বড়পুকুরিয়ায় খনিতে উধাও হওয়া কয়লা ঘাটতি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব

 উদ্বৃত্ত ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৩.৪৩ টন কয়লা


এম এ আলম বাবলু, পার্বতীপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ


পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া খনির উধাও হওয়া ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪.৪০ টন কয়লা ঘাটতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে তা অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। খনি পরিচালনা পর্ষদের ২৮৩ নম্বর সভায় প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হয়। একই সাথে ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৩.৪৩ টন কয়লা উদ্বৃত্ত হয়েছে বলেও পরিচালনা পর্ষদকে জানানো হয়।
এদিকে, পেট্রোবাংলার প্রাক্তন পরিচালক (খনি ও খনিজ/পরিকল্পনা) খনি বিশেষজ্ঞ মকবুল-ই-ইলাহী বলেন- উৎপাদন ও বিতরণ সম্পৃক্ত শিল্প-কারখানায় সিস্টেম লস যেমন আছে, ঠিক তেমনি বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে উত্তোলিত কয়লার ক্ষেত্রেও সিস্টেম লস অস্বীকার করার উপায় নেই। জ্বালানি তেল, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোনসহ সব খাতে স্বীকৃত সিস্টেম লস আছে। তাহলে কয়লার থাকবে না কেন। গত ১৪ বছরে ১ দশমিক ৪২ শতাংশ ঘাটতির যে হিসাব পাওয়া গেছে, তা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের খনির ঘাটতির তুলনায় খুবই কম। তবে কয়লা খনি কর্তৃপক্ষ কেন সিস্টেম লসের বিষয়টি মাথায় রাখল না। বোর্ড মিটিংয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে যদি ১.৫ শতাংশ সিস্টেম লসও ধরা হতো তবে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। তিনি আরও বলেন, কয়লাখনির কর্তকর্তাদের আর যাই বলুন চোর বলবেন না।
জানা গেছে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি উন্নয়ন কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। তখন থেকে চলতি বছরের ১৯ জুলাই পর্যন্ত ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২.৩৩ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। এরমধ্যে খনি উন্নয়নকালীন সময়ে (৯ সেপ্টেম্বর/ ২০০৫ পর্যন্ত) ১ লাখ ৭৮ হাজার ১৮০.৬০ টন, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থেকে ৫২ হাজার ৩৩৯.৭৪ টন, এয়ার রিটার্ণ রোডওয়ে থেকে ৮ হাজার ৬৩৫.০১ টন এবং ঠিকাদার কর্তৃক উৎপাদন ৯৭ লাখ ৭৪ হাজার ৪৪৩.৫৫ টন সবমিলে উত্তোলন করা হয় ১ কোটি ১৩ হাজার ৫৯৮.৯০ টন কয়লা। অবশিষ্ট ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৩.৪৩ টন কয়লা উদ্বৃত্ত। এ সময়ের মধ্যে পিডিবি’র নিকট ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৯.২৯ টন ও খোলা বাজারে ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ২৮০.৩৭ টন কয়লা বিক্রি করা হয় এবং খনির নিজস্ব ব্যবহার হয়েছে ১২ হাজার ৮৮.২৭ টন কয়লা। মোট বিক্রয় ও ব্যবহার ১ কোটি ১৮ হাজার ৩৯৭.৯৩ টন। এছাড়া মজুদ পাওয়া যায় (১৯ জুলাই পর্যন্ত) আনুমানিক ৩ হাজার টন। বিক্রয়, ব্যবহার ও মজুদ একত্রে দাড়ায় ১ কোটি ২১ হাজার ৩৯৭.৯৩ টন।
সুত্রমতে, খনির উৎপাদন ঠিকাদার ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৫ থেকে ১১ আগস্ট ২০১১ পর্যন্ত ৭১ মাসে প্রথমদফা চুক্তিকালীন ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪৬৩.৫৩ টন কয়লা উত্তোলন করে। ডিসেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত সারফেস কনভেয়র বেল্টে কয়লা পরিমাপের জন্য কোন ওয়েইং স্কেল বসানো ছিল না। ওয়েইং স্কেল বসানোর আগে উৎপাদিত কয়লা ভু-গর্ভে  ইনসিটু অবস্থানর আয়তনকে (ফেইস মেজারমেন্ট) ১.৪৩ ঘনত্ব ধরে কয়লা পরিমাপ করে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়। এতে করে ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৩.৪৩ টন কয়লা উদ্বৃত্ত হয়। যা পরবর্তী সময়ে মজুদ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
খনি কর্তৃপক্ষের দাবি, উদ্বৃত্ত ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৩.৪৩ টন কয়লা যদি তারা চুরি বা আতœসাত না করে থাকে যার উৎপাদন বিল পর্যন্ত ঠিকাদারকে প্রদান করতে হয়নি। তাহলে তার চেয়ে কম ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪.৪০ টন কয়লা তারা চুরি করতে যাবে কেন। এটি সিস্টেম লস।
সুত্রমতে, খনির উৎপাদন, বিক্রয়, ব্যবহার ও মজুদের বাস্তব পরিমাপের আলোকে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪.৪০ টন কয়লাকে ঘাটতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত এবং প্রতিটন কয়লার মুল্য ৭ হাজার ৮৩০ টাকা (উৎপাদন খরচ) হিসেবে মোট ১১৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। খনির নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ফজলুর রহমান এবং জেনারেল ম্যানেজার (মাইন অপারেশন) সাইফুল ইসলাম প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য গত ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত খনি পরিচালনা পর্ষদের ২৮৩ নম্বর সভায় তা উপস্থাপন করেন।
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে দু’জন খনি বিশেষজ্ঞ জানান- খনির ফেইস থেকে কয়লা উত্তোলন ও পরিবহন  এবং দীর্ঘ সময় ধরে স্টকইয়ার্ডে ফেলে রাখার কারণে অক্সিডেসন, ংঢ়ড়হঃধহবড়ঁং পড়সনঁংঃরড়হ (স্বতোদহন) জনিত কয়লা ঘাটতি হতে পারে। তাছাড়া শুধু বড়পুকুরিয়া খনিতে নয় বিশ্বের অধিকাংশ কয়লাখনির ফেইস থেকে কয়লা কাটার সময় প্রচুর কোল-ডাস্ট উৎপন্ন হয়, যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সার্বক্ষণিক পানি স্প্রে করতে হয়।স পানি স্প্রে করে কোল-ডাস্ট নিয়ন্ত্রণ না করলে খনি শ্রমিকদের নিউমোকোনিওসিস ও সিলিকোসিস নামক জটিল রোগ হয়। ফেইস থেকে কয়লা কাটার সময় ব্যবহৃত পানির একটি অংশ কয়লার সঙ্গে মিশে যায় এবং পরিবহনের জন্য বেল্ট কনভ্যেয়রে অনেক সময় হালকা পানির স্প্রে করতে হয়। বড়পুকুরিয়া বেসিনের কয়লার মধ্যে অন্তর্নিহিত আদ্রতা (রহযবৎবহঃ সড়রংঃঁৎব) হিসেবে শতকরা প্রায় ৫.১০ ভাগ পানি রয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে ভূগর্ভস্থ ফেইস থেকে ভূপৃষ্ঠে কয়লা উত্তোলন পর্যন্ত সময়ে কয়লার আর্দ্রতা কমতে শুরু করবে এবং ওজন হ্রাস পাবে। এছাড়া দিনের বেলায় সূর্যের প্রচন্ড তাপদাহে কয়লার স্টকইয়ার্ডে আগুন লেগে যাওয়া স্বাভাবিক দহন, স্বতোদহন বিশ্বব্যাপী একটি সাধারণ ঘটনা যা কয়লার ওজন হ্রাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বড়পুকুরিয়ার স্টকইয়ার্ডে অগ্নিকান্ডের ঘটনাও ঘটেছে। স্টকইয়ার্ডে যথাযথভাবে কয়লা কমপ্যাক্ট করে রাখা না তাহলে স্বতোদহন জনিত কারণে ১২.৫ শতাংশ পর্যন্ত ওজনে ঘাটতি হতে পারে। এতে করে স্টকইয়ার্ডে সংরক্ষিত কয়লার ওজনের সঙ্গে অফিসিয়াল রেকর্ড বইয়ে ওজনের পার্থক্য দেখা দিবে। ওআইএমএল (ঙওগখ-ঞযব ঙৎমধহরুধঃরড়হ ওহঃবৎহধঃরড়হধষব ফব গবঃৎষড়মরপ খবমধষব)-এর মতে বেল্ট ওয়েইং স্কেলের কারণে কয়লার ওজনে ০.৫ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত পার্থক্য হতে পারে।
বড়পুকুরিয়া খনিতে দুটি ধাপে বেল্ট ওয়েইং স্কেলের মাধ্যমে কয়লার ওজন পরিমাপ করা হয়। প্রথম ধাপে স্কিপ শ্যাফটের কাছে সারফেসে স্থাপিত বেল্ট ওয়েইং স্কেলে কয়লা পরিমাপের পর কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে পরিবহন করে স্টকইয়ার্ডে নিয়ে রাখা হয়। মজুদকৃত কয়লা দীর্ঘদিন ধরে স্টকইয়ার্ডে উন্মুক্ত বাতাসে ফেলে রাখা হয় তাহলেও কয়লার মধ্যে বিদ্যমান অন্তর্নিহিত আদ্রতা শুকিয়ে যাবে এবং ওজনের তারতম্য ঘটবে।
দ্বিতীয় ধাপে খনির স্টকইয়ার্ডে স্থাপিত বেল্ট ওয়েইং স্কেলে কয়লার ওজন নিরূপণ করে কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে পরিবহন করে খনির স্টকইয়ার্ড থেকে বড়পুকুরিয়ার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে যাওয়া হয়। দুটি ধাপে বেল্ট ওয়েইং স্কেলের কারণেও কয়লার ওজনে ০.৫ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত পার্থক্য হতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে এটি স্পষ্ট যে, কোল ফেইস থেকে কয়লা কাটার পর তা ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত উত্তোলনের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে স্টকইয়ার্ডে  নিয়ে যাওয়া ও মজুদ কয়লা থেকে ক্রমান্বয়ে অন্তর্নিহিত আদ্রতা শুকিয়ে কয়লার ওজন হ্রাস পাওয়া, স্টকইয়ার্ডে স্বতোদহন জনিত কারণে কয়লার ওজন ২ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাওয়া এবং বেল্ট ওয়েইং স্কেলের কারণে কয়লার ওজনে ০.৫ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত পার্থক্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া খোলা বাজারে ট্রাকে করে ওয়েইং স্কেলে মেপে কয়লা বিক্রি করা হয়। একাধিক স্কেলে পরিমাপের সময় যান্ত্রিক কারণেও ওজনে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে।
ভারতের কয়লা খনির সিস্টেম লস কম-বেশি পাঁচ শতাংশ। এরমধ্যে পাঁচ শতাংশের কম লস খনি কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করবে। পাঁচ শতাংশের বেশি হলে সরকারের সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। স্পেনে উন্মুক্ত ইয়ার্ডে মজুদ কয়লার ১২ শতাংশ সিস্টেম লসের বৈধতা রয়েছে। চীন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতেও উত্তোলিত কয়লার সিস্টেম লসের বিধান রয়েছে। গত ১৭ বছরেও দেশে কয়লা খনি পরিচালনার কোনো নীতিমালা তৈরি করা হয়নি। ভারত, চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খনির সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত জুলাই মাসের দ্বিতীয়ার্ধে বড়পুকুরিয়া খনির কোলইয়ার্ড পুরোপুরি খালি হলে প্রায় ২৩০ কোটি টাকার ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪.৪০ টন কয়লা ঘাটতির হিসাব বেরিয়ে আসে। খনির এমডিসহ ১৯ কর্মকর্তার নামে দূর্নীতি দমন আইনে ২৪ জুলাই পার্বতীপুর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছে দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

পুরোনো সংবাদ

নির্বাচিত 4935667092793826281

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item