বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ বদলে দিতে পারে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি

ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়/ শামিম হোসেন বাবু ॥
উত্তরের জেলা নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জে আবদুল কুদ্দুস কফির বাণিজ্যিক চাষের মাধ্যমে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এ অঞ্চলের সবাইকে। কফি চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু করা গেলে বদলে যেতে পারে এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা।
কফি শব্দটি মূলত ইংরেজি। কফি গাছ দেখতে অনেকটা বেলি ফুলের গাছের মতো। তবে তা উচ্চতা ও ঘেরের দিক থেকে বেশ বড়। ভূূগোলের পরিচয়ে কফি একটি পানীয় অর্থকরী ও বাগিচা ফসল। উদ্ভিদ বিদ্যার ভাষায় এক ধরনের চিরহরিৎ বৃক্ষের ফলের বীজ। ফল পাকলে তা শুকিয়ে কিংবা পুড়িয়ে গুঁড়ো করা হয়। সেই গুঁড়ো উপাদান চিনি ও ঘন দুধের সাথে মিশিয়ে এক উষ্ণ পানীয়দ্রব্যে পরিণত করা হয়। কফিতে ক্যাফেইন নামে এক ধরনের উত্তেজক পদার্থ রয়েছে। ৮ আউন্স কফিতে প্রায় ১৩৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। সূত্র মতে, কফি জ্বালানি তেলের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিক্রীত পণ্য এবং বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বেশি পান করা পানীয়ের মধ্যে অন্যতম।
সবুজ কফি বিশ্বের সব থেকে বেশি বিক্রীত কৃষি পণ্যের মধ্যে একটি। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে এখন কফির চাষ হচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশেও কফির চাষ হচ্ছে। ৯ বছর আগে ভারতের দার্জিলিং থেকে অ্যারাবিয়ান জাতের দু’টি কফির চারা নিয়ে এসেছিলেন কক্সবাজারের জাহানারা অ্যাগ্রো ফার্মের পরিচালক জাহানারা ইসলাম। পরীক্ষামূলকভাবে তিনি কফি চাষ শুরু করেন। তার সফলার খবর পেয়ে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের আবদল কুদ্দুস কক্সবাজারের জাহানারা অ্যাগ্রো ফার্ম থেকে ২০১৪ সালে ১৫৪টি চারা এনে নিজের দুই শতক জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেন। নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জের মুনশি পাড়ার মরহুম জবান উদ্দিনের ছেলে আবদুল কুদ্দুস (৭০)।
কফি চাষের সম্ভাবনা ও প্রাপ্তি স¤পর্কে আবদুল কুদ্দুস জানান, ২০০৯ সালে ঢাকায় নার্সারি সমিতির মিটিংয়ে গিয়ে প্রথম কফি চারার খবর পাই। ২০১৪ সালে কক্সবাজারের জাহানারা অ্যাগ্রো থেকে ১৫৪টি গাছ এনে আমি আমার নার্সারির দুই শতক জমির মধ্যে তিন ফুট ফুট পরপর চারা রোপণ করি। কফির গাছ বাড়তে থাকে। দুই বছর পর ফলন শুরু হয়েছে। কফির গাছগুলো আমি জাল দিয়ে ওপর থেকে ঘিরে রেখেছি। যাতে পাখিরা খেয়ে ফেলতে না পারে। শুকনো কফি আপাতত আটার মিলে মাড়াই করে স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করছি। এ কফির স্বাদ ও গন্ধ দুটোই ভিন্ন। খুব সুস্বাধু ও মনকাড়া। তিনি বলেন, গত বছর আমি ৬৭ কেজি কফি উৎপাদন করেছি। যা গড়ে দুই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করে প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ঘরে তুলেছি। কফির গাছগুলো চাষ, পরিচর্যা এবং মাড়াইয়ে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এবারো ভালো ফলন হয়েছে।
তিনি বলেন, বিষয়টি আমি স্থানীয় কৃষি বিভাগকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ চেয়েছি একাধিকবার। কিন্তু কৃষি বিভাগের সে রকম কোনো আগ্রহ আমি দেখিনি।
তিনি বলেন, আমার বাগানে উৎপাদিত কফি বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করতে চেষ্টা করি। এ জন্য বিএসটিআইএর লাইসেন্সের জন্য রাজশাহী যাই। কিন্তু সেখানে থেকে লাইসেন্স দেয়া হয়নি। ফলে কফির মূল্য আমি পাইনি। তবে আমার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু চারা উত্তর বাঁশখানা গ্রামের আফজাল হোসেনসহ অনেকেই নিয়েছেন। তারাও চাষ করছেন। শুধু কিশোরগঞ্জ নয়, পুরো উত্তরাঞ্চলে কফি চাষ করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন সরকার ও কৃষি বিভাগের কার্যকরী উদ্যোগ। তাহলে কফি চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু করা সম্ভব। এতে দেশের গন্ডি পেরিয়ে কফি আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করা যেতে পারে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
কফি চাষের উপযোগিতা : ভূমির ঢাল সামান্য ঢালু হলে কফি চাষের পক্ষে আদর্শ হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০ ফুট ওপরে যেকোনো মাটিতে কফি চাষ করা সম্ভব। তবে পাহাড়ি, উপত্যকা ও ঝরণার পাশের জমি এবং যেসব জায়গায় লবণাক্ততা নেই সেসব জমি কফি চাষের উপযোগী। এ ছাড়া রাবার বাগানের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো যায় কফির চারা। বাড়ির আঙ্গিনা, ফুলের টব কিংবা বাড়ির ছাদেও কফির চাষ সম্ভব। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময় হলো কফির মওসুম। এই সময় কফির উপযোগী স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও পরিমিত উষ্ণতা বজায় থাকে। এতে গাছ অল্প সময়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায়, প্রচুর ফল ধরে ও ফলগুলো যথেষ্ট পুষ্ট হয়। কফি বাগান করে ফলানো হয়। গাছ স্বাভাবিকভাবে ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হলেও কফি ফল সংগ্রহের জন্য বাগানের গাছ লম্বা করা হয় না। গাছের ডালপালা ছেঁটে দুই মিটারের মধ্যে রাখা হয়, যাতে গাছের ফল হাতের নাগালে থাকে। চারা রোপণের দুই বছরের মধ্যে কফির গোটা সংগ্রহ করা যায়। কফির গোটাগুলো দেখতে অনেকটা গমের মতো। তবে তা আকারে একটু বড়। বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বছরে দুইবার গাছ থেকে গোটা সংগ্রহ করা সম্ভব। একটি কফি গাছ থেকে প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে ফল পাওয়া যায়। খুব অল্প সময়ে কফি তৈরি করা যায়। কফির বিনগুলো শুকিয়ে গুঁড়ো করে তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয় কফি। এ কফি বাজারের সাধারণ কফির চেয়ে সুস্বাদু। বাজারের কফিতে কেমিক্যাল ও প্রিজারবেটিভ থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশে কফি চাষের ক্ষেত্রে প্রতিটি গাছে খরচ হয় এক থেকে দেড়শ টাকা। প্রতিটি গাছ থেকে বছরে আধা কেজি বা তারও বেশি কফির গোটা বা ফল পাওয়া যায়। বর্তমানে কফির প্রতি কেজির দর তিন হাজার থেকে চার হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত।
কফি চাষে কিছু সমস্যা : কফির চাষের অন্যতম সমস্যা হলো প্রখর সূর্য কিরণ। কফি যেহেতু ক্রান্তীয় উষ্ণমন্ডলের ফসল; সেহেতু এ সমস্যা থেকেই যায়। ভারতের কফি বাগিচাতে এ জন্য নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর কলাগাছ রোপণ করা হয় সরাসরি সূর্যকিরণ থেকে কফি গাছ রক্ষার। ব্রাজিলের কফি বাগিচাগুলোতে এ রকম ছায়া প্রদানকারী কোনো গাছ লাগানো হয় না। সেখানকার বাগিচাগুলো উচ্চভূমির দক্ষিণমুখী ভূমিঢালে গড়ে ওঠায় সূর্যের কিরণ পড়ে। ফলে সূর্যকিরণের প্রখরতা তেমন থাকে না। আটলান্টিক মহাসাগর নিকটবর্তী হওয়ায় সামুদ্রিক আর্দ্রতা, হালকা কুয়াশা কফি চাষ অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। ব্রাজিলের এ অঞ্চলের জলবায়ু এতটাই অনুকূল যে নেমাটোড নামে কীটেরাও কফির গাছে তেমন ক্ষতি করতে পারে না। তবে বাংলাদেশেও বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত পার্বত্য এলাকা কফি চাষে উপযোগী।
মধু ও শ্যা¤পু তৈরিতে সহায়ক : কফি গাছের অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে মধু ও শ্যা¤পু তৈরি করা যায়। মধু চাষে কফি বাগানে কয়েকটি কফি গাছের মাঝের খোলা নির্দিষ্ট স্থানে একটি কাঠের তৈরি মৌমাছির জন্য বিশেষভাবে ছোট আকারে তৈরি বিশেষ বাক্স বসাতে হবে। কফি গাছে ফুল এলেই মৌমাছিরা সেখানে আসবে। ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে কাঠের তৈরি ওই বাক্সে বাসা বাঁধে মৌমাছি। একটি কফি গাছের ফুল থেকে প্রতিবারে একশ গ্রাম মধু সংগ্রহ করা সম্ভব। পাশাপাশি ওই গাছের উপকরণ প্রক্রিয়া করে উন্নতমানের শ্যা¤পু তৈরি করা যায়।

পুরোনো সংবাদ

নীলফামারী 2604006781762083819

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item