বাঁশিতেই চলছে মিন্টুর জীবন সংসার

মামুনুররশিদ মেরাজুল -

সুর ও সঙ্গীত ভালোবাসে না-এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। সুর যেমন আকৃষ্ট করে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, তেমনি আকর্ষিত করে শিশুদের। শুধু তাই নয়,বদ্ধ পাগলদেরও দেখা যায় গানের সুরে সুরে মাথা ও শরীর দুলিয়ে আনন্দের প্রকাশ ঘটাতে। পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবে না,যিনি মনের আড়ালে গুণ গুণ সুরে আওয়াজ করেন না। এ সুর অনেককেই শান্তির ঠিকানা দিয়েছে,উঠিয়েছে সম্মানের উচ্চ শিখরে,পরিচয় করিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। আবার অনেক নিঃস্ব,সহায়-সম্বলহীন প্রতিভাধর সুর পাগল মানুষ অর্দ্ধাহারে-অনাহারে থেকেও সুরের সাধণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনই একজন সুর পাগল মানুষ রংপুরের আজিজার রহমান মন্টু। বর্তমান বয়স সত্তরের কাছাকাছি। ছোট বেলা থেকেই বাঁশির প্রতি তার গভীর আকর্ষণ। ইচ্ছে ছিল বাঁশিতে তালিম নিয়ে নাম লেখাবেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, মন-মাতাবেন দর্শক-শ্রোতাদের,বাহবা কুড়াবেন সকল মহল থেকে। কিন্তু “নুন আনতে পান্তা ফুরোয়”র পরিবারে জন্ম নেয়ায় মন্টুর ভাগ্যে তা সম্ভব হয়নি। বাঁশিতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ তো দুরের কথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ও পেরুতে পারেননি। তারপরও পিছপা হননি তিনি। দারিদ্রতাকে সাথে নিয়েই স্বপ্রচেষ্টায় একটু একটু করে বাঁশিকে তার আয়ত্বে আনতে সক্ষম হয়েছে।
মন্টু মিয়া তার জীবনের  শুরু থেকেই জীবিকার তাগিদে বেছে নেন রাজমিন্ত্রীর যোগানদারের কাজ। হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পর ক্লান্ত দেহে নির্জনে বসে কিংবা কাজের  ফাঁকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা সুরে বাঁশি বাজিয়ে মনকে কিছুটা শান্তনা দিতেন। দিনে সুযোগ না পেলে রাত্রিতে খোলা মাঠে বসে বাঁশি বাজাতেন।  এভাবে ওস্তাদ ছাড়াই তার বাঁশি শেখা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় সুর,লয় বা তাল সম্পর্কে তার তেমন ধারণা নেই। এসব পেশাদার বাদ্য যন্ত্রীদের ব্যাপার। সাধারণ মানুষ তো এতো কিছু বোঝে না। তাই তার সুরের মূর্চ্ছণায় সাধারণ শ্রোতারা বিষ্ময় প্রকাশ করেন।
এভাবেই কেটে গেছে তার জীবনের বেশির ভাগ সময়। কিন্তু, বিধাতার কি লিখন, সত্তর বছর বয়সী মন্টু মিয়া তার জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে ইট-পাথরের ভারি বোঝা বহণে যখন অক্ষম, ঠিক তখনই তাকে দুমুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার পথ দেখিয়েছে এ বাঁশের বাঁশি।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ডের বডবাড়ি রোড, ডাঙ্গিরপাড় মহল্লায় পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত মাত্র সোয়া দুই শতক জমির উপর নির্মিত একটি টিনের চালা ঘরে তার বসবাস। তিন কন্যা ও দু’পুত্রের জনক মন্টু মিয়ার ইতোমধ্যেই দু’কন্যাকে পাত্রস্থ করেছেন। তৃতীয় কন্যা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ বেকার ছোট ছেলে, প্রতিবন্ধী মেয়ে, এক নাতি ও স্ত্রীসহ ৫ সদস্যের এ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মন্টু মিয়া। পরিবারের সদস্যদের অন্ন জোগাতে তাকে বেছে নিতে হয়েছে এ ব্যবসা।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার হরিণমারি গ্রামের জনৈক বাঁশির কারিগর সেলিম মিয়ার নিকট থেকে নগদ অর্থে বাঁশি খরিদ করেন। বিক্রি করেন রংপুর মহানগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে। কখনও প্রেস ক্লাব চত্তর, কখনও পায়রা চত্তর,টাউন হল চত্তর আবার কাচারী বাজারসহ বিভিন্ন জনসমাগম এলাকার ফুটপাথে বসে গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সুমধুর সুরে বাঁশি বাজান। আর তখনই বাঁশি প্রেমিরা তাদের ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে ছুটে যান তার কাছে।
মন্টু মিয়া জানান, “তার বাঁশির গ্রাহকদের প্রায় শত ভাগই তরুণ-তরুণী। ছেলেদের মতো মেয়েদেরও বাঁশির প্রতি বেশ আগ্রহ রয়েছে। কেউ কিনেন শেখার জন্য,কেউ কিনেন স্বজনদের উপহার দিতে, আবার কেউ কেউ কিনেন শো-পিচ হিসেবে ব্যবহারের জন্য।” বাঁশির ধরণ হিসেবে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। তবে বেশি দামের বাঁশি এখানে চলে না। তাই ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা মূল্যের বাঁশিই তিনি বিক্রি করেন। অনেকে খুশি হয়ে মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে যান। এভাবে  দিনে ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এতে তার গড় মাসিক আয় হয় তিন হাজার টাকা। এ সামান্য আয়ে তার ৫ সদস্যের সংসার পরিচালনায় হিমসিম খেতে হয়। অর্থের অভাবে ছোট ছেলে এইচএসসি পাশ করার পর তাকে  কলেজে ভর্তি করাতে পারেননি। প্রতিবন্ধী মেয়ের বয়স ২২/২৩ পেরিয়ে গেছে।  মন্টু মিয়া আক্ষেপের সুরে জানালেন, ‘‘বর্তমান যুগে সবল সুস্থ মেয়েদেরই সঠিক সময়ে বিয়ে দেয়া যাচ্ছে না, আমার মেয়ে তো প্রতিবন্ধী।”
মহানগরীতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সমূহে তাকে মাঝে মধ্যে বাঁশি বাজানোর জন্য ডাকা হতো। তা থেকে কিছু উপার্জন সম্ভব ছিল। কিন্তু আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের বদৌলতে বাঁশের বাঁশির কদর অনেকটাই কমে গেছে।  প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা শারিরিক অসুস্থতার কারণে কোনদিন বাড়ি থেকে বেরুতে না পারলে সেদিন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অর্দ্ধাহারে কিংবা অনাহারে থাকতে হয়। করতে হয় ধার-দেনা,শুনতে হয় বিবির নানা গঞ্জনা। এভাবেই চলছে মন্টু মিয়ার বিগত ১০/১১ বছরের জীবন। তার বাঁশির সুরই বলে দেয় তিনি কষ্টে আছেন-না আনন্দে। কখনও করুণ আবার কখনও কখনও প্রাণ চাঞ্চল্যকর সুর বাজিয়ে নিজের সুখ-দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। মোহিত করেন পথচারি কিংবা ব্যবসায়ীদের। বিরামহীন এ মানুষটির চোখে-মুখে শুধুই হতাশা। তবে তার বড় কোন চাওয়া-পাওয়া নেই।  প্রতিবন্ধী কন্যার পূনঃর্বাসন ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ ছোট ছেলের  কর্মসংস্থান হলেই তিনি খুশি

পুরোনো সংবাদ

রংপুর 3004825446863493757

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item