সময়ের আগেই অপরিনত কণ্যা সন্তানের জন্ম দিলেন নির্যাতনের শিকার ডিমলার শেফালী

বিশেষ প্রতিনিধি ৮ আগষ্ট॥
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার খালিশাচাঁপানী ইউনিয়নের বাইশপুকুর কোলনঝাড় গ্রামে গরু চুরির মিথ্যা অভিযোগে গাছে বেধে নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ শেফালী বেগম (৩২) কণ্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। গতকাল সোমবার (৭ আগষ্ট) সন্ধ্যার পর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার সন্তান জন্ম নেয়। তবে সময়ের আগে জন্ম হওয়ায় নবজাতকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। এর আগে গত শুক্রবার (৪ আগষ্ট) নির্যাতনের শিকার হলে শনিবার (৫ আগষ্ট) শেফালীকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আশংকাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছিল।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসি সুলতানা জানান, শেফালী বেগমের প্রসবের সময়ের ৯ সপ্তাহ আগে ৯শ’ গ্রাম ওজন নিয়ে শিশুটির জন্ম হয়। প্রসূতি ও নবজাতক শিশুটির অবস্থা শংকটাপন্ন। নবজাতক কন্যাটিকে নিবিড় পরিচর্চ্চা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রসূতিকেও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে নিবিরভাবে।

প্রসঙ্গত: একটি পারিবারিক ঘটনাকে পুঁজি করে এলাকার কিছু প্রভাবশালী মহল শেফালীকে গরু চুরির অপবাদ দিয়ে গত শুক্রবার (৪ আগষ্ট) দুপুরে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করে। এসময় সাত মাসের অন্ত:সত্তা ছিলেন শেফালী।

এ ঘটনা নিয়ে অবলোকন সহ বিভিন্ন অনলাইন ও পত্রিকায় খবর প্রকাশ হলে প্রশাসন সহ সর্বমহলে তোলপাড়া সৃস্টি করে। প্রশাসন ও পুলিশের হস্তক্ষেপে ওই ঘটনায় গত রবিবার (৬ আগষ্ট) গভীর রাতে ডিমলা থানায় একটি মামলা দায়ের (মামলা নম্বর ০৬/১৭) করেন নির্যাতনের শিকার শেফালীর মামা সহিদুল ইসলাম। মামলার ১৯জন নামীয় ও অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জন রয়েছে। আসামীদের মধ্যে পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের গতকাল সোমবার (৭ আগষ্ট) দুপুরে আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। তারা হলো- শেফালীর বড় বোন আকলিমার স্বামী রফিকুল ইসলাম, শাশুড়ি অপিয়া বেগম ও গ্রাম পুলিশ রশিদুল ইসলাম। ঘটনাটি গুরুত্বসহকারে নিয়ে তদন্ত করছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
সেদিনের ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী নির্যাতীত শেফালি বেগমের ছোট বোন শিউলি আক্তার মুন বলেন, যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবার কথা নয়। গাছে বেধে লাত্থি, ঘুষি, কিল মারা হলো। স্থানীয় আঃয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কাদের ওরফে নারিয়া কাদের, খালিশাচাঁপানী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক তামজিদার রহমান, ইউনিয়নের শ্রমিক লীগের সাধারন সম্পাদক শিমুল ইসলাম, সদ্য বিএনপি হতে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী মোসলেম উদ্দিনের ছেলে আশরাফুল ও সামছুলের ছেলে বিএনপি কর্মী মজনুর রহমান মঞ্জু অকথ্য ভাবে নির্যাতন চালান আমার বোনের উপর।
তারা শেফালীকে গরু চুরির ঘটনা সাজিয়ে পুলিশকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সেলিমুর রহমান জানান, ঘটনাস্থলে কেউ এগিয়ে আসেনি  শেফালীকে বাঁচানোর জন্য। সকাল ১০টা হতে বিকাল ৪টা পর্যন্ত গাছে বেঁধে রাখা হয়েছিলো শেফালীকে। পুলিশ আসার আগে গাছ থেকে দড়ি খুলে দেয়া হয়।

সুত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার (৩ আগষ্ট) স্বামী রফিকুলের সাথে ছোট বোন আকলিমার ঝগড়া হলে শেফালির বাড়িতে আসে আকলিমা। পরদিন (শুক্রবার ৪ আগষ্ট) সকালে তিনজন মিলে আকলিমাকে রাখতে গেলে রফিকুলের বাড়িতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হন শেফালি। একপর্যায়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলে পথিমধ্যে রফিকুলের মামা দবির উদ্দিনের উঠানে মিমাংসার জন্য বসলে সেখানে রফিকুল ও তার মা অপিয়া বেগম নির্যাতন শুরু করেন। একপর্যায়ে গাছে বেধে রেখে নির্যাতন চালানো হয় বিকেল পর্যন্ত অন্তসত্বা শেফালিকে।
প্রথমে জলঢাকা হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও অবস্থার সংকটাপন্ন হওয়ায় তাকে স্থানান্তরিত করা হয় রংপুর চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে।

ভয় আর হুমকীর কারণে মামলা করতে না পারলেও গত রবিবার (৬ আগষ্ট) রাতে পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ভাই সহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন ডিমলা থানায়।
খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ৪নম্বর ওয়ার্ডের ক্লোজার পাড়ার ওই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, আমি সে সময় ছিলাম না।
নির্যাতনের চিত্রটি খুবই খারাপ হয়েছে। এটা ঠিক হয়নি। তবে যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের শাস্তি দাবী করেন আতাউর রহমান।
নির্যাতনের শিকার শেফালির খালা নাজমা বেগম অভিযোগ করে বলেন, ওমরা হামাক ভয়ভীতি দেখায় ছে, কিছুই বলে হইবে না। পুলিশ বলে কিছুই করিবার পাইবেনা ওমার।  হামরা এ্যালা কি করিমো।
এদিকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের ঘটনাটি কোনভাবে করা ঠিক হয়নি মন্তব্য করে নীলফামারী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশার মোহাম্মদ আতিকুর রহমান। তিনি জানান, পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। মামলা নেওয়া হয়েছে। তিনজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
যারাই জড়িত থাকুন না কেন তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা আতিকুর রহমান।
এদিকে শেফালীর মামা মামলার বাদী সহিদুল ইসলামের  দায়েরকৃত মামলায় ক্রমিকনুসারে আসামীদের নামের তালিকায় দেখা যায় খালিশাচাঁপানী ইউনিয়নের বাইশপুকুর কোলনঝাড় গ্রামের দেবারু মামুদের দুই ছেলে অপিয়ার রহমান (২৩) ও রফিকুল ইসলাম (৪২), দবির উদ্দিনের তিন ছেলে আলী হোসেন (৩৫), আবু বক্কর সিদ্দিক (৩০) ও মনোয়ার হোসেন (২৮), মৃত. আলাপু মামুদের দুই ছেলে দবির উদ্দিন (৫৫) ও আহেদুল ইসলাম (৩৮), হামিদুর রহমানের ছেলে আতাউল রহমান (১৯), আবু বক্কর সিদ্দিকের স্ত্রী তহমিনা বেগম (২৩), আলী হোসেনের স্ত্রী রূপালী বেগম (২৮), মনোয়ার হোসেনের স্ত্রী মনছুরা বেগম (২৪), অপিয়ার রহমানের স্ত্রী তুলি বেগম (২১), হামিদুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৪০), মাহাবুর রহমানের স্ত্রী সুলতানা বেগম (২৪), দেবারু মামুদের স্ত্রী অপিয়া বেগম (৬০), মৃত. খটেয়া মামুদের ছেলে খালিশাচাঁপানী ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কাদের (৬০), মৃত. আবুল হোসেনের ছেলে ওই ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ রশিদুল ইসলাম (৪০), সফিয়ার রহমানের স্ত্রী রাজিয়া বেগম (২৭) ও দবির উদ্দিনের স্ত্রী খালিকুন বেগম (৫০) সহ ৪/৫ জন অজ্ঞাত।

উল্লেখ যে, উক্ত গ্রামে জমিজমা সংক্রান্ত এক বিবাদে শেফালীর বাবা মবিয়ার রহমানকে ২০১২ সালের ২৯ জুলাই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে প্রতিপক্ষরা হত্যা করেছিল। মামলায় এলাকার ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে পুলিশ চার্জশীট প্রদান করেন। মামলাটি বর্তমানে নীলফামারী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আগামী ২২ আগষ্ট হত্যার মামলা সাক্ষ্য রয়েছে। প্রভাবশালীরা ওই মামলা মিমাংসার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। তারা পিতার হত্যা মামলা আপোষ না করায় প্রতিপক্ষরা সম্প্রতি ডিমলা থানায় একটি মিথ্যা মামলা করেছে । ফলে শেফালীর একমাত্র ভাই রমজান পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এলাকায় কোন ঘটনা ঘটলেই শেফালী ও তার ভাইয়ের উপর নির্যাতনে খড়ক নেমে আসে। শেফালী ওই গ্রামের লালন মিয়ার স্ত্রী। তার স্বামী ঢাকায় রিক্সাচালায়।

পুরোনো সংবাদ

নীলফামারী 8590701411379744928

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item