‘২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের পরিকল্পনা চলছে’-সংসদে প্রধানমন্ত্রী
https://www.obolokon24.com/2017/02/25-march.html
ডেস্কঃ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার কথা স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান সরকার একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি অস্বীকার করার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বুধবার জাতীয় সংসদে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এসময় তিনি বলেন, ‘আজকে সময় এসেছে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনে আমাদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে ।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি দেশবাসীকে বলব আজকে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে- সারা বাংলাদেশের কোথায় কোথায় গণকবর আছে, কাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা আস্তে আস্তে তা খুঁজে বের করছি, সেগুলো সংরক্ষণ করছি।’
এর আগে সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এই বিষযটির উত্থাপন করে বলেন, পাকিস্তানের জুনায়েদ আহমেদ তার বইতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার বিষয়টি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে এ বইটি সেদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছেও পাঠানোর ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তিনি বিকৃত ও অসত্য তথ্য সম্বলিত এই বইটির নিন্দা করেন।
তিনি এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাকিস্তানের প্রতি তীব্র প্রতিবাদ জানানোর আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। পাকিস্তানের সে সময়কার স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান যেভাবে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল সেটা আমাদের চোখের সামনেই।
তিনি বলেন, এটা কোনদিনই গ্রহণযোগ্য না এবং পাকিস্তান গণহত্যা চালিয়ে যে অপরাধ করেছে সেজন্য তাদের বরাবরই ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা ক্ষমাতো চায়নি উল্টো এখন তাদের কৃতকর্মের দায়ভার মুক্তিবাহিনীর কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এটা বাংলাদেশের জন্য কোনদিন গ্রহণযোগ্য না। আমরা কখনও মানি না এবং যারা এই বই তৈরি করেছে তাদের ধিক্কার জানাই। আর আমাদের এখান থেকে তা কারা তাদের মদদ দেয় সেটাও আমার মনে হয় দেশবাসীর জানা উচিত। দেখতে হবে কারা এখনও তাদের সেসব বিদেশী প্রভূদের ভুলতে পারে নাই এবং তাদের তোষামোদী-খোষামোদী করে যাচ্ছে।
খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী যার স্বামী অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হয়েছিল সে- কিনা বক্তব্যে বলে যে-মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ হয় নাই। তাহলে কত হয়েছিল? যে কথাটা একেবারে স্বতঃসিদ্ধ, সবাই জানে, প্রত্যেকটা মানুষ যেটা স্বীকার করে নিয়েছে। সেখানে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া গণহত্যার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং সেই প্রশ্ন তোলার মাধ্যমেই মনে হয় তিনি তার বিদেশি প্রভূদের যেন সুযোগ করে দিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই- গণহত্যার বিষয় নিয়ে পাকিস্তান বই লিখে এবং সেটা আবার পাঠায় বাংলাদেশে। এত বড়ো দুঃসাহস তাদের কোথা থেকে আসলো সেটাই আমার প্রশ্ন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজকে স্বাধীন হলেও তাদের ধারণা ছিল বাংলাদেশ কোন দিনও স্বাধীন হবে না, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। আর সেজন্য ষড়যন্ত্রও তারা করেছে। সেই ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়েই ১৫ আগস্ট ঘটেছে। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ আজকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হয় নাই। বরং সমগ্র বিশ্বে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। আর এটাই বোধ হয় পাকিস্তানি জান্তাদের গাত্রদাহের কারণ। এজন্যই তারা আজ মিথ্যাচার করে চলেছে।
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করে বলেন, জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যখন দেশকে শত্রুমুক্ত করার আহ্বান জানালেন, এর পর পরই তাঁকে গ্রেফতার করা হলো। কিছুদিন পরে আমার মা, রাসেল, জামাল সহ সকলকে গ্রেফতার করা হলো। একটি স্যাতস্যাতে বাড়িতে আমাদের বন্দি অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়েছিল। আমরাও এক একজন ভুক্তভোগী ছিলাম।
তিনি বলেন, পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে কেবল গণহত্যা না, আমাদের মেয়েদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছে আমাদের আলবদর রাজাকাররা।
রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেছে সারাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এবং যেভাবে তারা গণহত্যা করেছে। তাদের একটাই কথাছিল এদেশের মানুষ নাকি সব হিন্দু হয়ে গেছে। তাদের খুঁজে বের করে হত্যা করো এবং তাদের কথা ছিল‘মানুষ চাই না, ভূখ- থাকলেই হবে (আদমী নাহি মাঙ্গতা মিট্টি মাঙ্গতা)। এই মানসিকতা নিয়ে তারা যেভাবে গণহত্যা শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী গণহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেন, ৬ বছরের একটি শিশুকে হত্যা করে তাঁর খুলী ফুটো করে পাকিস্তানের পতাকা লাগিয়ে তাকে দেযালে সেঁটে দেয়ার মত ঘটনাও তারা ঘটিয়েছে। হত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ- হাত কাটা, পা কাটা, মানুষ, কি বীভৎস সব ঘটনা তারা ঘটিয়েছে।
২৬ মার্চ কার্ফ্যু ছিল ২৭ তারিখ কার্ফ্যু তোলা হলো। তখন তিনি রাস্তায় বের হন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই বাসা ছেড়ে আমি রেহানা এবং আমাদের এক খালাতো বোনকে একসঙ্গে অন্য বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদাররা তাঁদের ৩২ নম্বরের বাসা আক্রমণ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় রাস্তায়, পিলখানার সামনে, সাত মসজিদ রোডের সামনে আমি নিজের চোখে দেখেছি লাশ পড়ে রয়েছে। মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, যে বাড়িতে তাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল তার সামনের বাড়িটিতে মেয়েদের ধরে এনে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হতো। সেই বাড়ির জানালায় কান পাতলেই মেয়েদের কান্নার শব্দ পাওয়া যেত। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের কলাবাগান, শুক্রাবাদসহ আশপাশের এলাকা থেকে ধরে এনে নির্যাতন চালানো হত। গ্রামের বাড়িতে তাঁর বৃদ্ধ দাদা-দাদিকে ঘর থেকে বের করে এনে ঘরে আগুন দেয়া হয়, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর দাদাবাড়িতে ৮/১০ জন লোক ছিল যাদের বাড়ি লুট করে জিনিসপত্র লঞ্চে তুলে হত্যা করে ফেলে যায়। এভাবেই এক একটা পরিবার এক একটি গ্রাম শেষ করে দিয়েছিল। কত বোন বিধবা হয়েছে, কত মা সন্তানহারা হয়েছে, কত সন্তান পিতৃহারা হয়েছে যার কোন ইয়ত্তা নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর এর ৪ জওয়ানকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার পূর্ব নির্ধারিত ঘোষণা ওয়ারলেসে প্রচার করায় দিনের পর দিন নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
সংসদ নেতা বলেন, ২৫ মার্চ রাতে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা, রাজারবাগে পাকিস্তানি হানাদাররা আক্রমণ করেছিল।
তিনি বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে তারা আক্রমণ করেছে, আমি কত জায়গার কথা বলব, এটাতো সমগ্র দেশের মানুষই দেখেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আর পাকিস্তান এখন বই লিখে তাদের যে কৃতকর্মের দায় মুক্তিবাহিনীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছে। এটা পাকিস্তানের জন্যই একটা লজ্জার বিষয়। তারা যা করেছে তারপর এই লেখার সাহস তারা কোত্থেকে পেল।’
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করে বলেন, বন্দিকালীন তিনি সন্তান সম্ভবা ছিলেন। যখন তাকে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় ওই মেডিকেলে বহু মানুষ চিকিৎসায় এসেছিল। তার কথা শোনার পর অনেকেই তাকে দেখতে আসেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, হাসপাতালেই তাদের মুখে তাদের দুঃখের ঘটনা শুনেছেন তিনি। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা যারা বেঁচে ছিলেন কিভাবে তারা দিনের পর দিন মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে লুকিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছেন। আর এখন দোষ চাপাতে চাইছে মুক্তিবাহিনীর ওপর।
তিনি বলেন, আজকে সময় এসেছে ২৫ মার্চকে আমাদের গণহত্যা দিবস হিসেবে গ্রহণে আমাদেরকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য একটি যথাযথ প্রস্তাব যেন আমরা সংসদে আনতে পারি আর সেই সাখে সাথে আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছেও সমস্ত তথ্য দিয়ে আমরা এটা প্রচার করবো এবং দাবি জানাবো যাতে করে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা হয়।
এ সময় ১৫ ফেব্রয়ারি দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এইদিনে ’৬৯ সালে আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে সমগ্র দেশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে সময় মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। এরপরে সমস্ত বাংলাদেশ ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। তারা কার্ফ্যু দিয়েছিল, রাস্তায় সেনাবাহিনী নামিয়েছিল তারপরেও বাংলাদেশে তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। মানুষের ¯্রােত ছিল সারা বাংলাদেশে। আমরাতো রাস্তার কর্মী তাই আমরাও তখন রাস্তায় ছিলাম। দিনটিরও ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন,কাজেই আমরা অনেক রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ঐ পরাজিত শক্তি আবার ষড়যন্ত্র করেছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। কাজেই এই ১৫ই ফেব্রয়ারি আসলে অনেক দিক থেকেই ঘটনাবহুল। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ২০০৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহিন নির্বাচন আয়োজন এবং ৩০ মার্চ পদত্যাগে বাধ্য হবার ঘটনাও উল্লেখ করেন। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর ১৪ ফেব্রুয়ারির নির্যাতনের কথাও স্মরণ করেন। ১৫ মার্চ সে সময় তিনি গ্রেফতার হন বলেও জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আমরা মিটিংয়ে বসেছিলাম সেখান থেকে আমি মতিয়া আপা, সাহারা আপা সহ আমাদের গ্রেফতার করে চোখ বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে হেয়ার রোডে এবং ডিজিএফআই’র অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদ করতে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন দিলেন আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম। যে খুচরা খুচরা দল করে নির্বাচন আয়োজন করেছিল কোন মানুষই ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যায় নাই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার কথা স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান সরকার একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি অস্বীকার করার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বুধবার জাতীয় সংসদে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এসময় তিনি বলেন, ‘আজকে সময় এসেছে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনে আমাদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে ।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি দেশবাসীকে বলব আজকে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে- সারা বাংলাদেশের কোথায় কোথায় গণকবর আছে, কাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা আস্তে আস্তে তা খুঁজে বের করছি, সেগুলো সংরক্ষণ করছি।’
এর আগে সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এই বিষযটির উত্থাপন করে বলেন, পাকিস্তানের জুনায়েদ আহমেদ তার বইতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার বিষয়টি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে এ বইটি সেদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছেও পাঠানোর ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তিনি বিকৃত ও অসত্য তথ্য সম্বলিত এই বইটির নিন্দা করেন।
তিনি এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাকিস্তানের প্রতি তীব্র প্রতিবাদ জানানোর আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। পাকিস্তানের সে সময়কার স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান যেভাবে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল সেটা আমাদের চোখের সামনেই।
তিনি বলেন, এটা কোনদিনই গ্রহণযোগ্য না এবং পাকিস্তান গণহত্যা চালিয়ে যে অপরাধ করেছে সেজন্য তাদের বরাবরই ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা ক্ষমাতো চায়নি উল্টো এখন তাদের কৃতকর্মের দায়ভার মুক্তিবাহিনীর কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এটা বাংলাদেশের জন্য কোনদিন গ্রহণযোগ্য না। আমরা কখনও মানি না এবং যারা এই বই তৈরি করেছে তাদের ধিক্কার জানাই। আর আমাদের এখান থেকে তা কারা তাদের মদদ দেয় সেটাও আমার মনে হয় দেশবাসীর জানা উচিত। দেখতে হবে কারা এখনও তাদের সেসব বিদেশী প্রভূদের ভুলতে পারে নাই এবং তাদের তোষামোদী-খোষামোদী করে যাচ্ছে।
খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী যার স্বামী অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হয়েছিল সে- কিনা বক্তব্যে বলে যে-মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ হয় নাই। তাহলে কত হয়েছিল? যে কথাটা একেবারে স্বতঃসিদ্ধ, সবাই জানে, প্রত্যেকটা মানুষ যেটা স্বীকার করে নিয়েছে। সেখানে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া গণহত্যার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং সেই প্রশ্ন তোলার মাধ্যমেই মনে হয় তিনি তার বিদেশি প্রভূদের যেন সুযোগ করে দিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই- গণহত্যার বিষয় নিয়ে পাকিস্তান বই লিখে এবং সেটা আবার পাঠায় বাংলাদেশে। এত বড়ো দুঃসাহস তাদের কোথা থেকে আসলো সেটাই আমার প্রশ্ন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজকে স্বাধীন হলেও তাদের ধারণা ছিল বাংলাদেশ কোন দিনও স্বাধীন হবে না, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। আর সেজন্য ষড়যন্ত্রও তারা করেছে। সেই ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়েই ১৫ আগস্ট ঘটেছে। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ আজকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হয় নাই। বরং সমগ্র বিশ্বে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। আর এটাই বোধ হয় পাকিস্তানি জান্তাদের গাত্রদাহের কারণ। এজন্যই তারা আজ মিথ্যাচার করে চলেছে।
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করে বলেন, জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যখন দেশকে শত্রুমুক্ত করার আহ্বান জানালেন, এর পর পরই তাঁকে গ্রেফতার করা হলো। কিছুদিন পরে আমার মা, রাসেল, জামাল সহ সকলকে গ্রেফতার করা হলো। একটি স্যাতস্যাতে বাড়িতে আমাদের বন্দি অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়েছিল। আমরাও এক একজন ভুক্তভোগী ছিলাম।
তিনি বলেন, পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে কেবল গণহত্যা না, আমাদের মেয়েদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছে আমাদের আলবদর রাজাকাররা।
রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেছে সারাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এবং যেভাবে তারা গণহত্যা করেছে। তাদের একটাই কথাছিল এদেশের মানুষ নাকি সব হিন্দু হয়ে গেছে। তাদের খুঁজে বের করে হত্যা করো এবং তাদের কথা ছিল‘মানুষ চাই না, ভূখ- থাকলেই হবে (আদমী নাহি মাঙ্গতা মিট্টি মাঙ্গতা)। এই মানসিকতা নিয়ে তারা যেভাবে গণহত্যা শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী গণহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেন, ৬ বছরের একটি শিশুকে হত্যা করে তাঁর খুলী ফুটো করে পাকিস্তানের পতাকা লাগিয়ে তাকে দেযালে সেঁটে দেয়ার মত ঘটনাও তারা ঘটিয়েছে। হত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ- হাত কাটা, পা কাটা, মানুষ, কি বীভৎস সব ঘটনা তারা ঘটিয়েছে।
২৬ মার্চ কার্ফ্যু ছিল ২৭ তারিখ কার্ফ্যু তোলা হলো। তখন তিনি রাস্তায় বের হন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই বাসা ছেড়ে আমি রেহানা এবং আমাদের এক খালাতো বোনকে একসঙ্গে অন্য বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদাররা তাঁদের ৩২ নম্বরের বাসা আক্রমণ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় রাস্তায়, পিলখানার সামনে, সাত মসজিদ রোডের সামনে আমি নিজের চোখে দেখেছি লাশ পড়ে রয়েছে। মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, যে বাড়িতে তাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল তার সামনের বাড়িটিতে মেয়েদের ধরে এনে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হতো। সেই বাড়ির জানালায় কান পাতলেই মেয়েদের কান্নার শব্দ পাওয়া যেত। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের কলাবাগান, শুক্রাবাদসহ আশপাশের এলাকা থেকে ধরে এনে নির্যাতন চালানো হত। গ্রামের বাড়িতে তাঁর বৃদ্ধ দাদা-দাদিকে ঘর থেকে বের করে এনে ঘরে আগুন দেয়া হয়, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর দাদাবাড়িতে ৮/১০ জন লোক ছিল যাদের বাড়ি লুট করে জিনিসপত্র লঞ্চে তুলে হত্যা করে ফেলে যায়। এভাবেই এক একটা পরিবার এক একটি গ্রাম শেষ করে দিয়েছিল। কত বোন বিধবা হয়েছে, কত মা সন্তানহারা হয়েছে, কত সন্তান পিতৃহারা হয়েছে যার কোন ইয়ত্তা নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর এর ৪ জওয়ানকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার পূর্ব নির্ধারিত ঘোষণা ওয়ারলেসে প্রচার করায় দিনের পর দিন নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
সংসদ নেতা বলেন, ২৫ মার্চ রাতে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা, রাজারবাগে পাকিস্তানি হানাদাররা আক্রমণ করেছিল।
তিনি বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে তারা আক্রমণ করেছে, আমি কত জায়গার কথা বলব, এটাতো সমগ্র দেশের মানুষই দেখেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আর পাকিস্তান এখন বই লিখে তাদের যে কৃতকর্মের দায় মুক্তিবাহিনীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছে। এটা পাকিস্তানের জন্যই একটা লজ্জার বিষয়। তারা যা করেছে তারপর এই লেখার সাহস তারা কোত্থেকে পেল।’
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করে বলেন, বন্দিকালীন তিনি সন্তান সম্ভবা ছিলেন। যখন তাকে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় ওই মেডিকেলে বহু মানুষ চিকিৎসায় এসেছিল। তার কথা শোনার পর অনেকেই তাকে দেখতে আসেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, হাসপাতালেই তাদের মুখে তাদের দুঃখের ঘটনা শুনেছেন তিনি। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা যারা বেঁচে ছিলেন কিভাবে তারা দিনের পর দিন মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে লুকিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছেন। আর এখন দোষ চাপাতে চাইছে মুক্তিবাহিনীর ওপর।
তিনি বলেন, আজকে সময় এসেছে ২৫ মার্চকে আমাদের গণহত্যা দিবস হিসেবে গ্রহণে আমাদেরকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য একটি যথাযথ প্রস্তাব যেন আমরা সংসদে আনতে পারি আর সেই সাখে সাথে আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছেও সমস্ত তথ্য দিয়ে আমরা এটা প্রচার করবো এবং দাবি জানাবো যাতে করে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা হয়।
এ সময় ১৫ ফেব্রয়ারি দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এইদিনে ’৬৯ সালে আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে সমগ্র দেশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে সময় মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। এরপরে সমস্ত বাংলাদেশ ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। তারা কার্ফ্যু দিয়েছিল, রাস্তায় সেনাবাহিনী নামিয়েছিল তারপরেও বাংলাদেশে তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। মানুষের ¯্রােত ছিল সারা বাংলাদেশে। আমরাতো রাস্তার কর্মী তাই আমরাও তখন রাস্তায় ছিলাম। দিনটিরও ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন,কাজেই আমরা অনেক রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ঐ পরাজিত শক্তি আবার ষড়যন্ত্র করেছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। কাজেই এই ১৫ই ফেব্রয়ারি আসলে অনেক দিক থেকেই ঘটনাবহুল। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ২০০৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহিন নির্বাচন আয়োজন এবং ৩০ মার্চ পদত্যাগে বাধ্য হবার ঘটনাও উল্লেখ করেন। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর ১৪ ফেব্রুয়ারির নির্যাতনের কথাও স্মরণ করেন। ১৫ মার্চ সে সময় তিনি গ্রেফতার হন বলেও জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আমরা মিটিংয়ে বসেছিলাম সেখান থেকে আমি মতিয়া আপা, সাহারা আপা সহ আমাদের গ্রেফতার করে চোখ বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে হেয়ার রোডে এবং ডিজিএফআই’র অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদ করতে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন দিলেন আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম। যে খুচরা খুচরা দল করে নির্বাচন আয়োজন করেছিল কোন মানুষই ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যায় নাই।