিতে (প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা) এই তর্পণ প্রশস্ত। তবে অধিকাংশ মানুষই কেবল মহালয়ার অমাবস্যায় এই তর্পণ করেন।

সোমবার নীলফামারী শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার অদুরে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজায় ৫৩ দশমিক ৯০ একর জমির ওপর  বিন্ন্যাদিঘি (নীলসাগর) গিয়ে দেখা যায় মহালয়া ঘিরে ভোর হতে সেখানে সনাতন ধর্মের সদস্যরা জড়ো হতে থাকে। সেখানে সকলেই তাদের প্রয়াত পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ তিলতর্পনে ব্যস্ত। খন্ড খন্ড করে দল বেঁধে তারা দিঘির পানিতে নেমে পুরহিতের সাহার্য্যে মহালয়ার পার্বণ শ্রাদ্ধ করছে।

এ সময় কথা হয় ৫ জন পুরোহিতের সঙ্গে। এরা হলেন বাবলু কুমার মজুমদার,প্রফুল্ল কুমার,প্রদীপ কুমার,দীলিপ কুমার চ্যাটার্জি ও বীরবল চক্রবর্তী। তারা সকলেই জানায় মহালয়া তর্পণ এবং পার্বণ শ্রাদ্ধের প্রশস্ত দিন। যা মহালয়া পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের তিথি। তবে ভারতকোষ গ্রন্থে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী মহালয়াকে পিতৃপুরুষের উৎসবের আধার বলে বর্ণনা করেছেন। মহৎ আলয় থেকে মহালয়ার উৎপত্তি। বলা হয়, পিতৃপুরুষেরা এই সময়ে পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন জল ও পিতৃলাভের আশায়। কোনও কোনও শাস্ত্রজ্ঞের অভিমত, প্রয়াত পিতৃপুরুষদের জল-পিন্ড প্রদান করে তাঁদের তৃপ্ত করা হলে সেই কাজ বা দিনকে শুভ বলে ধরে নেয়া হয়। তাই মহালয়ায় যে তর্পণ করা হয়, তা শুধুই পিতৃপুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দেব তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্য-পিতৃ তর্পণ ইত্যাদি করতে হয়। সঙ্গে থাকে রাম তর্পণ ও লক্ষ্মণ তর্পণ। সেখানে ত্রিভুবনে সমস্ত প্রয়াতকে জলদানের মাধ্যমে তৃপ্ত করার কথা বলা আছে। এমনকী তাঁদেরও উদ্দেশে তর্পণ করা হয়, জন্ম-জন্মান্তরে যাঁদের আতœীয়-বন্ধু কেউ কোথাও নেই। এই ভাবে যদি বিশ্বব্রহ্মান্ধে আতœীয়-অনান্তীয়, পরিচিত-অপরিচিত সকল প্রয়াতকে জলদান করে তাঁদের আতœতৃপ্তি সাধন করা হয়।
পুরহিতরা তাই জানালেন তারা খন্ড খন্ড করে দল করে সনাতন ধর্মের পরিবারে যাদের বাবা মা, ভাই বোন,আতœীয়স্বজনরা পরলোকগমন করেছেন তাদের নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে উত্তরসূরিদের  আশীর্বাদ প্রদান করতে  জলদান করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে দুর্গামাতার আগমনকে স্বাগত জানানো হয়। তাই তারা মহালয়ার এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানটিকে বলে থাকেন তিলতর্পন বা পার্বন শ্রাদ্ধ। যা প্রতিবছর পালন করা হয়ে থাকে।
সনাতন ধর্মের এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে এখানে এসেছিলেন তাদের মধ্যে কান্তিরাম রায়,বিনয় চন্দ্র রায়, জীতেন্দ্র রায় জানালেন তারা প্রতি বছর মহালয়া দিন বিন্ন্যাদিঘির জলে নেমে ত্রিভুবনে সমস্ত প্রয়াতকে জলদানের মাধ্যমে তৃপ্ত করেন।
উল্লেখ যে, নীলফামারীর বিন্ন্যাদিঘির জলভাগ ৩২.৭০ একর, এবং চারদিকের পাড়ের জমির পরিমাণ ২১ একর। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর কোন এক সময়ে এই দিঘির খননকাজ শুরু হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্রমতে, খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম হতে অষ্টম শতাব্দীতে পান্ডবরা কৌরবদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হন এবং মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানীর এ স্থানটিতে ছদ্মবেশে বসবাস শুরু করেন। মনে করা হয়, সেসময় নির্বাসিত পান্ডবদের তৃষ্ণা মেটাতে বৈদিক রাজা বিরাট এ দিঘিটি খনন করেছিলেন। বিরাট দিঘির অপভ্রংশ হিসেবে কালক্রমে এ দিঘিটি বিরাট দিঘি, বিন্ন্যা দিঘি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কারো কারো মতে, রাজা বিরাট তার বিশাল গরুর পালের জন্য পানির সংস্থান করতেই এ দিঘি খনন করেন এবং তার কন্যা বিন্ন্যাবতীর নামে এর নামকরণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে নীলফামারীর নামানুসারে বিন্ন্যা দিঘিকে নীলসাগর নামে পরিচিতি পায়।
এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এবার নীলফামারী জেলার ছয় উপজেলার ৬০ ইউনিয়ন,চারটি পৌরসভায় এ পর্যন্ত  ৮৫৭টি শারদীয় দূর্গাপূজার মন্ডপ তৈরি হয়েছে।  গতবার ছিল ৮৩৬টি।  এবার ২১টি মন্ডব বেশী। আবার ২০১৭ সালে মন্ডব ছিল ৮২২টি। সেই হিসাবে ৩৫টি বেশী মন্ডব হয়েছে।

পুরোনো সংবাদ

নীলফামারী 1466543998400466533

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item