নতুন প্রজন্মের কাছে অজানাই রয়ে গেছে পাড়ঘাট বধ্যভূমির কথা

মোঃ মোজাহারুল আলম জিন্নাহ্ রানা-

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও নতুন প্রজন্মের কাছে অজানাই রয়ে গেছে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলা সদরের চীন মৈত্রী সেতু সংলগ্ন পাড়ঘাট বধ্যভূমির কথা। সম্প্রতি সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী আর একটি স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহযোগিতায় স্থানীয় প্রশাসনের নজরে আসে ওই বধ্যভূমি । সেদিনের শহীদ স্বজনরা প্রশাসনের কাছে কেবল সহযোগিতা নয় ওই বধ্যভূমি সংরক্ষণসহ শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি চেয়েছেন।
সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের গুলি লাগলেও বেঁচে যান উপজেলার সোনাহার ইউনিয়নের মল্লিকাদহের কলিন্দ্রনাথ রায় (৭০)। একই সাথে ওই এলাকার কাঞ্চবালার মতো অনেক নারীকেই চোখের সামনে স্বামীর হত্যাকান্ড দেখতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সারা দেশের মতো উত্তাল ছিল দেশের সর্ব উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়। ভিটেমাটি ছেড়ে দলে দলে মানুষ ছুটে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের দিকে। সে সময়ে শরনার্থী শিবিরে টিকতে না পেরে অনেকের মতো আবার নিজের জন্মভূমি দেবীগঞ্জের মল্লিকাদহে ফিরে আসতে থাকেন হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি দল। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা দেবীগঞ্জ করতোয়া নদীর পাড়ে তাদের আটক করে। সেদিন ছিল ২ জুন। ওই দলে নারী শিশুসহ প্রায় ২০/২৫ জন হিন্দু লোক ছিল। পরে একটি বাড়িতে আটকে রাখা হয় নারী ও শিশুদের। আর পুরুষদের সারিবদ্ধভাবে বেঁধে করতোয়ার বালুচরে নিয়ে একসাথে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওইদিনের সেখানেই দাফন করা হয় বাবা ছেলেসহ ১১ জনের লাশ। ভাগ্যক্রমে গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান ওই দলের কলিন্দ্রনাথ। ওই দিন তৎকালীন স্থানীয় থানার পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাদেরকেও ওই পাড়ঘাটের কাছেই হত্যা করে পাকসেনারা। এছাড়া করতোয়ার ওই স্থানে বিভিন্ন সময়ে বাঙালিদের ধরে এনে চলতো নারকিয় হত্যাকান্ড। 
স্বাধীনতা ৪৬ বছর পরেও আজও অজানাই রয়ে গেছে করতোয়ার ওই পাড়ঘাট এলাকার বধ্যভূমির কথা। এছাড়া সেদিনের বালুচর এখন নদীতে পরিণত হয়েছে। বিলীন হয়ে গেছে সব চিহ্ন। এতদিন গুলিবিদ্ধ কলিন্দ্রনাথ ও শহীদ স্বজনরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও কোন লাভ হয় নি। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু পরিষদ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের নজরে আসে। 
সম্প্রতি দেবীগঞ্জের পাড়ঘাট বধ্যভূমির ঘাটে বসেই সেদিনের স্মৃতিচারণ করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
পাকসেনাদের গুলিতে বেঁচে যাওয়া কলিন্দ্রনাথ জানান, আমরা ভারত থেকে ফিরছি এ কথা রাজাকারেরা খানসেনাদের বলে দেয়। খানসেনারা আমাদের করতোয়ার ঘাটের কাছে আটক করে একটি হিন্দু বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই বাড়ির সবাই ভারতে চলে গেছে। সেখানে পুরুষদেরকে আলাদা করে রাখে মহিলা আর শিশুদের আলাদা করে রাখে। পরে আমাদের সবাইকে একটি দঁড়ি দিয়ে বেঁধে পাড়ঘাটের কাছে করতোয়ার চরে নিয়ে যায়। সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করতে থাকে। একটি গুলি আমার হাতে লাগে। অন্যদের ভারে আমি মাটিতে পড়ে যাই। ওরা সবার লাশের সাথে আমাকেও মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যায়। সেদিনের কথা আজও আমি ভুলতে পারিনা।
শহীদ রমেশ চন্দ্র রায়ের স্ত্রী কাঞ্চবালা জানান, ভরতের শরনার্থী শিবিরে ডায়েরিয়া কলেরায় ছড়িয়ে পড়ছিল। আমরা ভাবলাম মরবো তো  নিজের জন্মভিটাতেই মরবো।  ফেরার পথে আমাদেরকে খানসেনারা ধরে বর্তমান করতোয়া সেতুর পশ্চিম পাড়ের একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে একজন বাঙালি পাকিস্তানিদের হাত থেকে পালিয়ে যায়। আমি আমার স্বামীকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করি। কিন্তু তিনি আর পালাতে পারেননি। চোখের সামনেই তাকে খানসেনারা গুলি করে হত্যা করেছে। লাশটাও নিয়ে যেতে পারিনি। এখন সরকার যদি আমাদের শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তাহলে মরেও শান্তি পাবো।
নিহতের স্বজনদের দাবি পাড়ঘাটে বধ্যভূমির কাছে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ এবং তাদের শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দান।
দেবীগঞ্জ বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী জানান, প্রত্যক্ষদর্শীরা বিষয়টি আমাদের অবহিত করেন। এরপরই আমরা বিভিন্নভাবে প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে ওই বধ্যভূমি সংরক্ষণসহ শহীদ পরিবারগুলোকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আবেদন জানাই। পরে পাড়ঘাট বধ্যভূমিটি স্থানীয় প্রশাসনের নজরে আসে।
দেবীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহসভাপতি গিয়াস উদ্দিন জানান, দীর্ঘদিন পরে হলেও আমরা এই পাড়ঘাটের বধ্যভূমির কথা জানতে পেরেছি। আমরা চাই এই বধ্যভূমির কাছেই একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হোক এবং ওই শহীদ পরিবারগুলোকে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক।
দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফিরোজুল ইসলাম পাড়ঘাট বধ্যভূমিটি পরিদর্শন করে জানান, এতোদিন আমরা এই বধ্যভূমির কথা জানতেই পারিনি। সেদিনের নির্মম হত্যাকান্ডের সাক্ষী এই পাড়ঘাট বধ্যভূমি। তবে সেদিনের  বধ্যভূমিটি এখন আর বালুচর নেই নদীতে পরিণত হয়েছে। এ সময় তিনি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাড়ঘাটের কাছেই একটি স্মৃতিফলক নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস  দেন।

পুরোনো সংবাদ

পঞ্চগড় 1166516918901715347

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item