বৃদ্ধ পিতা-মাতাঃ ধর্মীয় ও সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি


পিতা- মাতার মাধ্যমেই সন্তান পৃথিবীতে আসে। সন্তানের লালন- পালন যেন তখন পিতা-মাতার প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে সন্তান যেমন বড় হয় তেমনি পিতা-মাতা ও বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হয। সন্তানকে পিতা-মাতা যেমন আদর -¯েœহ, মায়া, মমতা দিয়ে লালন পালন করে থাকে তেমনি সেই পিতা-মাতা যখন বার্ধক্যে উপনীত হয় তখন তারা ও তাদের সন্তানের কাছ থেকে সে রকম আদর সোহাগ  মায়া মমতা প্রত্যাশা করে। তাই তো ইসলাম ধর্মে বৃদ্ধ পিতা -মাতাকে সেবা  করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শিল্পায়নের সাথে সাথে মানব সমাজে আসে অনেক পরিবর্তন। যৌথ পরিবারে সৃষ্টি হয় ভাঙনের। কর্মশক্তি হারিয়ে বৃদ্ধরা পরিবারের  নির্ভরশীল সদস্যে পরিনত হয়। আর মাঝবয়সীরা কর্মী হওয়ার নিযুক্ত থাকে উৎপাদন যন্ত্রে। যার ফলে উন্নত দেশগুলোতে গড়ে ওঠে বৃদ্ধাশ্রম (ওল্ডহোম) এর উপসংস্কৃতি।
    মানব সন্তান পিতা-মাতার কাছে অনেক ঋণী, গর্ভধারণ হতে শুরু করে সন্তানের লালপ পালনের পিতা-মাতা অনেক কষ্ট সহ্য করে থাকে। পিতা-মাতা তাদের জীবনকে যেন নিয়োজিত করে সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আবার সন্তানকে ধর্মে সঠিক বুঝ দান করা ও ধর্মীয় শিক্ষাদান করা পিতা-মাতার অবশ্যই কর্তব্য। তাই ধর্মীয় অনুসাশনের মধ্যে শিশুর সামাজিকী করণ নিশ্চিত করার প্রতি পিতা-মাতাকে মনোযোগী হতে হয়। সন্তানেরও পিতা-মাতার প্রতি রয়েছে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিশেষ করে পিতা-মাতা যখন বৃদ্ধ হয় তখন তারা ক্রমাগত অসহায় হতে থাকে। যে অবস্থায় তাদের সেবার দায়িত্ব সন্তানের উপর বর্তায়। কুর আল ও হাদিসে ও সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, পিতা-মাতার সাথে সৎ ব্যবহার কর। যদি তাদের মধ্য হতে একজন অথবা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বর্ধক্যে উপনীতহয় এই অবস্থায় ও কখনো তাদেরকে উহ শব্ধটি ও বলো না এবং তাদেরকে ধর্মক দিও না। অত্যন্ত আদব সহকারে তাদের সাথে কথা বলো। তাদের সম্মুখে সহঃতের সাথে বিনয়ের সাথে নত হয়ে থাক এবং এই দোয়া করতে থাকে হে আমার রব। যেভাবে তারা শৈশবকালে আমাকে লালনপালন করেছে সেভাবে আপনি ও তাদের উপর দয়াকরুন। (সুরাঃ বনী ইসরাঈল, ২৩-২৪) হযরত আবু হুরায়রা(রাবিঃ) হতে বর্নিত আছে যে নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন, ঐ  ব্যক্তি লাঞ্জিত ও অপমানিত হোক, পুনরায় লাঞ্জিত ও অপমানিত হোক, পুনরায় লাঞ্জিত ও অপমনিত হোক। আরজ করা হল, ইয়া রাসুলুল্লাহ্ কে (লাঞ্জিত ও অপমানিত হোক)? তিনি এরশাদ করলেন ,যে ব্যক্তি নিজ পিতা- মাতার -মধ্য হতে কোন একজনকে অথবা উভয়কে বৃদ্ধাবস্থায় পেল অতঃ পর (তাদের খেদমতের দ্বারা তাদের অন্তরকে খুশী করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। (মুসলিম)
অপর এক হাদিসে আছে যে ব্যক্তি নিজ পিতা-মাতা কিংবা তাদের মধ্য হতে একজনকে পেল অতঃপরতাদের সাথে অন্যায় আচরণ করল ঐ ব্যাক্তি দোযখে প্রবেশ করবে এবং আল্লাহ তায়ালাতাকে আপন রহমত হতে দূর করে দেবেন। তাইতো পিতা-মাতার সাথে সম্প্রীতি ও ভক্তির সাথে কথা বলা আদব। আর রূঢ়ভাবে ও ধমকের স্বরে কথা বলা নিষেধ। কোনভাবে তদেরকে কষ্ট দেয়া যাবে না। কথায় কাজে ও আচার আচরইে পিতাত-মাতার সম্মান রক্ষা করে চলাদরকার।পিতা- মাতর ভরণ-পোষণ দেয়া ও তাদের খেদমত করা ও সন্তানের দায়িত্ব। ইসলাম র্ধম মানবজাতিকে এশিক্ষাই দান করে। মানব সমাজ- পারির্বতনশীল। এ পরিবর্তনশীল সমাজ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের ভাবনা- চিন্তা ও কম নয়। সমাজ বিজ্ঞানী  হার্বাট স্পেন্সারের মতে, মানব সামজ ক্রমশ সরল থেকে জটিল অবস্থার দিকে এগুচ্ছে। আদিম সরল সজ -সরল আর সামাজিক পরিবর্তনের ফলে আধুনিক শিল্প সমকজ জটিল রুপ  ধারণ করছে। ফলে সামাজিক স্তরবিন্যাাস ও ব্যাপক শ্রমবিভজন পরিবারের গঠন ও কার্যাবলী উপর প্রভাব  ফেলছে । আবর সমাজ কাঠামোর মৌল উপাদানে পরিবর্তন ঘটলে তার প্রভাব অন্য উপাদানের উপর লক্ষ্য করা যায়। এখানে সমাজ বিজ্ঞানী কল মার্ক্সের কথা বলা যেতে পারে । তিনি অর্থনীতিকে সমাজের মৌলকাঠামো বলেছেন। আর মানুষের আচার আচরণ ,শিক্ষা সংস্কৃতি সবকিছুই হল উপরিসৌধ যা অর্থনীতি নামক মৌল কাঠামো দ্বারা নির্মীত। আদিমসমাজে মানুষের অর্থনীতির কেন্দ্রে ছিল শিকার ও সংগ্রহ। সে সমাজে শিশু ও বৃদ্ধদের চেয়ে মাঝ বয়সী যুবকরাই খাদ্য সংগ্রহ ও শিকারে বেশি অবদান রাখত। বৃদ্ধরা ছিল তাদের  উপর নির্ভরশীল । আবার কৃষি সমাজে বৃদ্ধরা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা ও যাদুুবিদ্যায় পারদর্শী হওয়ায় মর্যদা ভোগ করত। আস্তে আস্তে কৃষির পর আসে শিল্প সমাজ। গোটা সমাজেই আসে অমূল পরিবর্তন। উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ব্যাপক হারে । শিল্পায়নের ফলে মানুষ কলকারখানায় কাজ যোগদেন। সৃষ্টি হয় শহর ও নগরের। মানুষের স্থানান্তর শুরু হয় গ্রাম থেকে শহরে । কিন্তু পরিবার নামক সমাজের ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটেনি। বরং পরিবারে উপর সমাজের  পরিবর্তনে প্রভাব লক্ষ্য করা  যায়। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও উপাৎন কৌশলের পরিবর্তনের ফলে শিল্পায়ন ও শহরান মানব সমাজে এক ধরনের পরিবর্তন এনেছে তা হল (রেসিডেন্সিয়াল সেগ্রিগেশন) যার বাংলা হতে পারে আবাসন সংক্রান্ত বিচ্ছেদ বা পৃথকী করণ। আগের কৃষি নির্ভর  সমাজের তুলনায় বর্তমানের শিল্পনির্ভর সামজে পিত-মাতা চেয়ে সন্তানরাই শিক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই কর্মক্ষেত্রে বৃদ্ধদের চেয়ে নবীনদেরই চাহিদা বেশি হচ্ছে। পেশার বৈচিতত্র যেমন বেড়েছে তেমনি শিল্পনির্ভর সমাজে মানুষ শহরে এসে নানা পেশা গ্রহণ করেছে। একেক মানুষ একে একে পেশায় বিশেষায়িত (স্পেশালাইজড) হওয়ায় একই পরিবারের সব সদস্যের কর্ম ক্ষেত্র এক যায়গায় হচ্ছে না। কর্মের সুবাদে মানুষ একা বা অনু পরিবার নিয়ে অন্যত্র বাস করছে এভাবে রেসিডেসিয়াল (সেগ্রিগেশন) বা বসবাসের পৃথকীকরণ হচ্ছে। ফলে গ্রামের যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে । আবার ব্যক্তি পর্যায়ে উন্নয়ন ভাবনার ফলে সন্তানরা নিজ নিজ পেশায় ব্যস্ত হয়ে অর্থোপার্জনে মগ্ন হওয়ায় বাবা মার দায়িত্ব নিতে তেমন আগ্রহী হচ্ছে না। অনেকেই পিতা- মাতাকে গ্রামের বাড়িতেই রেখে যাচ্ছে। ফলে বৃদ্ধবয়সে পিতা- মাতাকে সন্তান দাড়াই থাকতে হচ্ছে। এটা মূলত আধুনিক সামাজে পরিবারের উপর শিল্পায়ন নানারায়নের প্রভাব বর্তমানে নারীরাও শিক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও ব্যাপক কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় নানান পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা পরিবারের বাইরে অনেক সময় কাটাচ্ছে। এতে তারা গৃহস্থালীর কাজ শিশুর লালন পালন ও বৃদ্ধ পিতা-মাতা বা শ্বশুর শাশুড়ির দেখা শোনায় মনোযোগী হতে পারছে না। বর্তমানে পুঁদিবাদী সমাজে মানুষের মধ্যে ব্যাপক ভোগবাদ লক্ষ্য করা যায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নানান সরঞ্জামাদির দ্বারা মানুষের জীবন ধারণকে সহজ করে তুলেছে। ইলেক্টনিক সামগ্রীসহ নানা পণ্যের ব্যাপক বিত্গনপরন ফলে মানুষের মধ্যে এসব পণ্য কেনার আগ্রহ বাড়ছে।এতে বেশি উপার্জনের প্রয়োজনে মানুষ নানা কাজের মধ্যে এমনভাবে নিয়োজিত হচ্ছে যেন বৃদ্ধ মা-বাবার সেবা যতœ করার সময়ই থাকছে না। বৃদ্ধ মা-বাবার সেবার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ছে পরিবারের বিকল্প কোন প্রতিষ্ঠানের। তাই আধুনিক শিল্পায়িত সমাজেই আমরা বৃদ্ধাশ্রম দেখতে পাই যা আদিম সমাজব কৃর্ষি নির্ভর সমাজে ছিল না। যুববয়সীয়া থাকছে উৎপাদনযন্ত্রে আর বৃদ্ধর আশ্রয় পাচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। এ বৃদ্ধাশ্রমের উপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে পশ্চিমা সমাজে। অবশ্য নিজের সন্তানের সাথে থেকে যতট মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায় এসব বৃদ্ধাশ্রমে ততটা পাওয়া যায় না।লক্ষ্যণীয় যে কিছু উন্নত দেশ যেমন জাপানে আজও বৃদ্ধরা অনেক মর্যাদাভোগ করে থাকে। আধুনিকায়ন বলতে অনেকই পাশ্চাত্যকরনকেই বুঝান।অর্থ্যাৎ পশ্চিমাদেশগুলো যেভাবে উন্নত হয়েছে ঠিক তেমন করে অনুন্নত দেশগুলো ও উন্নত হবে এটাই আধুনিকায়নের মূলকথা। পাশ্চাত্যকরণ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের ফলে সারাবিশ্বে সাংস্কৃতিক ব্যবধান ক্রমাগত ভাবে কমে আসছে। আর পশ্চিমা সংস্কৃতি দ্বারা মুসলিম সমাজ ও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। তাই ইসলামের স্বর্ণযুগে সন্তান হিসেবে পিত-মাতার সেবার যেমন নজির পাওয়া যায় বর্তমানে তেমনটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। পুঁজিবাদের ধাক্কা, আধুনিকায়ন  শিল্পায়ন নগরায়ন ও পাশ্চাত্য করণের প্রভাবে অনেক মুসলিম সন্তানই তাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখছেন ।আমরা বাংলাদেশে ও বেশ কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রম দেখতে পাই যেখানে স্বচ্ছল পরিবারের সদস্যও অনেক। সমাজে পরিবর্তন যতই আসুক না কেন প্রত্যেকেরই উচিৎ ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবিক কারণে বৃদ্ধ পিতা-মাতার পাশে দাঁড়ানো । তবে হ্যাঁ আজ যারা জনসংখ্যার মধ্যবয়সী কর্মঠ উৎপাদনশীল অংশ তারাও তো একসময় বৃদ্ধবয়সে উপনীত হবে, এটা ভুলে গেরে চলবে না।
আখতারুজ্জামান
রিএস,এস.(অনার্স) এম.এস.এস.(ঢাবি),
প্রভাষক (সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ),
চিলাহাটি সরকারি কলেজ , নীলফামারী,

পুরোনো সংবাদ

নিবিড়-অবলোকন 4872333148900198354

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item