হামরা পানির কারাগারোত আছি, কেউ দ্যাখপ্যারও আইসে না, খাবারও পাই না

মামুনুররশিদ মেরাজুল, পীরগঞ্জ (রংপুর) থেকে ঃ

বাবা, কয়দিন ধরি হামরা পানির কারাগারোত বন্দী হয়া আছি। কেউ হামাক দ্যাখপ্যাও আইসে, খাবারও পাইনা। এই বুড়া বয়সে দিনেরাতে ১ বার খায়া কি থাকা যায় ? প্যাটের কষ্ট কি সহ্য করা যায়! চারিদিকে পানি আর পানি। ককন যে পানিত পড়ি মরি যাও বাবা। তোরা এ্যানা বাঁচাও বাবা। কথাগুলো খুব অসহায় আর কান্নাজড়িত ক্ষীণ কন্ঠে জানালেন শতবর্ষী সুকী মাই বেওয়া। তিনি চতরা ইউনিয়নের সোনাতলার বাসিন্দা। তার বাড়ীর চতুর্পাশে গলা পরিমান বন্যার পানি। তারা বাড়ীর টীনের চালার উপরে অস্থায়ীভাবে বসত করছে। খাবার পাশাপাশি পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সুকী মাইয়ের মতো ইউনিয়নটির কাঁটাদুয়ার গ্রামের শতবর্ষী মৌলভী তোফাজ্জল হোসেন, সোনাতলার (ঝাকাপাড়া) লাল মিয়া, কুয়েতপুর মাঝিপাড়ার গনেশ চৌধুরী, গৌর চন্দ্র এবং অবিনাশ, বদনারপাড়ার সাহেব আলী, কুয়েতপুরের জোহরা বেগম, নছিরামসহ হাজারো পানিবন্দি মানুষ খাবার না পেয়ে কাঁদছে। বন্যা শুরু থেকে ৮ দিনে কারো কাছে সরকারী সাহায্য একবার পৌছেছে। আবার কারো কাছে এখনো পৌঁছেনি। তবে স্থানীয়ভাবে চতরা বিজ্ঞান ও কারিগারি কলেজের পক্ষ থেকে বন্যার শুরু থেকেই রান্না করার খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে বলে বন্যার্তরা জানায়। ওই কেেজর অধ্যক্ষ আব্দুর রব প্রধান জানান, বন্যায় আমরা এলাকা দেখছি না। করতোয়া নদীর ত্রি-সীমানা রংপুর, গাইবান্ধা এবং দিনাজপুরের বন্যা কবলিত বিভিন্ন গ্রামে আমরা কলেজের পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার সরবরাহ এবং মেডিকেল টীমের মাধ্যমে ওষুধও দিচ্ছি। তিনি আরও জানান, চতরা ইউনিয়নের বাসিন্দা দুবাই প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলতাব হোসেন বন্যার্তদের সাহায্যার্থে দেয়া ১ লাখ টাকা এবং নিজেদের সংগ্রহে আমরা বন্যা এলাকায় সাহায্য করছি। এছাড়াও ইউনিয়নটির ছাত্রলীগ সম্পাদক শাওন মিয়া, আ’লীগ নেতা মাসুদ মিয়া, চতরা ডিগ্রি কলেজসহ বিভিন্ন সংগঠন ত্রাণ দিচ্ছে। আগামী ২৮ আগষ্ট স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারিমন চৌধুরী বানভাসীদের দুর্দশা দেখতে পীরগঞ্জে আসবেন বলে দলীয় সুত্রে জানা গেছে।
গত শনিবার বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার সর্ব দক্ষিণে চতরা ইউনিয়নটি করতোয়া নদীঘেষা। ইউনিয়নটির ২৪ টি মৌজার মধ্যে ১৯ টিতেই ৮ দিন ধরে বন্যার পানি ঢুকে আছে। কোথাও গলা পরিমান আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত পানি। ধানসহ রবি শষ্যের ক্ষেত পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। টিউবওয়েলগুলোর কোনটা থেকেই খাবার পানি নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সাহায্যকর্মীরা নৌকাযোগে বাড়ী বাড়ী যাচ্ছে। প্রতিটি বাড়ীর ছাদেই মানুষ বসবাস করছে। উচু কোন স্থানে গবাদিপশু রাখা হয়েছে। বানভাসিরা পানি আর খাবারের আশায় পথ চেয়ে আছে। তাদের কাছে দিনে রাতে মাত্র একবার খাবার পৌছে যাচ্ছে বলে বন্যার্তরা জানায়। ইউনিয়নটিতে ৬টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র থাকলেও বাড়ীঘর ছেড়ে কেউ সেখানে যাচ্ছে না। কেউ বাড়ীতে আছেন বা আত্মীয়ের বাড়ীতে গেছেন। চতরা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন, শুকনো খাবার বিতরন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে চতরা ইউপির চেয়ারম্যান এনামুল হক শাহীন প্রধান বলেন, আমরা ইউনিয়নের ২৪টি মৌজায় ৯ হাজার পরিবারের মধ্যে ১৯ মৌজার প্রায় ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। কুয়েতপুর এবং কুমারপুর গ্রাম সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কেউ নৌকা নিয়ে বন্যা এলাকায় গেলেই মানুষজন খাবারের জন্য গলা পানি ভেঙ্গে ছুটে আসছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ না নিয়ে যাওয়ায় অনেক সময় আমরা বুভুক্ষু মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে আসছি। তিনি আরও জানান, আমার ইউনিয়নের গৌরেশ্বরপুরে ২টি, কাঁঠালপাড়া, কাঙ্গুরপাড়া, যাদবপুর এবং অনন্তপুর গ্রামে ১টি করে মোট ৬টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র থাকলেও শুধু অনন্তপুর আশ্রয় কেন্দ্রে কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্তরা এলে সাহায্য দিতে আমাদের কষ্ট কম হতো। তিনি আরও জানান, করতোয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের ম্যাছনার গড়, বদনারপাড়া ও কুয়েতপুর বিল নামকস্থানে ভেঙ্গে যাওয়ায় চতরা ইউনিয়নে পানি ঢুকেছে। ফলে উচু স্থান নেই। মানুষ মারা গেলে নিজ জমিতে কবর দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। শনিবার পর্যন্তÍ সরকারী পর্যায় থেকে রংপুরের এডিসি রুহুল আমি, ইউএনও কমল কুমার ঘোষ, পীরগঞ্জ পৌর মেয়র ও উপজেলা আ’লীগের সাধারন সম্পাদক তাজিমুল ইসলাম শামীম, ভাইস চেয়ারম্যান মোনায়েম সরকার মানু, সাবেক সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী, পিআইও, মৎস্য কর্মকর্তাসহ উপজেলা ও স্থানীয় আ’লীগের নেতৃবৃন্দ বন্যা এলাকায় এসেছেন বলে জানা গেছে। সুত্র জানায়, গত শনিবার বন্যার ৮ম দিনে চতরা ইউনিয়নে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বরাদ্দকৃত ৫০ কেজি ওজনের ৩৬ বস্তা চিড়া এবং আড়াই’শ কেজি গুড় গতকাল রোববার বিতরন করা হয়েছে। অপরদিকে বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৃহষ্পতিবার উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ইউএনও’র সভাপতিত্বে চেয়ারম্যানরা সভা করেছেন। অপরদিকে চৈত্রকোল ইউনিয়নের সমাজসেবক লিয়াকত আলী মন্ডল নিজস্ব অর্থায়নে ত্রাণ বিতরন করেন।
এবারের বন্যায় করতোয়ার পানি উছলে এবং বাঁধ ভেঙ্গে টুকুরিয়া, চৈত্রকোল, বড়আলমপুর, চতরা ও কাবিলপুর ইউনিয়নের অসংখ্য গ্রাম পানিতে তলিয়ে আছে। গ্রামগুলো হচ্ছে- জলাইডাঙ্গা, বাসুদেবপুর, রামকানুপুর, ভাদুরিয়া, গোবিন্দপুর, খালিশা, চকভেকা, গ্রামতলা, কুয়েতপুর, হামিদপুর, কুমারপুর, বদনাপাড়া, ঘাসিপুর, কুলানন্দপুর, সোন্দলপুর, সুরানন্দপুর, কাটাদুয়ার, চন্ডিদুয়ার, নিশ্চিন্তবাটি, বাটিকামারী, জামদানী, শায়েস্তাপুর, বিছনা, দক্ষিন দুর্গাপুর, টিওরমারী, বোয়ালমারী, মেরীপাড়া, পারবোয়ালমারী, তরফমৌজা, সুজারকুঠি, জয়ন্তীপুর, গোপীনাথপুর, কাশিপুর, দুিধয়াবাড়ি, ছাতুয়া, কোমরসই, হরিনা, পার হরিনা, কোমরসই, আটিয়াবাড়ি, হরনাথপুর, মাধবপুর, গন্ধ্রর্বপুর, ধর্মদাশপুর, ওমরপুর, রামনাথপুর, বাঁশপুকুরিয়া, শিমুলবাড়ি, ফরিদপুর, গাংজোয়ার, হলদিবাড়ি, চকরাঙ্গামাটি, ইসলামপুর, জুনিদপুর, শেরপুর, জাহিদপুর, নীচকাবিলপুর, টুকনিপাড়াসহ দু’শ গ্রাম। কিন্তু পীরগঞ্জকে সরকার এখনো বন্যা দুর্গত এলাকা ঘোষণা করেনি বলে জানা গেছে। উপজেলার টুকুরিয়া ইউনিয়নের রামকানুপুর, জয়ন্তীপুর এবং তরফমৌজা গ্রামে ৮ দিন পর গত শনিবার বিকেলে শুধু আ’লীগ নেতা ও হরিনা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হেলালুর রহমান এবং ওয়ার্ড আ’লীগের নেতৃবৃন্দ নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিজনকে ২’শ টাকা পরিমানের শুকনো খাবার বিতরন করেছেন। এ সময় সাহায্য পাওয়া তরফমৌজার মৃত. শংকরাম দাসের স্ত্রী বিন্নো বালা বলেন, কেউ হামাক খাবার দিলি না। আজ (শনিবার) হেলাল মাষ্টার এই একনা খাবার দিলি। তিনি আরও জানান, মুই বিধুয়া-বষ্কো ভাতার জন্যে চিয়ারমেনোক ট্যাকা দিচিনো। কিন্তু কাম করে নাই। কয়েকজন বন্যার্ত জানান, চেয়ারম্যান-নেম্বার বা সরকারের কেউ হামার কাছে আইসে নাই।
উপজেলা প্রানী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মাসুদার রহমান সরকার বলেন, বন্যায় গবাদিপশুর থাকা এবং তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সামনে ঈদ। অনেকেই কোরবানীর পশু ক্রয়-বিক্রয় করবেন। অনেক খামারী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।
উজান থেকে নেমে আসা পানিতে পীরগঞ্জের করতোয়া নদীপাড়ের সহ উপজেলার ৩’শ ৩১টি গ্রামের মধ্যে প্রায় দু’শ গ্রাম বন্যা এবং জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে করতোয়া, আখিরা, যমুনেশ^রী ও নলেয়া নদী ঘেষাঁ ৯ ইউনয়নের ৮২ টি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। গত ৩ দিনে পানিতে ডুবে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। চতরা ইউনিয়নের কাটাদুয়ার গ্রামের প্রফেসর আব্দুল হামিদ (৬৫) গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কলাগাছের ভেলায় চড়ে যাওয়ার সময় পানিতে ডুবে মারা যায়। টুকুরিয়া ইউনিয়নের গোপীনাথপুরের আব্দুল লতিব (৪৫), সুজারকুঠি গ্রামের সুজন নামের এক  শিশু গত শুক্রবার বিকেলে পনিতে ডুবে মারা গেছে। তাকে তার চাচার জমিতে কবর দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা জানিয়েছেন, বন্যা এলাকার ইউনিয়নের বানভাসীরা তল্পিতল্পাসহ অপেক্ষাকৃত উচু এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। যাদের আশ্রয় নেয়ার কোন জায়গা নেই তারা প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও গৃহপালিত পশু সহ আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের ঠাঁই করে নিয়েছে। কোন কোন এলাকার লোকজন রান্না করবার কোন প্রকার জায়গা না থাকা সত্ত্বেও  বাড়িতেই  পড়ে রয়েছে।
উপজেলা ত্রান ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৫২৫ টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ইউএনও কমল কুমার ঘোষ জানান, টুকুরিয়া ইউনিয়নে ৫ মে. টন, চতরায় ৪ মে. টন এবং কাবিলপুরে ৩ মে. টনসহ বন্যার্তদের জন্য সরকারীভাবে ২০ মে. টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সরকারী সাহায্য আরও বাড়ানোর জন্য ইউপি চেয়ারম্যানরা জোর দাবী জানিয়েছে।

পুরোনো সংবাদ

রংপুর 4943607612880650350

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item