মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের বাধাসমূহঃ

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে জাতির প্রাণ। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ভিতটা মজবুত করতে না পারলে জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন অলিক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। স্বাধীনতা অর্জনের ৪০ বছর অতিবাহিত হলেও যোগ্যতাভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও আজও প্রাথমিক শিক্ষা তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।যদিও অন্যান্য ক্ষেত্রে দেশ অনেকখানি এগিয়েছে। এক সময় প্রাথমিক শিক্ষার পরিমানগত উন্নয়নে কার্যক্রম গ্রহন করা হলে তা সফলতা অর্জন করে। যার উপর দাড়িয়ে আজ ্্্প্রাথমিক স্তরে ১০০% ভর্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্ত এ অর্জন ধরে রেখে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছেনা কিছু সমস্যার কারণে।এ সমস্যা/বাধাসমূহ দূর করতে পারলে প্রাথমিক শিক্ষা তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে বলে মনে করি।
                                             মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে বাধাসমূহ হচেছ নিম্নরুপঃ

           ১। শিক্ষক স্বল্পতা ঃ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে বাধাসমূহের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় শিক্ষক স্বল্পতার কথা। যদিও অনেকে দ্বিমত পোষন করতে পারেন। বর্তমানে শিশু শ্রেণিসহ প্রাথমিক স্তরে ছয়টি শ্রেণি বিদ্যমান। শিশু শ্রেণি বাদে পাঁচটি শ্রেণিতে মোট ৩৯টি বিষয়ে পাঠদান করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে শিশু শ্রেণিসহ মোট ৬জন শিক্ষক কর্মরত থাকলে(যদিও অনেক বিদ্যালয়ে ২/৩জন কর্মরত এমনকি পত্রিকায় আসে কোন কোন স্কুল ১ জন শিক্ষক দ্বারাও চালানো হচ্ছে)প্রতিজনকে অন্ততঃ ৬টি বিষয়ে পাঠদান করতে হয়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, নিরক্ষরকে অক্ষর জ্ঞান দানকরা সাক্ষরকে পাঠদান করা একি কথা নয়।প্রাথমিক স্তরে শ্রেণিকক্ষেই শিশুদের পড়া দেয়া নেয়ার কার্যক্রমটি সম্পন্ন করতে হয়। অথচ অন্যান্য স্তরে তা করতে হয় না। এমতাবস্থায় একজন শিক্ষকের পক্ষে প্রতিদিন ৬টি বিষয়ে পাঠদানে কতটুকু মান নিশ্চিত করা সম্ভব তা প্রশ্ন সাপেক্ষ বটে। এছাড়াও দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয় ২শিফটে পরিচালিত। যেখানে এক শিফটে পরিচালিত বিদ্যালয়ের প্রতি ঘন্টার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৫-৫৫মিনিট পর্যন্ত সেখানে দুই শিফটে পরিচালিত বিদ্যালয়ের প্রতিটি ঘন্টার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০-৩৫মিনিট পর্যন্ত। এই ৩০-৩৫মিনিটে আদৌ কি গুনগতমান নিশ্চিত করা সম্ভব? এক্ষেত্রে শিক্ষকের নৈমিত্তিক ছুটির কথা বাদই দিলাম। সুতরাং আমার মতে স্কুল প্রতি আন্ততঃ ৮জন শিক্ষক থাকলে শিক্ষার মান অনেকখানি নিশ্চিত করা সম্ভব। এতে শিক্ষকপ্রতি ক্লাসের সংখ্যা কমায় শিক্ষকের প্রস্তুতি গ্রহনও অনেকটা সহজ হয়।

        ২। পাঠদান সময়সূচি ঃ শিক্ষক স্বল্পতার পরেই আসে বিদ্যালয়ের পাঠদান সময়সূচি । আমরা জানি বয়স বাড়ার সাথেসাথে দায়িত্ব-কর্তব্যও বেড়ে যায়। কিন্ত এদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থার দিকে তাকালে মনে হয় বয়স যত কম হবে ততই তার কাজের ভার বেড়ে য়াবে। উদাহরন হিসেবে বলা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ছুটি হয় বিকাল ৪.৩০টায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২.০০টায় আর কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা নাইবা বললাম। আমি শিক্ষক হিসেবেই বলছি, দুপুর ০১.০০টার পূর্ব পর্যন্ত পাঠদানে যতটা আন্তরিকতা /এনার্জি থাকে ২.০০টার পর তা আর থাকেনা। সকাল থেকে ২.০০টা পর্যন্ত হচ্ছে পাঠদানের উপযুক্ত সময়। শিশুর শিক্ষার জন্য যেমন শিশুবান্ধব পরিবেশের দরকার তেমনি শিশুবান্ধব সময়েরও দরকার। দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে অবস্থানের কারণে শিশুদের মাঝে স্কুল পালানোর প্রবনতা লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের সময়সূচি সকাল ৭.০০টা থেকে দুপুর ২.০০টা করলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই মঙ্গল। এছাড়াও শিক্ষকগণ নির্ধারিত সময় শেষে ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল কাজগুলো নিষ্পত্তি করতে পারে, যা পাঠদানের সময়ে কোন বিরুপ প্রভাব ফেলেনা।শুধু তাই নয় শিক্ষগণ প্রস্তুতি গ্রহনেরও পর্যাপ্ত সময় পায়। লক্ষণীয় যে, প্রভাতি শাখায় কাজের মধ্যে যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যায় পরবর্তিতে তা আর দেখা যায়না।

        ৩। মেধাবী শিক্ষকদের পেশা বদল ঃ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকদের আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো না থাকায় এবং সময়ের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মেধাবী শিক্ষকগণ পেশা বদল করতে বাধ্য হন। ফলে মেধাবী শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আর যারা আছে তারাও মনে প্রাণে পেশাটিকে গ্রহন করতে পারেনি।

        ৪। নিয়োগবিধি ঃ নিয়োগ বিধিতে অসম শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং মহিলা কোটা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে বাধাসমূহের মধ্যে অন্যতম। এর ফলে অধিকতর কমযোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ায় মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে কিছুটা হলেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

        ৫। শিক্ষক বদলি নীতিমালাঃ   শিক্ষক বদলি নীতিমালা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে বাধাসমূহের মধ্যে অন্যতম।বছরের নির্দিষ্ট সময় বদলির জন্য নির্ধারিত থাকায় শিক্ষকগণ চাতক পাখির ন্যায় বসে থাকে। কখন আসবে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। ফলস্¦রুপ বদলির চিন্তায় পাঠদানে আর মন বসেনা। সারা বছর বদলির নিয়ম চালু থাকলে সারা বছর বদলির চিন্তা আর মাথায় থাকবেনা।

        ৬। অভিভাবকদের অসচেতনতাঃ অধিকাংশ অশিক্ষিত অভিভাবক তাদের সন্তানকে স্কুল থেকেে নিয়ে কাজে লাগিয়ে দেন। তাদেও কাছে নগদ প্রাপ্তিটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। যেহেতু তারা শিক্ষার আলো পায়নি তাই তারা তাদের সন্তানদেরও শিক্ষার আলোর সুযোগ করে দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে যা হওয়ার তাই হতে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুরা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হবে তাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত থেকে যাবে।
       ৭। দীর্ঘমেয়াদী বা টেকসই পরিকল্পনার অভাবঃ  টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার লক্ষ্য হলো মানস্মত শিক্ষা। মানস্মত শিক্ষার বিষয়ে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না।লিঙ্গবৈষম্য কিংবা অর্থনৈতিক বৈষম্যযার কারণে প্রাথমিক পর্যায়েই শিশুরা শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ শুধু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার বাড়িয়ে প্রত্যাশিত ফলাফল আশা করা যায় না।লক্ষ রাখতে হবে স্কুলগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে। বিজ্ঞানসম্মত সিলেবাসে ও পাঠদানে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারাদিও দিকে।
     ৮। শিক্ষকদের পাঠদান বহির্ভূত কাজ প্রদানঃ শিক্ষকদের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত ছিল অধ্যয়ন এবং পাঠদান। কিন্ত বাস্তবে তার উল্টা। কাজের একটি নমুনা এরুপঃ শিশু জরিপ,আদমশুমারি,কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানো,ভোটার তালিকা প্রণয়ণ,খানা জরিপ, ন্যায্যমূল্যে চাল বিতরণ, উপবৃত্তি সংক্রান্ত ইত্যাদি। যার ফলে পাঠদান সময়ের অনেকখানি অপচয়ই হয় বটে।
      ৯। অপরিকল্পিত শিক্ষক পোষ্টিংঃ    শিক্ষক পোস্টিং-এ সমন্বয়হীনতা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম বাধা বলে মনে করি।ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত নিশ্চিত না হয়ে শিক্ষকের বদলি/ডেপুটেশন প্রদান ব›ধ করতে হবে।
     ১০। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ঃ শিক্ষকের পরোক্ষ রাজনেতিক সমর্থন অন্যায়ের কিছু নয়। তাই বলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিক সুবিধা নেওয়া আবশ্যই দোষের। যার কারণে বিদ্যালয়ের শিখন শেখানো কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটা বেশি ঘটে সুবিধাজনক স্থানে পোস্টিং নেওয়া/ বিদ্যালয়ে উপস্থিতির ক্ষেত্রে।
     ১১। শিক্ষক সহায়িকার অভাব ঃ বছরের শুরুতে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা সম্ভব হলেও সময়মত শিক্ষক সহায়িকা সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি যার ফলে শিক্ষকগণ নতুন কারিকুলাম ও পাঠদানে নবতর ধারণা লাভে বঞ্চিত।
     ১২। পাঠদান পর্যবেক্ষণ ঃ শিক্ষক স্বল্পতার কারনে  প্রধান শিক্ষক পাঠদানে ব্যাস্ত থাকায় যথাযথভাবে পাঠদান পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না । পর্যবেক্ষণ না থাকায় জবাবদিহিতার অভাবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছেনা।
লেখক-
মোঃ মাহমুদুল হক
প্রধান শিক্ষক
মাইজালী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
জলঢাকা,নীলফামারী।

পুরোনো সংবাদ

শিক্ষা-শিক্ষাঙ্গন 1968186171079503561

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item