রংপুরের যুদ্ধাহত জামিরুল মূলক ,জাতির জনক মূল্যায়ন করলেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঠাঁই হয় নি

এস.কে.মামুন

দির্ঘ নয় মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন খুব সহজ কাজ ছিল না; এর বিপরীতে লুকিয়ে আছে হাজারো অজানা বেদনা ও আত্মত্যাগের কাহিনী। শাহাদৎবরণ, সম্ভ্রমহানি, পঙ্গুত্ববরণ, অঙ্গহানি থেকে শুরু করে এক-একটি মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবারের রয়েছে নানারকম মর্মান্তিক ইতিহাস। এমনি একজন অঙ্গহানি হওয়া বীর সন্তান রংপুর মহানগরীর তাজহাট এলাকার বাসিন্দা জামিরুল মূল্ক। মহান মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিয়ে পাক-হানাদারদের হাতে নির্মম নির্যাতনে অঙ্গহানির শিকার হন এই যোদ্ধা। স্বাধীনতা পরবর্তী তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নিজস্ব প্যাডে   স্বাক্ষর করা চিঠি ও আর্থিক সহায়তার চেক তৎকালিন রংপুর মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে যাকে প্রদান করেছিলেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সেই যুদ্ধাহত বীর সন্তান জামিরুল মূল্ক এর ঠাঁই হয়নি।
দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহনকারি জামিরুল মূলক এই প্রতিবেদককে বলেন, ১৯৭১-এ ইন্টামিডিয়েটে অধ্যয়নকালিন রংপুর কলেজ ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। ঐতিহাসিক ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে পরদিন ২৯ মার্চ মা ও ছোট ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে শহরের কেরানীপাড়া বাসা হতে গরুগাড়ি ভাড়া করে বহুকষ্টে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ থানায় গ্রামের বাড়ি উত্তর মুসরত মদাতী পৌঁছেন। সেখানে কয়েক দিন পর ভোটমারী হাইস্কুলে তৎকালিন ভোটমারী ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মুসা খাঁন ও জামিরুল মুলক সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধের একটি ক্যাম্প গঠন করেন। এখানে ৮/১০ দিন ৩ জন ইপিআর -এর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহনের পর ক্যাম্পটি হাতীবান্ধা থানার জাওরনী ইপিআর ক্যাম্পে (মুক্ত এলাকা) স্থানান্তরিত করেন। রংপুরের ছাত্রনেতা হারেছ উদ্দিন সরকার বীরপ্রতীক, জামিরুল মূল্ক ও আব্দুল ডাকাতের নেতৃত্বে সংগঠিত এবং প্রশিক্ষণ দেয়া আরম্ভ করেন। এখানে প্রশিক্ষনার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় কালীগঞ্জ থানার সীমান্তবর্তি গ্রাম চন্দ্রপুর ইজ্জত আলী মাস্টারের বাগানবাড়িখ্যাত বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থানান্তরিত হয় এবং প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। ইতোমধ্যে কালীগঞ্জের মরহুম করিম উদ্দিন এমপি ভারতের কুচবিহারে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প খোলেন এবং হারেছ উদ্দিন সরকারকে মুক্তিকামী যুবকদের তাঁর ক্যাম্পে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ছাত্রনেতা হারেছ উদ্দিনÑ জামিরুল মূল্ক ও ইজ্জত আলী মাস্টারের মাধ্যমে ১০/১৫ দিন পর পর ২৫-৩০ জন করে প্রশিক্ষনার্থী যুবকদের চন্দ্রপুর সীমান্তের ভারতীয় সিতাই বর্ডার দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। এমপি সাহেব সংগঠিত যুবকদের কুচবিহার টাপুরহাট ইয়থ ক্যাম্পে পাঠাতেন। টাপুরহাট ইয়থ ক্যাম্প যুবকদের যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষনের জন্য শিলিগুড়ি জেলায় অবস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর মূর্তি ক্যাম্পের একাংশে মুজিব ক্যাম্পে প্রেরণ করতেন। ওই সময় ইসমাইল হোসেন নামের একজন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত যোদ্ধা অসুস্থ হওয়ায় তাকে মুজিব ক্যাম্প থেকে কুচবিহারে করিম উদ্দিন এমপি’র ক্যাম্পে পাঠালে সেখান থেকে জামিরুল মুল্ক চন্দ্রপুর ক্যাম্পে নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সেপ্টেম্বর ৭১’র শেষ দিকে রংপুর শহরের খবরা-খবর নেয়ার জন্য হারেছ উদ্দিন সরকার জামিরুল মূল্ককে নির্দেশ দেন। এ সময় গঙ্গাচড়া থানার লক্ষ্মিটারী ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ডাঃ হোসেন আলী কয়েকজন যুবকসহ চন্দ্রপুর ক্যাম্পে গেলে হারেছ উদ্দিন সরকার জামিরুল মুল্ক ও ইসমাইল হোসেনকে ২টি হ্যান্ড গ্রেনেডসহ তাদেরকে ডাক্তারের সাথে রংপুরে পাঠান। এ সময় ডাঃ হোসেন আলী নিজে গাইড করে রাতের আঁধারে সেখান থেকে দু’জনকে নিয়ে তিস্তানদী পার হয়ে মহিপুরে নিজ বাড়িতে উঠেন। এখানে দিনের বেলা আত্মগোপনে থেকে রাতের বেলায় বালারঘাট ব্রীজ পার করে দেন। ওই সময় ব্রীজে রাজাকাররা সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকায় ব্রীজের ১ মাইল পূর্বদিক দিয়ে ঘুরে পানি সাঁতরিয়ে পার হয়ে হারাটি হয়ে খটখটিয়ায় ইসমাইলের বাড়িতে আসেন। জামিরুল মুল্ক সেখানে ১দিন অবস্থানের পর রাতে শহরের কেরানীপাড়ার পরিত্যক্ত নিজ বাড়িতে প্রবেশ করেন। পরদিন শহরের বিভিন্ন খবরা-খবর সংগ্রহ করেন এবং রাতে তৎকালিন নাউয়াটারী (ইঞ্জিয়ারপাড়া) পানির ট্যাংকির কাছে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বাড়িতে ফেরেন। পরদিন সকালে স্টভে ভাত রান্নার সময় পাকবাহিনীর দু’জন গোয়েন্দা সদস্য আকস্মিকভাবে বাসায় প্রবশ করে জামিরুল মুল্ককে পেছন থেকে পিস্তল উচিয়ে হ্যান্ডসআপ হতে বলে। এসময় তারা তাকে রশি দিয়ে পিছমোড়া করে চোখে কাপড় বেঁধে সেনপাড়া ডাঃ জুন বাবুর বাড়িতে কর্ণেল বশিরের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ওই ক্যাম্পে তিনিসহ আরও ৭জনকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে এবং প্রতি রাতেই সকলকে কোতয়ালী থানা হাজতে নিয়ে রাখে। এভাবে কয়েকদিন নির্যাতনের পর তার জ্যাঠা মফিজ উদ্দিন কর্ণেল বশিরের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর বন্ড দিয়ে প্রতিদিন একবার ওই ক্যাম্পে হাজিরা দেয়ার শর্তে তাকে ছাড়িয়ে নেন।
এমতাবস্থায় মাথার ওপর পাকসেনাদের বেঁধে দেয়া শর্ত, অন্যদিকে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার তীব্র প্রেরণা তাকে ব্যাকুল করে তোলে। মাস দেড়েক পর সম্ভবত নভেম্বর একাত্তুরের প্রথম সপ্তাহে এক রাতে এই যোদ্ধা জীবনবাজি রেখে পুনরায় ধাপ হ্যালিপ্যাডের কাছে লুকানো অপর গ্রেনেডটির বিস্ফোরণ ঘটায়। এর একদিন পরই পাকবাহিনীসহ আলবদররা তাকে ফের গ্রেফতার করে মুসলিম উদ্দিন ছাত্রাবাসে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে রাইফেলের বাট দিয়ে মুখে উপর্যুপরি আঘাত করায় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। চেতন ফেরার পর তিনি দেখেন তার সর্বাঙ্গে রক্ত, ওপরের মাড়ির দাঁত নেই। অসহ্য যন্ত্রনায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তার জ্যাঠা মফিজ উদ্দিন জামিরুল মুল্ককে ছাড়িয়ে নিয়ে সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যান।
বিজয়ের ৩ দিন পর ১৯ ডিসেম্বর ‘৭১ ছাত্রনেতা হারেছ উদ্দিন জামিরুল মুল্ক এর ওপর পাকবাহিনীর পৈশাচিক নির্যাতনের খবর পেয়ে তাকে দেখতে যান এবং চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেন। পরবর্তীতে ৭/২/৭৩ইং তারিখে ইস্যুকৃত এবং স্মারক নং সিডি/২৭৪ তাং ৬/৪/৭২ ইং এর বরাত দিয়ে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একখানা পত্র ও ৫০০ শত টাকার চেক (যার নম্বর সিএÑ০৩১৭৫০) তৎকালিন রংপুর মহকুমা প্রশাসক’র মাধ্যমে যুদ্ধাহত জামিরুল মুল্ককে হস্তান্তর করেন।
মহান স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও যুদ্ধাহত বীর যোদ্ধা জামিরুল মুল্ক তালিকাভূক্ত না হওয়ায় জাতির জনকের যোগ্য উত্তরসুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী আ. খ. ম মোজাম্মেল হকসহ সংশ্লিষ্টদের সদয় সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

পুরোনো সংবাদ

রংপুর 7552714819260669752

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item