কিচ্ছু নাই, সৌগ ভাসি গেইছে|| কুড়িগ্রামের বানভাসীর আহাজারি

হাফিজুর রহমান হৃদয়, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:


'কিচ্ছু নাই। সোউগ ভাসি গেইছে। আল্লাহ ছোয়া (সন্তান) দুইট্যাক আর মোক বাঁছাইছে। না হইলে তো ঘরের সাথত হামরাও হারে গেইলং হয়।' সরেজমিন ঘুণ্টিঘরের মোড়ে চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রিজুফা বেগম। তার চোখে এখনও ভাসছে ঘর ভাসার স্মৃতি। অনেক কষ্টে গড়া বাড়িটির তিনটি ঘরসহ আসবাবপত্র সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বন্যার পানি। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন তার স্বামী ও দুই সন্তান।
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ ভরতেরছড়া ঘুণ্টিঘর এলাকার বাসিন্দা রিজুফা বেগম (৪৫)। স্বামী কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী। মসজিদের খাদেম। রিজুফা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে ও রাস্তায় মাটি কেটে অনেক কষ্টে করেছেন ঘর তিনটি। বানের পানি তার এতদিনের পরিশ্রম ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এই আক্ষেপ নিয়ে তিনি কথা বলতে বলতে বারবার চোখ মুছছিলেন।
রিজুফা বেগমের এখন সন্তানদের ঘুম পাড়ানো তো দূরের কথা, তাদের পেটে দু'মুঠো ভাত দেবেন, সে উপায়ও নেই।
সারাদিন সন্তানদের নিয়ে বসে তাকিয়ে থাকেন যেদিকে তার ঘরগুলো চলে গেছে। তিনি বলেন, 'বাড়ি-ঘর গুল্যা নিয়্যা গেইল সবকিছু। ঘরের একমুঠ দানাও বের করবার পাই নাই। ছাওয়াগুলাক নিয়্যা খুব কষ্টে আছি। খাবারও নাই; শুব্যারও জায়গা নাই। খুব কষ্ট কইরা ঘর তিনটা করছি। এ্যাহন দশজনে সহযোগিতা করিল হয়।'
কুড়িগ্রামে দ্বিতীয় দফা বন্যা শুরু হয়েছিল জেলার উত্তরের ভারত লাগোয়া উপজেলা ভূরুঙ্গামারী থেকে। বন্যার স্রোতে দু'জন ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভেসে গেছে শতাধিক ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্র, টাকা ও ধান-চাল। সেগুলো খুঁজেও পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া তিন শতাধিক ঘরের হদিস নেই। এসব ঘরের ভেতর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি ভুক্তভোগীরা।
উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ ভরতেরছড়া। এ ওয়ার্ডের প্রায় ৭০ বাড়িঘরের হদিস নেই। বাদ যায়নি পাকা ঘর, সড়ক, গাছপালাসহ সবজিক্ষেত। অনেকের গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি ভেসে গেছে। বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে যা হয়, বর্তমানে ওই এলাকার অবস্থাও তাই। রাস্তার ওপরে কারও ঠাঁই মিললেও মিলছে না তিনবেলা খাবার।
বর্তমানে দক্ষিণ ভরতেরছড়া গ্রামের বাসিন্দা ওমর আলী আগে ছিলেন গুনাইরকুটি গ্রামের বাসিন্দা। গত বছরের বন্যায় রাক্ষসী দুধকুমরের গ্রাসে চলে যায় ভিটেমাটি। সবকিছু হারিয়ে আট মাস আগে এই গ্রামে এসে বাড়ি করেন ছেলে জহুরুল ইসলাম। সবেমাত্র ঘর-বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে, আর তখন আকস্মিক বন্যা এসে সবকিছু ওলট-পালট করে দিল। এ দেখে নির্বাক ওমর আলী। তার ছেলে জহুরুল ইসলাম বলেন, 'বাবার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। গেল বছরের বন্যায় বাড়ি ভাঙি নিল দুধকুমর। কী কষ্ট করে বাড়িটা করলাম। কাজ শেষ না হতেই বাড়িই শেষ। এসবের টিন-কাঠ যা আছে, তা কিছুই চলবে না।'
ঘুণ্টিঘর এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে জহুরুল ও তার দুই ভাইয়ের পাঁচটি ঘরের অস্তিত্ব নেই। সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে ভূরুঙ্গামারী মহাসড়কের দক্ষিণে তাদের বাড়ি। উত্তরের চারটি বাড়িসহ পাকা মহাসড়ক মুহূর্তে ভেঙে গেলে কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় লোকজন। জহুরুল হক বলেন, 'কোনোমতে বেঁচে গেছি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ পানির চাপ এলো। রাস্তাসহ চারটি বাড়ি মুহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। ঘরের ধান-চাল, টাকা, কাপড়, আসবাবপত্র কিছুই বের করা যায়নি।' তার মা জমেনা বেগমের বুকফাটা কান্না থামে না। থেকে থেকে প্রলাপ বকছেন_ 'কী করে ছেলেগুলো বাঁচবে। ছোটখাটো ব্যবসার মূলধন, তাও হারিয়ে গেছে বন্যার পানিতে।'
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ঘরবাড়ির সঙ্গে রাস্তা-ঘাটের বেহাল অবস্থা। সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে ভূরুঙ্গামারী বাসস্ট্যান্ড সড়কে প্রায় ২৫ স্থানে ভেঙেছে। এর মধ্যে তিন স্থানে ড্রামের তৈরি ভেলা দিয়ে লোকজন পারাপার করছে। সবজিক্ষেত নষ্ট হয়েছে অনেক। ঘরবাড়ি, অর্থ-সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব বানভাসিরা এখন তাকিয়ে আছেন সরকারের দিকে।
বঙ্গসোনাহাট ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান আলী জানান, সবচেয়ে বেশি হয়েছে তার ইউনিয়নের। আমরা তালিকা করেছি।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজাহারুল ইসলাম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সবার তালিকা করা হয়েছে। ঘর মেরামতের জন্য টিন বরাদ্দ চেয়েছি। পাওয়া গেলে তাদের বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া যদি কেউ গুচ্ছগ্রাম বা আবাসনে যেতে চায়, সে ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে। সরকারের সামাজিক বেষ্টনীর যেসব কর্মসূচি রয়েছে, তাতে বন্যার্তদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

পুরোনো সংবাদ

কুড়িগ্রাম 3071165504560701492

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item