পীরগাছায় আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে ১৯ বছরে ৭ জনের মৃত্যু
https://www.obolokon24.com/2018/03/pirgasa.html
পানিতে কার্বামেট ও অর্গানো ফসফেট জাতীয় বিষ
ফজলুর রহমান,পীরগাছা(রংপুর):রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকসহ কার্বামেট ও অর্গানো ফসফেট জাতীয় বিষের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ১৯ বছরে মারা গেছে সাত জন। এ ছাড়া শতাধিক লোক এ রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের আওতাধীন পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, ওই প্রতিষ্ঠানের একদল বিজ্ঞানী রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় পানিতে কার্বামেট ও অর্গানো ফসফেট জাতীয় বিষের অস্তিত্ব পান। ভূউপরিস্থ পানির ২৪টি নমুনা এবং পাঁচটি গভীর নলকূপের পানি পরীক্ষা করে তাতে উচ্চ মাত্রার কার্বামেট ও অর্গানো ফসফেট জাতীয় রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এর মধ্যে ধানক্ষেতের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত কার্বোফুরান ও কার্বোরিলের উপাদান মেলে। অন্যদিকে খাবার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ও নাইট্রেট পাওয়ার নজির আছে।পাঠক শিকড় গ্রামের আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত আসাদুল ইসলাম (৩০) জানান, তাঁর বাড়িতে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ নেই। ফলে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে তাঁর বাবা মেনাজ উদ্দিন আর্সেনিকোসিস রোগে পঙ্গু হয়ে পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। বর্তমানে তিনিও আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারছেন না।
আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত তছলিম উদ্দিন বকসি বলেন, ‘প্রথম দিকে স্বাস্থ্য বিভাগের লোক এসে ওষুধ দিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের মরণ ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
কান্দি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান বলেন, পাঠক শিকড় গ্রামে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। সেখানে সরকারিভাবে পাঁচটি নলকূপ বিতরণ ছাড়া অন্য কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। বর্তমানে এ গ্রাম ছাড়াও দাদন, কাবিলাপাড়, দোয়ানী মনিরাম ও মনিরামপুর গ্রামে আর্সেনিকের ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাঠক শিকড় গ্রামের নারীরা জগ, কলসি ও বালতিতে করে দূর থেকে আর্সেনিকমুক্ত পানি আনছেন।
গৃহবধূ আনোয়ারা বেগম, হাসিনা বেগম ও মরিয়ম বেগম জানান, প্রতিদিন দূর থেকে পানি আনতে তাঁদের বেশ কষ্ট হয়। টাকার অভাবে তাঁরা বাড়িতে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ বসাতে পারছেন না।
গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ওই গ্রামের বাবলু মিয়া, তছলিম উদ্দিন বকসি, আবদুল হামিদ, আসাদুল ইসলাম, আবদুল করিম, মফিজ উদ্দিন, আবদুর রহমান, হামিদ আলী, আবদুর রহিম ও আনোয়ারা বেগমসহ শতাধিক ব্যক্তি আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত। তাঁদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কার্যালয় ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে পাঠক শিকড় গ্রামের আবদুর রহমান ও হামিদ আলীর বাড়ির নলকূপের পানিতে প্রথম সহনীয় মাত্রার অধিক আর্সেনিক ধরা পড়ে। ওই দুটি পরিবারের ১১ ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে পরীক্ষা করে তাদের শরীরে আর্সেনিকোসিস রোগের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এ ঘটনার পর স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ওই গ্রামের ২৯৮টি পরিবারের ১৬৮টি নলকূপের পানি পরীক্ষা করে ৭৫টিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের সন্ধান পায় এবং ৫৩ জন আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে মারাত্মক আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত ১২ জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর ১৯ বছরে তাঁদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ওয়াজেদ আলী, নজিনা বেগম, নুরুল ইসলাম, এন্তাজ আলী, তাঁর ছেলে জব্বার আলী ও আব্বাস আলী এবং মেনাজ উদ্দিন মারা যান। ওই এলাকায় আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহে রংপুর জনস্বাস্থ্য বিভাগীয় দপ্তর থেকে তিনটি এবং গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ থেকে দুটি তারা পাম্প বিনামূল্যে বসানো হলেও তা পর্যাপ্ত আর্সেনিকমুক্ত নয়।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবু আল হাজ্জাজ বলেন, পানি ফুটিয়ে সাধারণ জীবাণুমুক্ত করা গেলেও রাসায়নিকের দূষণমুক্ত করা যায় না। ফলে রাসায়নিকের দূষণযুক্ত পানি বিপদ বয়ে আনবেই। আর অতিমাত্রার আর্সেনিকযুক্ত পানি মানবদেহের জন্য যেমন মারাত্মক ক্ষতিকর, তেমনি গবাদিপশুর জন্যও ক্ষতির কারণ।