বিলুপ্ত ছিটমহলের দ্বিতীয় বর্ষপূতি পালিত



ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়, নীলফামারী ১ আগষ্ট॥
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষপুর্তি পালন করেছে নীলফামারীর বিলুপ্ত চারটি ছিটমহলের মানুষজন। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে নানা আয়োজনে দিনটি পালনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষজন। আয়োজনের মধ্যে ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, র‌্যালী, আলোচনা সভা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ১ মিনিটে ঘরে ঘরে দুইটি করে মোমবাতি প্রজ্জলিত করা হয়েছিল। 


নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার চার বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী একত্রিত হয়ে পশ্চিম খড়িবাড়ি শহীদস্মৃতি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে।
এরপর সকাল ১১টার দিকে সেখান থেকে একটি আনন্দ শোভাযাত্রা এলাকার প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় সকলে বিলুপ্ত ছিটবাসীর মুখে শ্লোগান ছিল শেখ হাসিনা মা জননী, আমরা তার মুক্তিসেনার দল। র‌্যালী শেষে একই গ্রামের ইসলামিক ফাউ-েশন কর্তৃক পরিচালিত প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আলোচনা সভায় মিলিত হয়। 
এসময় শহীদ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ময়েন উদ্দিনের সভাপতিত্বে বক্তৃতা দেন গয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরীফ ইবনে ফয়সাল মুন, বিলুপ্ত ছিটমহল ২৮ নম্বর বড়খানকি গ্রামের সভাপতি ফরহাদ হোসেন, ২৯ নম্বর বড়খানকি খারিজা গিদালদহ গ্রামের সভাপতি মিজানুর রহমান, ৩০ নম্বর বড় খানকি খারিজা গিতালদহ গ্রামের সভাপতি আব্দুল খালেক এবং ৩১ নম্বর নগরজিগাবাড়ি গ্রামের সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। এরপর সেখানে ইসলামী ফাউন্ডেশনের পক্ষ হতে বিভিন্ন ইসলামী পুস্তক শিশুদের মাঝে বিতরন করা হয়। 
এ ছাড়া বিকালে অনুষ্ঠিত হয় ক্রীড়া প্রতিযোগীতা ও বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 
এদিকে সীমানা জটিলতায় উচ্চ আদালতে মামলা থাকার কারণে নীলফামারী ডিমলা উপজেলার গয়াবাড়ি, খগাখড়িবাড়ি ও টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের নির্বাচন স্থাগিত রয়েছে। ফলে তিন ইউনিয়নের ভোটারগন গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ছিটমহল বিলুপ্ত হবার পর খগাখড়িবাড়ি অংশের ২৮ নম্বর সাবেক ছিটমহলের সীমানা গয়াবাড়ি ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে দেয়া হয়। সীমানা সঠিক হয়নি উচ্চ আদালতে রিট করেন খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন।
সূত্র জানায়, ওই উপজেলায় চারটি ছিটমহল রয়েছে। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ছিটমহলগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। ওই চার ছিটমহল উক্ত তিন ইউনিয়নের সঙ্গে একিভুত। এর মধ্যে খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের সঙ্গে থাকা ২৮ নম্বর সাবেক বড়খানকী ছিটমহলটি গয়াবাড়ি ও টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। ফলে খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন এ ঘটনায় উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন (১৯২২/২০১৬) দায়ের করেন। 
মামলা বাদী জানান, সম্প্রতি উচ্চ আদালত মামলার রায় তার পক্ষে দিয়েছে। নতুন করে সীমানা জটিলতা দুর করে ভোটার কার্যক্রম সঠিক করার জন্য আদালত নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন নতুনভাবে সীমানা ঠিক করে দিলেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
অপর দিকে বিলুপ্ত ছিটমহলের নয়াবাংলা গ্রামের সফিকুল ইসলাম বলেন, নাগরিক হইনো, কিন্তু চেয়ারম্যান-মেম্বারের ভোট দিবার পারিনো না, এইটাতে মনটা একনা খারাপ আছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সহ সকল নির্বাচনে আমরা যাতে ভোটাধীকার প্রয়োগ করতে পারি সেইটার জন্য সরকারের কাছোত হামার আবেদন থাকিল।
২৮ নম্বর বড়খানকি গ্রামের সভাপতি ফরহাদ হোসেন বলেন দেখতে দেখতে ৭৩০ টি দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। ৬৮ বছরের বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার দুই বছর। তিনি বলেন দেশ পরিবর্তনের সময় আমি ভারতের চলে যাওয়ার জন্য নাম লিখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মা ও পরিবার বাজি হয়নি। এ নিয়ে পরিবারের সঙ্গে আমার বিবাদ হয়েছিল। পড়ে ভারতে না গিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহন করি। তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন এখন দেখছি ভারতে না গিয়ে অনেক ভাল করেছি। খবর পেয়েছি যারা গেছে তারা সেখানে ভাল নেই। তাদের মধ্যে অনেকে চোরাপথে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। তিনি বলেন আমরা খবর নিয়ে জানতে পেরেছি দেশ বদল করে ভারত গেছে তাদের  অস্থায়ী ক্যা¤েপ এখনও কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে। নোংরা পরিবেশ; পানীয় জলের সংকট; চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। কোচবিহার জেলার দিনহাটা, মেখলীগঞ্জ, হলদিবাড়ী  তিন মহকুমায় তিনটি ক্যা¤েপ ৯২৬ জন রয়েছে। এদের মধ্যে দুইজন মারা গেছে। আমরা যারা বাংলাদেশে রয়ে গেছি তারা অনেক অনেক ভাল আছি। আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ঋনী। তিনি আমাদের মা। এই মা আজ আমাদের মুক্তি দিয়েছে বাংলাদেশের নাগরিক বানিয়েছেন। সৃস্টিকর্তা তার মঙ্গল করুন। 
৩১ নম্বর নগর জিগাবাড়ি গ্রামের মেয়ে ও ডিমলা মহিলা কলেজের ছাত্রী এইচএসসি পরীক্ষার্থী নুরুপ আক্তার জানান, আগে স্কুল কলেজ যেতে অনেক সমস্যা হতো। কাচাঁ রাস্তা থাকার কারনে ৮-৯ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হতো। কিন্তু এখন রাস্তা পাকা হওয়ায় আমি কলেজে বাই সাইকেল চালিয়ে কলেজ যেতে পারছি। শুধু আমি নয়। আমার মতো অনেক ছেলে-মেয়ে স্কুল ও কলেজে যেতে পারছি।  আমি বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। 
সরেজমিনে দেখা যায় বিলুপ্ত হওয়ার দুই বছরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে ছিটমহলগুলোতে। সরকারি চাকরিও মিলেছে বাসিন্দাদের। রাস্তাঘাট, হাটবাজার, স্কুল ইত্যাদি নতুন করে গড়ে উঠেছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। পাচ্ছে সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা ও অনুদান।  কোটি কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। এ জন্য বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানকে ভুলবে না বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ। 
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, ভারত ও বংলদেশের  অভ্যান্তরে মোট ছিটমহলের সংখ্যা ১৬২টি। এর মধ্যে বাংলাদেশেল অভ্যান্তরে ভারতীয় ছিটমহলের মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯টি, নীলফামারীতে ৪টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও পঞ্চগড়ে ৩৬টি সহ ১১১টি। এর মধ্যে ১৯টি ছিটমহলে নেই কোন জনবসতি। অপর দিকে ভারতের অভ্যান্তরে বাংলাদেশের  ৫১টি ছিটমহলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় ছিল ৪৭টি এবং জলপাইগুড়ি জেলায় ছিল ৪টি। ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ভারতের অভ্যান্তরে  বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল  ভারতীয় ভূখন্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত  এবং বাংলাদেশের অভ্যান্তরে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল ও নাগরিকরা বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে  বিবেচিত হয়। পহেলা আগস্ট ভোরে বাংলাদেশের ভূখন্ডে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ভারতের পূর্ববর্তী ১১১ টি ছিটমহলের।২০১১ সালের ছিটমহলে  জরীপ হয়। সেখানে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের 
আয়তন ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর এবং জনসংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৮৩ জন এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে আয়তন ৭ হাজার ১১০ দশমিক শূন্য ২ একর এবং লোক সংখ্যা ১৪ হাজার ৯০ জন পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৫ সালে জুন মাসে আরেকটি জনগণনা হয়  সেখানে বাংলাদেশের অভ্যান্তরে থাকা ছিটমহলে জনসংখ্যা ৪১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। সে সময় দেশ বেছে নেয়ার অপসনে বাংলাদেশ থেকে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে ভারত চলে যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছিল  ৯৮৯ জন । কিন্তু ভারত যায় ৯২৬ জন।
বাংলাদেশে অভ্যান্তরে থাকা প্রতিটি জনবসতিপূর্ন ছিটমহলের জীবন যাত্রা বদলে গেছে। উন্নয়নের ছোয়ায় তারা অনেক খুশী। রাস্তাঘাট, হাটবাজার, স্কুল, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, সরকারি সকল প্রকার অনুদান পেয়েছে তারা এবং পাচ্ছেন।

পুরোনো সংবাদ

নির্বাচিত 6197978699826307598

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item