ঈদের ছবিতেও লোকসান, সৈয়দপুরে সিনেমা হল ব্যবসায় দূর্দিন


তোফাজ্জল হোসেন লুতু, সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি:
নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরে সিনেমা হল ব্যবসায় চরম দুর্দিন চলছে। এক সময়ে এ উপজেলা শহরটিতে চারটি সিনেমা হল ছিল। দর্শকের অভাবে শহরের তিনটি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। বর্তমানে শুধুমাত্র একটি সিনেমা হল কোন রকমে চালু রয়েছে। তাও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লোকসান দিয়ে। সেটিও যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে,সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত টেকনিশিয়ান, সুপারভাইজার, টিকিট মাষ্টার, নাইটগার্ডসহ প্রায় শতাধিক পরিবার পথে বসেছে। যাদের মধ্যে বর্তমানে অনেকই বেকার আবার কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে বেঁচে নিয়েছে অন্য পেশা। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় তাতেও তারা ভাল করতে পারছেন না।
উত্তর জনপদের নীলফামারীর বাণিজ্য প্রধান ও শ্রমিক অধ্যূষিত উপজেলা শহর সৈয়দপুর। এক সময় এ শহরটিতে বিজলী টকিজ, লিবার্টি, গ্যারিসন, তামান্নাসহ  চারটি সিনেমা হল ছিল। আর এসব সিনেমা হলের প্রতিটি ‘শো’ পরিপূর্ণ থাকতো দর্শকে। ঘিঞ্জি শহরের মানুষ ছাড়াও প্রত্যন্ত পল্লীর সব বয়সী মানুষ সিনেমা দেখতে ভীড় করতো সিনেমা হলগুলোতে। সিনেমা হলে প্রবেশের টিকিট সংগ্রহে দর্শকদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলতো। সিনেমা হলগুলোতে দর্শকদের উপচেপড়া ভীড়ে দম বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। সপ্তাহের প্রতিটি দিনই জমজমাট থাকতো সিনেমা হলগুলো। অনেকে আবার সিনেমা হলের টিকিট সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে সিনেমা দেখতে না পেরে নিরাশ হয়ে ফিরে যেতেন। দর্শকদের চাহিদার কারণে অনেক বাংলা ছায়াছবি মাসের পর মাস চলতো শহরের সিনেমা হলগুলোতে। তারপরও দর্শকদের কোন কমতি ছিল না। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। বর্তমানে ভাল জীবনকাহিনী ও মানসম্পন্ন বাংলা ছায়াছবি সংকট, কেবল টিভি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, আকাশ সংস্কৃতি, দেশীয় একাধিক টিভি চ্যানেল, ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অনেক সিরিয়াল প্রচারিত হওয়ায় মানুষ সিনেমা হলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এ সব নানাবিধ কারণে মানুষ আর সিনেমা হলমুখী হচ্ছেন না। ফলে দর্শকদের অভাবে একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে দুই হাজার সালের পর থেকে সৈয়দপুরে সিনেমা হল ব্যবসায় ধস নামে। সৈয়দপুর শহরের চারটি সিনেমা হলের মধ্যে তিনটিই বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। শহরের অভিজাত সিনেমা হল ছিল ‘বিজলী টকিজ’। ওই সিনেমা হলটিতে “ছুটির ঘন্টা” ছায়াছবিটি কয়েক মাস ধরে চলে। তারপরও দর্শকদের ভীড় ছিল চোখেপড়ার মতো। কিন্তু বাস্তব চিত্র এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। দর্শক সংকটে বিজলী টকিজ এখন বন্ধ। সেখানে বর্তমানে গড়ে তোলা হচ্ছে অত্যাধিক সুপার মার্কেট ‘চৌধুরী টাওয়ার’। যদিও এ টাওয়ারের মালিক পক্ষের সেখানে একটি সিনেমা হল করার পরিকল্পনায় রয়েছে। একই অবস্থা লিবার্টি সিনেমা হলেরও। এটি শহরের প্রাচীনতম ও ঐহিত্যবাহী  সাহিত্য - সাংস্কৃতিক সংগঠন সৈয়দপুর শিল্প সাহিত্য সংসদের। তবে সেটি ভাড়ায় নিয়ে সিনেমা হল হিসেবে চলতো। বর্তমানে সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে একটি সুপার মার্কেট। আর সৈয়দপুর সেনানিবাসের গ্যারিসন সিমেনা হলটিও বন্ধ করে সেখানে সেনা কমিউনিটি সেন্টার করা হয়েছে। গত ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ওই তিনটি সিনেমা হল পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে পড়ে। বর্তমানে ‘নীল ধন সবে মনি’ হয়ে আছে একমাত্র শহরের শের-এ-বাংলা সড়কের তামান্না সিনেমা হল। এটি ভাড়ায় নিয়ে চালাচ্ছেন জনৈক মাহবুব আলী ঝন্টু। দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সিনেমা হল ব্যবসায় জড়িত তিনি ও তার পরিবার। গত শনিবার রাতে তামান্না সিনেমা হল চত্বরে সিনেমা ব্যবসার বর্তমান অবস্থা নিয়ে দীর্ঘ সময় কথা হয় তার সঙ্গে এ প্রতিনিধি’র। তিনি অনেক দিন ধরে এ সিনেমা হল ব্যবসায় জড়িত। তিনি (ঝন্টু) বলেন, সিনেমা হল ব্যবসা এখন আর নেই। এখন হল ব্যবসায় লোকসান চলছে।
 তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে আগের মতো ভাল ছবি তৈরি হচ্ছে না। ফলে সিনেমা হলে এখন আর আগের তেমন দর্শক হয় না। কিন্তু প্রতি মাসে সিনেমা হল ভাড়া, কাস্টমস্ ভ্যাট, পৌর কর, কর্মচারী, বিদ্যূৎ বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে হচ্ছে। এভাবে লোকসান দিয়ে কি আর হল ব্যবসায় করা সম্ভব। তিনি জানান, গেল  ঈদুল আযহা উপলক্ষে সাকিব খানের “ ক্যাপ্টেন খান” ছবি এনেছি। দুই সপ্তাহ গত হল।  সিনেমা হলে তেমন আশানুরূপ দর্শক আসেনি। এরপরও তো সিনেমা হল ভাড়া, বিদ্যূৎ বিল, কাস্টমস্ ভ্যাট, পৌর কর ও কর্মচারী বেতন রয়েছে। তিনি বলেন, আগে ভাল ভাল বাংলা ছায়াছবি তৈরি হতো। ফলে মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে সিনেমা হলে আসতো ছবি দেখতে। তখন মানুষের চিত্র বিনোদনের বড় মাধ্যম ছিল চলচিচত্র অর্থাৎ সিনেমা। মানুষ দলে দলে সিনেমা হলে আসতো। সিনেমা  ব্যবসা  অনেক ভাল হতো।
 সৈয়দপুরের সংস্কৃতিকর্মী শেখ রোবায়েতুর রহমান  রোবায়েত বলেন, সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখবেন সে অবস্থা আর এখন আছে ? এখনকার বাংলা চলচ্চিত্রগুলোতে কোন ভাল কাহিনী নেই। শুধু অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ। মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ ও কাহিনী নির্ভর ছবি তৈরি  হচ্ছে না। তাছাড়া এখন সিনেমায় যে ধরনের অশ্লীলতা পরিপূর্ণ। সে সব আর তা পরিবারের  সকল সদস্যদের নিয়ে এক সঙ্গে দেখা সম্ভব হয়না। ফলে মানুষ সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
 বিজলী সিনেমা হলের গেটম্যান  মো. বাবু বলেন, অনেকদিন ধরে সিনেমা হলে কাজ করেছি।  মানুষ এখন আর সিনেমা দেখতে আসেন না। তাই মালিক হল বন্ধ করে সেখানে বহুতল মার্কেট তৈরি করছেন। আমার মতো অনেকেই আজ বেকার হয়ে পড়েছি। অন্য পেশায়র অভিজ্ঞতা না থাকায় কাজও  মেলাতে পারছি না। পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব বেকায় পড়েছি।
 বিজলী সিনেমা হলের ম্যানেজার ছিলেন মো. খায়রুল আলম। বর্তমানে হল বন্ধ হওয়ায় সম্পূর্ণ বেকার তিনি। তিনি বলেন, অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন সিরিয়াল মোবাইল ফোনে ডাউনলোড করে ঘরে বসে দর্শকরা নিয়মিত বাংলা ছবি দেখছেন। পাশাপাশি ভারতীয় সিরিয়ালের কাছে দেশীয় সিনেমা অনেকটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে। তাই দর্র্শকরা সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় হলগুলো বন্ধ হয়ে পড়ছে। 

পুরোনো সংবাদ

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি 2079038850948008584

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item