বেগম সম্পাদক নূরজাহান বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত
https://www.obolokon24.com/2017/06/nurjahan.html
সফিকুল
ইসলাম শিল্পীঃ
উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগমের সম্পাদক নূরজাহান বেগমের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল প্রায় ৯১ বছর।
উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগমের সম্পাদক নূরজাহান বেগমের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল প্রায় ৯১ বছর।
২০১৬ সালের ২৩ মে সকালে অচেনালোকে চলে গেলেন মহিয়সী নূরজাহান বেগম।
বাংলাদেশে
নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত ও সাহিত্যিক নূরজাহান বেগম ১৯২৫ সালের ৪ জুন
চাঁদপুর জেলার চালিতাতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা প্রখ্যাত
‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন।
১.
বাংলাদেশের
সাংবাদিকতার জগতে নূরজাহান বেগম একটি বিশিষ্ট নাম। নারী সাংবাদিকতার
পথিকৃৎ নূরজাহান বেগম, যার হাত দিয়ে নারী সাংবাদিকতার পথ নির্মিত হয়েছে
এদেশে। নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত নূরজাহান বেগম বাবা সওগাত সম্পাদক
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের হাত ধরে সংবাদপত্র জগতে তাঁর পদার্পণ। উপমহাদেশের
প্রথম নারী সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে এর সম্পাদনার সঙ্গে
সংশ্লিষ্ট তিনি শুধু একজন সাংবাদিকই নন লেখক গড়ার কারিগরও। তিনি ছয় দশক ধরে
বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।
বাংলার নারীমুক্তির আন্দোলনে উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক ‘বেগম’
পত্রিকা এবং এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন ও নূরজাহান বেগমের নাম
চলে আসে। শুধু তাই নয়, বাংলায় নারী সাংবাদিকতার ইতিহাসেও নূরজাহান বেগম
একটি প্রত্যয়ের নাম। নব্বই পেরিয়েও এই মহিয়সী নারী এখনো নিরলসভাবে বেগম
পত্রিকাটি প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছেন। আমরা জানি, উনিশ শতকের শেষের দিকে
বাঙালি মুসলিম সমাজে নবজাগরণ ঘটে। একদিকে যেমন পুরুষরা এগিয়ে আসতে থাকে
নানা অগ্রযাত্রায়, তেমনি কিছু নারীও নারীমুক্তির আন্দোলনে চার দেয়ালের
গণ্ডি পেরিয়ে বের হয়ে আসে। আর এক্ষেত্রে ‘বেগম’ পত্রিকা অগ্রণী ভূমিকা
রেখেছে। আর তাই এদেশের নারী সাংবাদিকতা ও সমাজের অগ্রদূত হিসেবে
প্রাত:স্মরণীয় নাম অবশ্যই নূরজাহান বেগম। বাঙালি মুসলিম সমাজে নারীজাগরণের
পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার আলোকে আলোকিত 'বেগম' সম্পাদক নূরজাহান বেগম। মহীয়সী ও
আলোকিত এই নারী ছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের ছাত্রী। যে
সময়ে বাংলাদেশে পত্রিকার যাত্রাই শুরু হয়নি, মেয়েদের পত্রিকায় কাজ করা তো
অনেক দূরের কথা। মেয়েরা তখন পর্দার আড়ালে, বাইরের দুনিয়াটা ছিল তাদের জন্য
নিষিদ্ধ। এমন সময়ে বাবার হাত ধরে নূরজাহান বেগম পা বাড়ান পত্রিকার কাজে।
প্রায় সত্তর বছর ধরে একইভাবে কাজ করেন। তিনি নারীসমাজকে আধুনিকায়নে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, যার কারণে বর্তমান সময়ে নারীদের স্বাধীনভাবে,
অবাধে কর্মক্ষেত্রে বিচরণ করতে দেখা যায়। এদশের বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে
শুরু করে এভারেস্ট জয় করে ফিরেছে নারী। তারা এখন খেলাধুলায়ও রাখছে
কৃতিত্বের স্বাক্ষর। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলছে ফুটবল, ক্রিকেট,
সাঁতার। আর তাই তাঁর অবদান বাংলাদেশের নারীসমাজ চিরদিন মনে রাখবে।
২.
নদীর
নাম মেঘনা। জেলার নাম চাঁদপুর। আর গ্রামের নাম চালিতাতলী। অনেক বছর আগে এই
চালিতাতলী গ্রামের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন নামে এক যুবক স্বপ্ন দেখতেন বড়
কিছু হওয়ার, বড় কিছু করার। গতানুগতিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য পরিহার করে
বাধাসংকুল পথ ধরে এগিয়ে চলার। এ রকম স্বপ্ন কেবল সাহসী মানুষরাই দেখতে
পারে। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনও ছিলেন তেমনই একজন স্বাপ্নিক সাহসী মানুষ। সে
যুগের আর পাঁচজন যুবকের মতো তিনিও ছিলেন সংসারী। সেই ১৯২৫ সালের জুন মাসের ৪
তারিখে তার স্ত্রী ফাতেমা খাতুনের কোলে এসেছে চাঁদের মতো ফুটফুটে এক
শিশুকন্যা। বড় সুন্দর মেয়ে। এত সুন্দর মেয়ের কী নাম রাখা যায়? অনেক
ভেবেচিন্তে নাম রাখলেন নূরজাহান বেগম। ভারতের সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের নামে
নাম। সে নামের অর্থ হচ্ছে 'জগতের আলো'। সুশিক্ষিত যুবক নাসিরউদ্দীন স্বপ্ন
দেখেছিলেন বড় হয়ে একদিন তার ছোট মেয়েটি নিজের নামের অর্থ সার্থক করে তুলবে।
তার সেই স্বপ্ন যে বিফল হয়নি, সে কথা বলাই বাহুল্য। বাংলা সংবাদপত্র জগতের
আলোড়িত নাম 'সওগাত' সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন পত্রিকার প্রকাশনা নিয়ে
ব্যস্ত থাকতেন কলকাতায়। বাড়ির বউ-ঝি শহরে গেলে পর্দা নষ্ট হবে বিধায় মার
সঙ্গে তাকে গ্রামেই থাকতে হতো। দুই বছর পর সঙ্গী হয়ে আসে আর এক বোন। তবে
তার বেশি দিন পৃথিবীতে থাকা হয়নি। বাবা-মার একমাত্র সন্তান হিসেবে সবার
আদরে নূরজাহান বেগম ওরফে নূরী বড় হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে
দুরন্তপনা। দুরন্তপনার জন্যই তিনি একবার পুকুরে এবং একবার খালে পড়ে যান।
তখন বাবা জোর করেই পরিবার নিয়ে কলকাতায় যাত্রা করেন। শুরু হয় কলকাতার জীবন।
মা-বাবা সম্পর্কে নূরজাহান বেগম বলেন, ' আমার আব্বা প্রগতিশীল মানুষ
ছিলেন। তিনি আধুনিক মানসিকতা পোষণ করতেন। আমার মা অল্প শিক্ষিত অসম্ভব
ধৈর্যশীল শান্ত একজন মহিলা ছিলেন। সর্বদাই পর্দার মধ্যে থাকতেন। অল্প
শিক্ষিত বলে বাবা কখনই মাকে অবহেলা করেননি। সব বিষয়ে মার সঙ্গে আলোচনা
করতেন। একজন প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন বাবা। আমাকে মেয়ে হিসেবে নয়, মানুষ
হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি। সাত বছর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে কাজ করেছি।’ বাবা
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন মৃত্যুর অল্পকাল আগেও নূরজাহান বেগম প্রতিটি কাজে তার
উপদেশ গ্রহণ করতেন, বাবাই ছিলেন তার ফ্রেন্ড, গাইড অ্যান্ড ফিলোসফার।
নাসিরউদ্দীন ছিলেন আধুনিক ও শিক্ষিত মনের মানুষ। ফুলের মতো সুন্দর ছোট্ট
মেয়েটির গ্রাম্য সাজ-পোশাক দেখে তার একটুও ভালো লাগেনি। তিনি মেয়েকে সঙ্গে
করে বাজারে নিয়ে লম্বা জামা পাজামার বদলে হালকা ফ্রক আর ইজার পরিয়ে ছিলেন।
সেলুনে নিয়ে লম্বা চুলের বেণি কাটিয়ে ববছাঁট করিয়ে দিয়েছিলেন। নাক-কানের
গহনা খুলে মেয়েকে তার মায়ের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, 'ওকে সহজভাবে মানুষ করে
তোলো এবং তুমিও সহজ হও।' এই উদ্দেশ্যে নাসিরউদ্দীন গৃহশিক্ষক রেখে স্ত্রীকে
লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। আর ছোট্ট মেয়ে নূরজাহানকে সাখাওয়াত
মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত
হোসেনের প্রতিষ্ঠিত ওই স্কুলটিতে নূরজাহান সত্যিকারের শিক্ষার আলোক লাভের
সুযোগ পেয়েছিল। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সেলাই প্রদর্শনী এবং
সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তার অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয়। এ ছাড়া বুদ্ধিমতি এই
কিশোরী তার বাবার পত্রিকা প্রকাশের কাজে নানাভাবে সাহায্য করত। সাত বছর বয়স
থেকে বাবার সঙ্গে ছবি কেটে কেটে পত্রিকায় লাগানোর কাজ শুরু করেন নূরজাহান
বেগম। কলকাতায় তাদের বাড়ির ওপরতলায় ছিল সওগাতের অফিস। সে সময় সাংস্কৃতিক
অঙ্গনের বোদ্ধারা এ অফিসে আড্ডা দিতেন। তাদের স্নেহধন্য ছিলেন নূরজাহান
বেগম।
৩.
তখনকার
সময় বেগম রোকেয়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে তার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের জন্য
ছাত্রী জোগাড় করতেন। এভাবেই তার স্কুলের ছাত্রী হন নূরজাহান বেগম। তার
বাবার সঙ্গেও বেগম রোকেয়ার আলাপ ছিল। এভাবেই শিশু শ্রেণিতে পড়াশোনা শুরু
হয়ে যায়। বয়স তখন চারের বেশি হবে না। স্কুল পরম এক আনন্দ এনে দেয় নূরজাহান
বেগমের জীবনে। কারণ বাড়িতে তিনি নিঃসঙ্গ সময় কাটাতেন। সকাল ১০টায় ক্লাস
শুরু হয়ে চলত বিকাল ৪টা পর্যন্ত। স্কুলবাসেই ছাত্রীদের আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা
ছিল। বিশাল মাঠজুড়ে খেলা, স্কুলের পরিবেশ, বন্ধু সব কিছু এক কথায় চমৎকার
হলেও ছোট্ট নূরীর আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু একসঙ্গে পড়া একটু কষ্টকর
ছিল। তাই বাবা তাকে বেলতলা হাইস্কুলে নিয়ে আসেন। এখানে তিনি ছিলেন দুই বছর।
আবার ফিরে আসেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে। এ স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে তিনি
ম্যাট্রিক পাস করেন। ভর্তি হন ব্রিটিশ পরিচালিত লেডি বেব্রোর্ন কলেজে। তখন
প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন মিস গ্রোস। কলেজের ছাত্রীদের জন্য পর্দাঘেরা বাসের
ব্যবস্থা ছিল। কলেজে এসে তিনি এক নব উত্তরণের স্বাদ পেলেন। সাংস্কৃতিক
অঙ্গনের দ্বার খুলে গেল। নাটক করলেন। যদিও মুসলমান মেয়েদের জন্য নাটক করা
নিষেধ ছিল, তার পরও তারা একতাবদ্ধ হয়ে সে নিষেধের বাঁধ অতিক্রম করেন। ১৯৪৪
সালে এ কলেজ থেকে আইএ এবং '৪৬ সালে বিএ পাস করেন।
৪.
লেখাপড়ার
সঙ্গে সঙ্গে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন সেবামূলক
কাজে নূরজাহানের আগ্রহ ও দক্ষতা ছিল অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা
উলেখ করা যেতে পারে। ১৯৪৬ সালের কথা, নূরজাহান তখন লেডি বেব্রোর্ন কলেজ
থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়েছেন। ওই সময় কলকাতায় ভয়াবহ সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু
হয়। এতে শত শত মানুষ প্রাণ দেয় ও মারাত্মক রকমের আহত হয়। আহতদের সেবার জন্য
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। লেডি ব্রেবোন কলেজে যে
ক্যাম্পটি খোলা হয়েছিল সেখানে নূরজাহান বেগম তার সব মায়া-মমতা দিয়ে সেবার
কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। তার মতো আরো বেশ কিছু যুবক-যুবতী এই কাজের জন্য এগিয়ে
আসেন। এদের মধ্যে সে যুগের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। শেখ
মুজিবুর রহমানের বিশেষ দায়িত্ব ছিল সেবাক্যাম্পগুলোর তত্ত¡াবধান করা।
একদিন তিনি লেডি ব্রেবোন কলেজের স্বেচ্ছাসেবী ক্যাম্পে গিয়ে দেখেছিলেন যে
একটি মারাত্মক রকমের আহত শিশুকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন নূরজাহান বেগম।
শিশুটির ক্ষতস্থান থেকে অবিরত রক্ত ঝরছিল, সেই রক্তে ভেসে যাচ্ছিল নূরজাহান
বেগমের সাদা শাড়ি এবং দুটি হাত। তবু তিনি পরম যতেœ শিশুটিকে চিকিৎসা দিয়ে
চলেছিলেন। এই ঘটনাটি সেদিনের সেই তরুণ ছাত্রনেতা কখনই ভুলতে পারেননি।
পরবর্তীকালে তিনি যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামে বিশাল ব্যক্তিত্ব
তখনো কোনো স্মৃতিচারণা কিংবা প্রসঙ্গে নূরজাহান বেগমের কথা উঠলে বঙ্গবন্ধু
তার সেই সেবাময়ী রূপটির কথা উলেখ করতেন।
৫.
মোহাম্মদ
নাসিরউদ্দীন সব সময়ই ভাবতেন সাহিত্য ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতিভা বিকাশের
লক্ষ্যে বিশেষভাবে মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত পত্রিকা বের করা প্রয়োজন। এই
উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ১৯৪৭ সালে বেগম নামের পত্রিকাটি প্রকাশ করলেন মহিলাদের
জন্যই। প্রথম দিকে কিছুদিন কবি বেগম সুফিয়া কামাল এই পত্রিকার সম্পাদকের
দায়িত্বে ছিলেন। কিছুদিন পরে পত্রিকাটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব পান নূরজাহান
বেগম। সাংবাদিক বাবার কাছ থেকে পত্রিকা সম্পাদনার কাজটি তিনি ভালোভাবে
শিখতে পেরেছিলেন এবং আজ অবধি সেই শিক্ষার যোগ্য মূল্য দিয়ে চলেছেন। সেই
সময়ে বেগম সুফিয়া কামাল, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, নুরুন নেসা বিদ্যা
বিনোদিনী, বেগম শামসুন নাহার মাহামুদ, আশাপূর্ণা দেবী, প্রতিভা বসু, সেলিনা
পন্নী প্রমুখ লেখিকারা বেগম-এ নিয়মিত লিখতেন। বেগম-এর জনপ্রিয়তা খুব দ্রুত
বৃদ্ধি লাভ করেছিল। এরপর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দুই ভাগ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো
পাকিস্তান। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন কলকাতা থেকে চলে এলেন ঢাকায়। তার স্বপ্ন
এবং সাধনার ফসল মাসিক সওগাত ও সাপ্তাহিক বেগম তিনি ঢাকা থেকে পত্রপলবে
পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করবেন এই প্রতিশ্রুতি হৃদয়ে ধারণ করে ঢাকার
পাটুয়াটুলীতে স্থাপন করলেন সওগাত প্রেস তথা তার প্রিয় ছাপাখানাটি। সেই
প্রেস থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করলো সওগাত এবং বেগম। নূরজাহান বেগম দ্বিগুণ
উৎসাহে বেগমকে সুন্দর করে তোলার কাজে ব্রতী হলেন। যদিও সেই ১৯৫০ সালে ঢাকার
যে অবস্থা ছিল তাতে করে আগ্রহী মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের লেখা
দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করা ছিল খুবই কঠিন কাজ। নূরজাহান বেগম শুধু পত্রিকা
প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকেননি, মহিলাদের উন্নতিকল্পে ও সমাজসেবার আগ্রহ নিয়ে
তিনি ঢাকায় নারিন্দা মহিলা সমিতি এবং গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি গড়ে তোলেন।
৬.
নূরজাহান
বেগম শৈশবেই বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কাছে সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ নেন।
এরপর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষ হবার একবছর আগে ১৯৪৫ সালে বাবাকে সহযোগিতা
করার জন্য সওগাত পত্রিকা অফিসে বসতে শুরু করেন। পরীক্ষা শেষ হলে তিনি
সওগাত পত্রিকার সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করেন। মোহাম্মদ
নাসিরউদ্দীন ১৯২৭ সালে মাসিক 'সওগাতে' 'জানানা মহল' নামে প্রথম মহিলাদের
জন্য একটি বিভাগ চালু করেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমান মেয়েরা বিভাগটি টিকিয়ে
রাখতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেননি। মেয়েদের এগিয়ে না আসার কারণে মোহাম্মদ
নাসিরউদ্দীন সিদ্ধান্ত নেন মেয়েদের লেখা দিয়ে বছরে একবার 'সওগাত' এর একটি
সংখ্যা বের করবেন। এরই প্রেক্ষাপটে তিনি মেয়েদের ছবি দিয়ে ১৯২৯ সালে মহিলা
সংখ্যা 'সওগাত' প্রকাশ করেন। এই সংখ্যাটি বের করতে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন
অন্দরমহলের নারীদের কাছ থেকে লেখা ও ছবি সংগ্রহ করতেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত
সওগাত মহিলা সংখ্যা বছরে মাত্র একটা করে প্রকাশ করা হয়। এসব প্রকাশনার
সঙ্গে নূরজাহান বেগম সবসময়ই বাবার পাশে থেকেছেন। কবি সুফিয়া কামালও মহিলা
সংখ্যা 'সওগাত' এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের
উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
এর কার্যালয় ছিল কলকাতার ১২ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িতে। আলোচনার
ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় 'বেগম' এর প্রচ্ছদে মহিলার ছবি ছাপা হবে। সেই
মোতাবেক প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ছবি ছাপা হয়।
'বেগম' এর প্রধান সম্পাদক হন বেগম সুফিয়া কামাল এবং নূরজাহান বেগম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব্ব পালন করেন। তবে 'বেগম'-এ সুফিয়া কামালের
নাম থাকলেও নূরজাহান বেগমই এর দেখাশুনা করতেন। 'বেগম' পত্রিকায় মূল
বিষয়গুলো স্থান পায়। যেমন- নারী জাগরণ, কুসংস্কার বিলোপ, গ্রামে-গঞ্জের
নির্যাতিত মহিলাদের চিত্র, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের
মেয়েদের জীবনবোধ থেকে লেখা চিঠি এবং মণীষীদের জ্ঞানগর্ভ বাণী। 'সওগাত'
পত্রিকা অফিসে বসে নূরজাহান বেগম 'বেগম' পত্রিকার কাজ করতেন। বেগম সুফিয়া
কামাল মাঝে মধ্যে 'বেগম' পত্রিকা অফিসে এসে দু-একটা লেখা সংগ্রহ করে দিয়ে
যেতেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না থাকায় লেখা সংগ্রহ করাও ছিল খুবই
কষ্টসাধ্য। ঘরে বসেই ফোনের মাধ্যমে লেখা সংগ্রহ করতে হতো। প্রথমে ভেবেছিলেন
হিন্দু-মুসলমান লেখিকাদের মিলিত প্রয়াসে পত্রিকাটি চালাবেন। কিন্তু
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হিন্দু লেখিকাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
হয়ে যায়। এদিকে পত্রিকায় প্রতি সংখ্যায় বিভাগ অনুযায়ী একাধিক নিবন্ধ,
প্রবন্ধ, প্রতিবেদন দরকার। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন নূরজাহান বেগমকে বিভিন্ন
ইংরেজি পত্র পত্রিকা থেকে প্রতিবেদনগুলো অনুবাদ করে ছাপানোর পরামর্শ দেন।
এরপর তিনি ইংরেজি পত্রিকার প্রতিবেদনগুলো নিজেদের প্রয়োজনমতো সহজ সরল ভাষায়
অনুবাদ করে 'বেগম' পত্রিকায় প্রকাশ করতে লাগলেন। এতে লেখা সংগ্রহের সমস্যা
কিছুটা হলেও নিরসন হলো। 'বেগম' প্রকাশের প্রথম দিকে প্রতিটি সংখ্যা প্রকাশ
করতে নূরজাহান বেগমকে খুবই পরিশ্রম করতে হয়। লেখিকার সংখ্যা কম, কবিতা নেই
বললেই চলে, ছোট গল্প, উপন্যাস তো নেইই। ১৯৪৭ সালে বেগম সুফিয়া কামাল
কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাত্ ঢাকায় চলে আসার পর থেকে নূরজাহান
বেগম 'বেগমের' সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৪৮ সালে তিনি
কলহকাতায় প্রথম 'ঈদ সংখ্যা বেগম' প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে দেশের
রাজনৈতিক অবস্থা চরমে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের কোনো যোগাযোগ
নেই। ফলে লেখিকাদের লেখা সংগ্রহ করা ভীষণ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই
পরিস্থিতিতে তিনি অনেক কষ্ট করে লেখা সংগ্রহ করে 'ঈদ সংখ্যা বেগম' প্রকাশ
করেন। ১৯৪৯ সালে "বিশ্ব নবী সংখ্যা বেগম" প্রকাশ করেন। এদিকে কলকাতার
পরিবেশ ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক জটিলতার কারণে কলকাতায়
মুসলমানদের জন্য নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সপরিবারে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকায় এসে
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন কোথাও একজায়গায় বাড়ি এবং প্রেস পেলেন না। পরে খবর
পেলেন ঢাকার বিজয়া প্রেসের মালিক বিজয় চন্দ্র বসু তাঁর প্রেস কলকাতার কোনো
প্রেসের সঙ্গে বদল করতে চান। সেই মোতাবেক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ঢাকায় এসে
৬৬ লয়াল স্ট্রীটের বিজয়া প্রেস দেখেন এবং সেই সঙ্গে ৩৮ নম্বর শরত্গুপ্ত
রোডের বসত বাড়িটিও পছন্দ করেন। এবার পাকাপাকিভাবে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত
নেন। ১৯৫০ সালে তাঁরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। 'বেগম' পত্রিকার বয়স তখন
মাত্র তিন বছর ছয় মাস। বুড়িগঙ্গার কাছে লয়াল স্ট্রীটের প্রেসটি ছিল চারদিকে
খোলামেলা। তখন বিদ্যুত্ও ছিল না কিন্তু বুড়িগঙ্গা নদীর বাতাস ছিল। ঢাকায়
এসে নূরজাহান বেগম ৩৮ নং শরৎ্গুপ্ত রোডের বাড়িতেই 'বেগম'-এর কাজকর্ম
দেখাশোনা শুরু করেন। এখানেই 'বেগম' পত্রিকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়।
অনুষ্ঠানে বহু কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকের সমাগম ঘটে। এসময় ঢাকার মেয়েরাও
লেখালেখিতে তেমন এগিয়ে আসেনি। মহিলা লেখিকাদের কাছ থেকে যে লেখাগুলো পাওয়া
যেত তা একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিচালনা করার মতো যথেষ্ট ছিল না। ফলে আগের
মতোই বিদেশী পত্রিকা থেকে অনুবাদ করে বিভিন্ন বিভাগ প্রকাশ করতে থাকেন।
এরপর তিনি বাবার উদ্যোগে ১৯৫১ সালে 'ঈদ সংখ্যা বেগম' প্রকাশ করেন। মোহাম্মদ
নাসিরউদ্দীন 'বেগম' পত্রিকা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের জন্য তাঁকে সঙ্গে নিয়ে
বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দিতেন। তিনি বাবার সঙ্গে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে
আনতেন। নূরজাহান বেগম নানা প্রতিকূলতার মাঝে ধীরে ধীরে 'বেগম' পত্রিকা
নিয়ে অগ্রসর হন। এসময় সাহিত্য কর্মে মুসলমান নারী সমাজও অংশগ্রহণ শুরু
করেন। ক্রমান্বয়ে সারা বাংলাদেশে 'বেগম' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মহিলা কবি,
সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। নূরজাহান
বেগমের অক্লান্ত পরিশ্রম, আন্তরিকতা, কর্মনিষ্ঠা এবং মোহাম্মদ
নাসিরউদ্দীনের পৃষ্ঠপোষকতায় 'বেগম' দ্রুত মহিলাদের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক
পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। 'বেগম'-এ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নিবন্ধের
পাশাপাশি রান্না, সেলাই, সৌন্দর্য চর্চা, শিশু বিভাগ প্রভৃতি প্রকাশিত
হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মেয়েরাও 'বেগম' পত্রিকার লেখকের তালিকায়
অন্তর্ভুক্ত হয়। ছবিসহ লেখা ছাপানোর ব্যবস্থা থাকায় 'ঈদ সংখ্যা বেগম'-এ
লেখিকাদের অংশগ্রহণ বিপুলভাবে বেড়ে যায়। এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয় অনেক পুরুষ
পাঠক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই বাংলার মানুষ প্রথম অবহিত হন, সাহিত্য ক্ষেত্রে
মুসলমান মেয়েদের পদচারণা শুরু হয়েছে।
৭.
এদেশের
লেখিকাদের মধ্যে একটি সুন্দর যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ১৯৫৫ সালে
প্রতিষ্ঠিত হলো বেগম ক্লাব। এই বেগম ক্লাব-এ শুধু যে লেখিকারাই সমবেত হন তা
নয়, গায়িকা, শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, সমাজ সেবিকা থেকে শুরু করে সব রকমের
কর্মী মহিলারাই এখানে এসে গৌরববোধ করেন। নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত নূরজাহান
বেগমের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ‘বেগম’ ক্লাবের নামও। ‘বেগম’
পত্রিকার প্রকাশনার এক পর্যায়ে মোহাম্ম্দ নাসিরউদ্দীন বেগম শামসুন নাহার
মাহমুদ এবং কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে ক্লাব গঠন নিয়ে আলোচনায় বসেন। তাঁরা
দু'জনেই ক্লাব গঠনের পক্ষে রায় দেন। ‘বেগম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করার কথাও
তাঁরই মুখে শোনা যাক। ‘আব্বা [মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন] উদ্যোগী হয়ে বেগম
শামসুন নাহার মাহমুদ ও কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে ক্লাব গঠন নিয়ে আলোচনায়
বসেন। এরপর ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেগম
ক্লাব। এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ এবং সেক্রেটারি
হয়েছিলাম আমি আর খালাম্মা [বেগম সুফিয়া কামাল] ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা।
বেগম ক্লাবের কোনো কার্যনির্বাহী সদস্য করা হয়নি কারণ আব্বা নিজেই
অনুষ্ঠানের সব খরচ বহন করেছিলেন।’ 'বেগম ক্লাব' এর উদ্বোধন উপলক্ষে এক
মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বহু মহিলা কবি সাহিত্যিক ও
সংস্কৃতিসেবীর সমাগম হয়। নূরজাহান বেগম 'বেগম ক্লাবের' সেই উদ্বোধনী
অনুষ্ঠানে ক্লাবের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, "বাংলার মহিলা সমাজের উন্নয়নের
জন্য এ পর্যন্ত 'বেগম' যা কিছু করেছে, তা প্রায় সকলেই অবগত আছেন। 'বেগম' এর
সেবাব্রতকে আরও সুদূরপ্রসারী করার জন্য, সাপ্তাহিক 'বেগম' এর লেখিকা,
পৃষ্ঠপোষক ও অন্যান্য সাহিত্যিকার সমন্বয়ে একটি সমিতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা
আমরা অনুভব করি। মহিলাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নের কাজ চালানোর
জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। এই সমিতির মাধ্যমে আমরা
একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি ও উত্সবাদি উদযাপন করতে পারবো,
অপরদিকে সংঘবদ্ধভাবে আমাদের ভবিষ্যত্ উন্নয়নের কথাও চিন্তা করতে পারবো।
আমাদের সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমে শক্তিশালী সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হবে।"
প্রথমে একটি টিনশেডের ঘরে ক্লাবের কাজ শুরু হয়। তখন এর আসন সংখ্যা ছিল
পঁচাত্তর থেকে আশি জনের। প্রথম অবস্থায় 'বেগম ক্লাবে' শুধু মাত্র সাহিত্য
বা অন্য নানা বিষয় আলোচনা চললেও পরবর্তীতে এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও
আয়োজন করা হয়। নূরজাহান বেগম নিজেই সঙ্গীত শিল্পী হুসনা বানু ও লায়লা
আর্জুমান্দ বানুর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের দু'জনকে সাংস্কৃতিক বিভাগের
দায়িত্ব দেন। তাঁদের আন্তরিকতায় অন্যান্য নারী শিল্পীদের অভিভাবকরাও 'বেগম
ক্লাব'-এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেয়েদের আসতে বাধা দিতেন না। দেশের বরেণ্য
সমাজকর্মী ও শিল্পীরাও নিজ উত্সাহে বেগম ক্লাবে যোগ দেন। সেই সঙ্গে যোগ দেন
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যা রাজিয়া বানু, আশালতা সেন,
দৌলতুন নেসা সহ আরো অনেকে।
৮.
নূরজাহান
বেগমের পারিবারিক জীবন ছিল খুবই সুখের এবং আনন্দময়। প্রগতিশীল, উদারচেতা,
সংস্কারমুক্ত বাবার স্নেহের ছায়ায় বেড়ে ওঠায় তাঁর চিন্তা ভাবনায়ও এর
প্রতিফলন ঘটে। মা ফাতেমা খাতুনের নিত্য সাহচর্য, চিন্তাচেতনা, জীবনবোধ তাঁর
ওপর প্রভাব ফেলে। একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে তিনি সবসময় মায়ের ছত্রছায়ায়
থেকেছেন। 'বেগম' পত্রিকার মাধ্যমেই রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) এর সঙ্গে
তাঁর পরিচয় হয়। কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার কিছুকাল পওে, ১৯৫২ সালে বিশিষ্ট
সাংবাদিক ও শিশু সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খানের (দাদা ভাই) সঙ্গে নূরজাহান
বেগম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ফলে তাদের পুরো পরিবারটিই হয়ে ওঠে সাহিত্য ও
সাংবাদিকতার কেন্দ্রস্থল। বিয়ের পর তাঁরা বাবার বাড়িতেই ছিলেন। স্বামীর
উত্সাহ এবং সহযোগিতায় নূরজাহান বেগম কাজের গতিও বাড়িয়ে দেন। কর্মক্ষেত্রের
প্রতিটি ধাপে তিনি সবসময় বাবা ও স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন। বিয়ের বছর তিনেক
পর তাঁর বড় কন্যা ফ্লোরা নাসরীন খান শাখীর জন্ম হয়। ছোট কন্যা রীনা
ইয়াসমিন খান মিতি। স্বামী, সন্তান, জামাতা, নাতি-নাতনি, বাবা-মাকে নিয়ে
নূরজাহান বেগমের দিনগুলো সুখেই কাটছিল। ১৯৯৪ সালের ২১ মে বাবা মোহাম্মদ
নাসিরউদ্দীন মারা যান। এর পাঁচ বছর পর ১৯৯৯ সালে মাও মারা যান। আপনজনের
মৃত্যুতে নূরজাহান বেগম দিশেহারা হয়ে পড়েন। এরপর ১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্বর
স্বামী রোকনুজ্জামান খান হঠাৎ অসুস্থ অনুভব করেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে
পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরই তিনি মারা যান। এরপর থেকে নূরজাহান বেগম একাকী জীবন
যাপন করছেন। সাংবাদিক, শিশু সাহিত্যিক, সংগঠক রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই এর
সঙ্গে তাঁর পরিচয়, প্রণয় ও বিয়ে নিয়ে বলেছেন, ‘রোকনুজ্জামান খান [দাদা
ভাই] সাহেবের সঙ্গে সওগাত প্রেসেই আমাদের পরিচয়। তিনি তখন শিশু সওগাতের
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। তার সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা দায়িত্বশীলতা ও নম্র
ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমার আব্বার কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। আমি
একমাত্র সন্তান। তাই ভাবলাম বেগম ও সওগাত প্রেস দুটোর দায়িত্বই আমাকে এক
সময় পালন করতে হবে। আমার মনে হয়েছিল এ দায়িত্ব পালন করার জন্য দাদা ভাই-ই
আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারেন। আমার মনে হতো আমি চলে গেলে ‘বেগম’
বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ‘দাদা ভাইও সাংবাদিক হওয়ার কারণে সে ভয় ছিল না। ১৯৫২
সালে আমরা বিয়ে করি। বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক।
আমাদের বিয়েতে বাবা প্রথমে রাজি ছিলেন না। পরে ফজলুল হক সাহেব তাকে রাজি
করিয়েছিলেন। প্রতিটি বাঙালি মেয়ের জীবনেই দুটো দিক থাকে। বাবা-মার বাড়িতে
তারা খুব আদর-যতেœ বড় হয় এখানে তাদের নিজস্ব প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থাকে।
কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে অনেক মেয়েকেই
তার নাচ-গানসহ বহু পছন্দের বিষয় ছাড়তে হয়। দাদা ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার
কারণে আমাকে ‘বেগম’ ছাড়তে হয়নি। তার উৎসাহেই নিজের পছন্দমতো কাজ করতে
পেরেছি। পত্রিকা চালাতে গিয়ে কোনো সমস্যা হলে তিনি আমাকে সব সময়ই সাহায্য
করেছেন। জীবনসঙ্গী হিসেবে দাদাভাই ছিলেন খুব ভালো বন্ধু।’ আবার
পরিবারিকভাবে সহযোগিতার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমার পারিবারিক জীবন বেশ সুখের ও
আনন্দময়। শৈশবে প্রগতিশীল, উদারচেতা, সংস্কারমুক্ত আব্বার স্নেহের ছায়ায়
বেড়ে উঠি। অন্যদিকে মা ফাতেমা খাতুনের নিত্য সাহচার্য ও জীবনবোধ আমার
জীবনকে আলোকিত করেছে। বিবাহিত জীবনে এবং কর্মক্ষেত্রে আমার স্বামী
রোকনুজ্জামান খান উদারভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমার দুই সন্তান। বড় কন্যা
ফ্লোরা নাসরীন খান ও ছোট মেয়ে রীনা ইয়াসমিন খানও আমাকে অকুণ্ঠ সহযোগিতা
করেছে। বড় মেয়ে বেগমের দায়িত্ব নেওয়ায় আমি অবসর পেয়েছি। ও সফলভাবে নিজের
দায়িত্ব পালন করছে।’
৯.
আমাদের
দেশের নারী সমাজের সামাজিকভাবে অগ্রগতি সম্পর্কে তাঁর মতামত বা বক্তব্য
শোনা যাক। তিনি বলছেন, ‘আমাদের দেশের সার্বিক উন্নতি হলেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী
ও নারীরা বেশ পিছিয়ে রয়েছে। শহর এগিয়ে গেলেও দেশের বহু গ্রামে আজও ভালো
রাস্তাঘাট নেই, শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। গ্রামীণ নারীদের শিক্ষার হার
বাড়েনি। ধর্মীয় বাধা, মোল্লাদের ভয়-ভীতি রয়েছে। আমাদের মেয়েরা সারা জীবন
শশুরবাড়ি থাকে। তারপরও তারা নিজেদের জীবনে উন্নতি করতে চায়। আমি ব্রিটিশ,
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে বহু পরিবর্তন দেখেছি। নারীরা এখন নতুন নতুন
পেশায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। তবুও দেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকাকে তেমন
গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নারীদের নায্য সম্মান দিতে হবে। তাদের কাজের স্বীকৃতি
দিতে হবে।’
১০.
নূরজাহান
বেগম সাংবাদিকতা, সমাজসেবাসহ নানা ক্ষেত্রে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
আগেও বলেছি, তিনি লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে পড়া শেষ করেই নূরজাহান বেগম
বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সা¤প্রদায়িক
দাঙ্গা শুরু হলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কমতি ছিল না। প্রাক্তন মন্ত্রী
আব্দুল রশীদের স্ত্রী জেরিনা রশীদের অনুপ্রেরণায় নূরজাহান বেগম
সমাজসেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে খোলা একটি
রিফ্যুজি ক্যাম্পের কাজের মাধ্যমেই তাঁর সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের যাত্রা
শুরু হয়। তিনি রিফ্যুজি ক্যাম্পে দাঙ্গা বিধস্ত নারী ও শিশুদের সেবা করেন।
এমনকি মহিলাদের প্রসবের সময়ে নূরজাহান বেগম ডাক্তারদের সঙ্গেও কাজ করেন।
এসময়ে 'মুসলিম অরফ্যানেজ ও উইমেনস হোম' নামে একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হয়।
সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হন জেরিনা রশীদ আর সেক্রেটারি নূরজাহান বেগম। এর কাজ
শুরু হয় কলকাতার দরগাহ রোডের বিশাল এক জমিদার বাড়িতে। সবার কাছ থেকে চাঁদা
তুলে, সরকারী অনুদান, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও জেরিনা রশীদের আর্থিক
সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হতে থাকে। এছাড়া দুস্থদের সাহায্যের জন্য
নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকেন তাঁরা। ওয়াই ডব্লিউ সিএ থেকে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের 'সামান্য ক্ষতি' নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। এই নাটকটির পরিচালনার
দায়িত্ব্ব পান নূরজাহান বেগম এবং রোকেয়া রহমান কবির। নাটক মঞ্চস্থ করে
চাঁদা ওঠে একহাজার টাকা। এই টাকা থেকে ২৫০ টাকা তিনি কবি পতœীর চিকিৎসার
জন্য প্রমীলা নজরুলের হাতে তুলে দেন। ঢাকায় এসে তিনি প্রথমে ওয়ারী মহিলা
সমিতিতে কাজ শুরু করেন। তিনি নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি এবং পরে
গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সক্রিয়ভাবে সামাজিক কর্মকান্ডে
জড়িত হন। ১৯৫০ সালে বদরুনন্নেসা আহমদ ও আশালতা সেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।
তাঁরা তাঁকে সমাজসেবা কাজে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৫৬ সালে নূরজাহান
বেগম নারিন্দা মহিলা সমিতি গঠন করেন। এই সমিতির প্রথম প্রেসিডেন্ট হন
দৌলতুননেসা খাতুন। তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলে নূরজাহান বেগম
এই পদে অধিষ্ঠিত হন। নারিন্দা মহিলা সমিতির মাধ্যমে তিনি প্রাইমারী
বিদ্যালয় পরিচালনা, শিশুদের জন্য গঠনমূলক কর্মকাণ্ড, বয়স্ক শিক্ষার
ব্যবস্থা ইত্যাদি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে করেন। দেশে ভয়াবহ বন্যা
দেখা দিলে তিনি নারিন্দা মহিলা সমিতি ও কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার পক্ষ
থেকে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে কাজ করেন। ঢাকার ইসলামপুরের দোকান থেকে থান
কাপড় সংগ্রহ করে পোষাক তৈরি করে তা সমিতির ছয়জন মহিলাকে দিয়ে চট্রগ্রামে
ত্রাণকেন্দ্রে পাঠান। এভাবে তিনি আজীবন মানুষের সেবায় কাজ করে গেছেন।
এছাড়াও তিনি আপওয়া, জোনটা ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ,
মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সদস্যরূপে সমাজসেবা
করেছেন। সাহিত্য ও সমাজ সেবায় অক্লান্ত শ্রম দানের জন্য তিনি বেশ কিছু
পুরস্কার লাভ করেছেন। বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৭)সহ নূরজাহান বেগম পেয়েছেন নানা
সম্মাননা, স্বীকৃতি।।