ছিটমহল বিলুপ্তির দুই বছর

ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়, নীলফামারী ৩১ জুলাই॥
ছিটমহল বিনিময়ের দুই বছর পূর্তি আজ ৩১ জুলাই মধ্যরাতে। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হবে। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে দীর্ঘ ৬৮ বছর পর বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের ছিটমহল বিনিময় হয়। দেশের নাগরিক অধিকার ফিরে পান বঞ্চিতরা। দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দিদশা থেকে মুক্তির দুই বছর পার হচ্ছে ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে।

প্রতিটি ছিটমহলে বিজয় উৎসব পালন করা হবে। এছাড়া প্রতিটি ছিটমহলে বিভিন্ন ধরনের খেলা ধুলার আয়োজন করা হয়েছে। এর পাশপাশি নাচ, জারি গান, যাত্রাপালা ও লাঠি খেলা হবে।
মাত্র দুই বছরে আমাদের ভাগ্যোন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের যে আন্তরিকতা দেখেছে সাবেক ভারতীয় বিলুপ্ত ছিটমহলের নাগরিকরা তাতে তারা মহাখুশী। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সারাজীবন মনে রাখবে বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দি জীবনের মুক্তি মিলে ভারত বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলের কয়েক হাজার মানুষের। যার মধ্যে ১১১টি বাংলাদেশের এবং বাকি ৫১টি ভারতের ভুখন্ডের সাথে যুক্ত হয়। এগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি এবং নীলফামারীতে রয়েছে ৪টি।

সরেজমিনে গেলে সাবেক ছিটমহলবাসীরা জানায় দেখতে দেখতে ৭৩০টি দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। ৬৮ বছরের বন্দী জীবনের মুক্তি পাওয়ার আনন্দের আমরা দ্বিতীয় বর্ষপুর্তিতে প্রস্তুত।

২০১৫ সালের ৩১ জুলাই তারা মুক্তির অবসানে ৬৮টি মমবাতি প্রজ্জলিত করেছিল। এরপর প্রথম বর্ষপূর্তিতে একটি এবার  দ্বিতীয় বর্ষে তারা দুইটি মোমবাতি প্রজ্জলিত করবে বলে জানায়।

বিলুপ্ত হওয়ার দুই বছরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে ছিটমহলগুলোতে। সরকারি চাকরিও মিলেছে বাসিন্দাদের। রাস্তাঘাট, হাটবাজার, স্কুল ইত্যাদি নতুন করে গড়ে উঠেছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। পাচ্ছে সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা ও অনুদান।  কোটি কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। এ জন্য বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানকে ভুলবে না বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ।

সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, ভারত ও বংলদেশের অভ্যান্তরে মোট ছিটমহলের সংখ্যা ১৬২টি। এর মধ্যে বাংলাদেশেল অভ্যান্তরে ভারতীয় ছিটমহলের মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯টি, নীলফামারীতে ৪টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও পঞ্চগড়ে ৩৬টি সহ ১১১টি। এর মধ্যে ১৯টি ছিটমহলে নেই কোন জনবসতি। অপর দিকে ভারতের অভ্যান্তরে বাংলাদেশে ছিটমহল সংখ্যা হলো কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি মিলে ৫১ টি।

ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ভারতের অভ্যান্তরে  বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল  ভারতীয় ভূখন্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত  এবং বাংলাদেশের অভ্যান্তরে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল ও নাগরিকরা বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে  বিবেচিত হয়। পহেলা আগস্ট ভোরে বাংলাদেশের ভূখন্ডে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ভারতের পূর্ববর্তী ১১১ টি ছিটমহলের।

২০১১ সালের ছিটমহলে জরীপ হয়। সেখানে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর এবং জনসংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৮৩ জন এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে আয়তন ৭ হাজার ১১০ দশমিক শূন্য ২ একর এবং লোক সংখ্যা ১৪ হাজার ৯০ জন পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৫ সালে জুন মাসে আরেকটি জনগণনা হয়  সেখানে বাংলাদেশের অভ্যান্তরে থাকা ছিটমহলে জনসংখ্যা ৪১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। সে সময় দেশ বেছে নেয়ার অপসনে বাংলাদেশ থেকে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে ভারত চলে যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছিল  ৯৮৯ জন । কিন্তু ভারত যায় ৯২৬ জন।

বিভিন্ন ছিটমহলবাসী জানায় মুক্তি পাওয়ার দ্বিতীয় বছরের দিনটি হৃদয়ে ধরে রাখতে আজ  ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ছিটমহলে ভেতরে নবনির্মিত শহীদ মিনারে ফুলের শ্রদ্ধা, দুইটি মোমবাতি প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে দিনটির সূচনা করা হবে। পহেলা আগষ্ট সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনটিকে স্মরণ করা হবে।

বাংলাদেশে অভ্যান্তরে থাকা প্রতিটি জনবসতিপূর্ন ছিটমহলের জীবন যাত্রা বদলে গেছে। উন্নয়নের ছোয়ায় তারা অনেক খুশী। রাস্তাঘাট, হাটবাজার, স্কুল, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, সরকারি সকল প্রকার অনুদান পেয়েছে তারা এবং পাচ্ছেন। নীলফামারীর নগর জিগাবাড়ি বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন (৫৬) বললেন একবার ভেবেছিলাম পরিবার পরিজন নিয়ে ভারতের নাগরিক হয়ে চলে যাই। এখন দেখছি না গিয়ে অনেক ভাল করেছি। খবর পেয়েছি যারা গেছে তারা সেখানে ভাল নেই। তাদের মধ্যে অনেকে চোরাপথে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। তিনি বলেন আমরা খবর নিয়ে জানতে পেরেছি যা দেশ বদল করে ভারত গেছে তাদের  অস্থায়ী ক্যা¤েপ এখনও কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে। নোংরা পরিবেশ; পানীয় জলের সংকট; চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। কোচবিহার জেলার দিনহাটা, মেখলীগঞ্জ, হলদিবাড়ী  তিন মহকুমায় তিনটি ক্যা¤েপ ৯২৬ জন রয়েছে। এদের মধ্যে দুইজন মারা গেছে।

জয়নাল আরো বলেন আমরা যারা বাংলাদেশে রয়ে গেছি তারা অনেক অনেক ভাল আছি। আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ঋনী। তিনি আমাদের মা। এই মা আজ আমাদের মুক্তি দিয়েছে বাংলাদেশের নাগরিক বানিয়েছেন। সৃস্টিকর্তা তার মঙ্গল করুন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দতায় আমরা মুগ্ধ। তিনিই ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল রূপকার। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

উলে¬খ্য যে, নীলফামারীর ডিমলার উপজেলার খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নে ২৮ নম্বর বড় খানকি, গয়াবাড়ি ইউনিয়নে ২৯ নম্বর বড় খানকি গিতালদহ, ২৯ নম্বর বড় খানকি খারিজা গিতালদহ এবং টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নে ৩১ নম্বর নগর জিগাবাড়ি ছিটমহল রয়েছে। এই চারটি ছিটমহলে ১১৯টি পরিবারের ৫৪৫ জন নাগরিক রয়েছেন।

ভারতে যারা গেছে তারা কেমন আছে?Ñ'বাংলাদেশ থেকে অনেক আশা করে ভারতে এসেছিলাম। দুই ছেলে চাকরি পাবে, মেয়েকে বিয়ে দিতে পারব, দুই বেলা খাওয়া-পরার ব্যবস্থা হবে। ভিক্ষা করে নয়, কাজের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে উপার্জন করার ক্ষমতা আসবে। কিন্তু বাস্তবে দুই বছর ধরে এই অস্থায়ী ক্যা¤েপ পচে মরছি। ' কোচবিহারের মেখলীগঞ্জের অস্থায়ী ক্যা¤েপর বাসিন্দা মিনা রানী সূত্রধর এভাবেই হতাশার কথা জানাচ্ছিলেন। এ ক্যা¤েপ মিনা রানী, সুবল দাস, আরতি সমাদ্দার, প্রণব পরামানিকসহ ২০৬ জন বাংলাদেশ থেকে আসা ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দা রয়েছে। তাদের অনেকেই বলছে, অস্থায়ী ক্যা¤প থেকে পানিশালা নামের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থায়ী ক্যা¤প করে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তাদের অভিযোগ, ওই ক্যা¤েপও নোংরা পরিবেশ; পানীয় জলের সংকট; চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। গত জুন মাসে তারা মেখলীগঞ্জের মহকুমা শাসকের অফিসের সামনে এর প্রতিবাদে অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচিও পালন করেছিল। কাজ হয়নি। বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমানন্ত চুক্তি বাস্তবায়নের সুবাদে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ৫১টি বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডে এবং ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ১১১টি ছিটমহল ভারতীয় ভূখন্ডে মিশে যায়। এ সময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্থায়ীভাবে চলে আসে ভারতীয় ছিটমহলের ৯২৬ অধিবাসী। কোচবিহার জেলার দিনহাটা, মেখলীগঞ্জ, হলদিবাড়ীর এই তিন মহকুমায় তিনটি ক্যা¤েপ রাখা হয়েছে তাদের। দিনহাটা ও হলদিবাড়ীতে স্থায়ী ক্যা¤প করা হলেও মেখলীগঞ্জে এখনো অস্থায়ী ক্যা¤প রয়ে গেছে। আর বাংলাদেশি ছিটমহলের যারা এখানে ভারতের মূল ভূখন্ডে থেকে গিয়েছেন? না, সেই ১৪ হাজার ৮৫৬ জনের ভাগ্যেও তেমন পরিবর্তন হয়নি ৭৩০ দিনে। গত দুই বছরে শুধু বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছেছে। আর নামমাত্র রাস্তা সংস্কার করা হচ্ছে। অবশ্য বাসিন্দারা জমির মালিকানার কাগজপত্র, অর্থাৎ জমির দলিল না পাওয়াকেই প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখছে।

দুই বছর আগে আজকের এই দিন, ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে অদৃশ্য ভূগোলের বেড়া তুলে ফেলেছিল রাষ্ট্রের অধিকার পাওয়া মানুষগুলো। সেদিন দুই পারেই আশার ঝিলিক ছিল। কাঁটাতারহীন সীমান্ত বেড়া থেকে প্রায় সাত দশক পর মুক্তি মিলছে, তাই স্বাধীনতা লাভের আনন্দ ছিল। দুই বছর পর এসে দেখা যায়, নতুন লড়াইয়ের শামিল বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। বাংলাদেশ থেকে আসা ভারতীয় ছিটমহলের ৯২৬ মানুষ দুই বছরে মৌলিক অধিকার নিয়ে মিছিল-মিটিংসহ রাজনৈতিক ছায়ায় রাস্তা বদলে চলেছে প্রতিদিন। অস্থায়ী ক্যা¤প থেকে স্থায়ী ক্যা¤প কিংবা ক্যা¤েপ সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য, চুরি-ডাকাতিসহ সম্ভ্রমহানির মতোও ঘটনার খবর ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে আসছে প্রায়ই। টেলিফোনে কথা হয় অধুনা ছিটের এক তরুণ বাসিন্দা জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে।

তিনি জানান, দুই বছরের স্বীকৃতি শুধুই ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড। মাত্র মাস কয়েক আগে সব গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছেছে। বাকি মৌলিক অধিকারগুলো এখনো বড়সড় প্রশ্নের মুখে। জয়নাল বলেন, যে মানুষটি ছিটমহলের মানুষের জন্য জীবনের প্রায় সবটুকু সময় আন্দোলন করে গেলেন, তাঁকে এখন দেশদ্রোহীর মামলায় জড়ানো হয়েছে। মানুষটি দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। সম্প্রতি তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির খাতায় নাম লিখিয়ে উপনির্বাচনে লড়েছেন।

দীপ্তিমান সেনগুপ্ত জানান, যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে ছিটমহলের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিকভাবেই লড়তে হবে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস মুখে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। বাস্তবে তারা কিছুই করেনি। শুধু ভোটের লোভে ভোটার কার্ডে তাদের নাম তোলার ব্যবস্থা করেছিল তারা। গত দুই বছরে সাত হাজার ১১০ একর জমির ১ শতাংশ জমির দলিলও বিলুপ্ত ছিটের মানুষের হাতে তুলে দিতে পারেনি।

আগে বামপন্থী নেতা ছিলেন উদয়ন গুহ। বছর দুই হলো মমতার হাত ধরেছেন। বর্তমানে তিনি দিনহাটার তৃণমূলের শীর্ষ নেতা। তাঁর দৃষ্টিতে দোষী কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। ছিটমহল বিনিময়ের সময় কোচবিহারের জেলা শাসক ছিলেন পি ওলাঙ্গানাথন। সম্প্রতি তিনি বদলি হয়েছেন। নতুন জেলা শাসক অবশ্য এ বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারবেন না বলে কোচবিহারের জেলা শাসকের দপ্তর থেকে জানানো হয়।

পুরোনো সংবাদ

প্রধান খবর 8196041745121594734

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item