হারিয়ে যাচ্ছে গোমনাতীর কাসা শিল্পের শিল্পিরা।
https://www.obolokon24.com/2016/08/gomnati.html
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
হারিয়ে যাচ্ছে গোমনাতীর কাসা শিল্পের শিল্পীরা। পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে গেছে সবাই।পুরো ইউনিয়নে একজন মাত্র রয়েছেন যিনি পুরাতন কাসা -পিতলের মেরামত এবং অর্ডার পেলে কিছু নতুন বাসন তৈরী করেন।অথচ একটা সময় ছিলো নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার গোমনাতী ইউনিয়নে সারাদিন শোনা যেতো হাতুরি পেটানোর আওয়াজ। ভোর না হতেই ঠুক ঠাক, টুং টাং আওয়াজে জেগে উঠতো সারা গ্রাম। আওয়াজের ছন্দে সৃষ্টি হতো শৈল্পিক এক ইতিহাস। তার মাঝে শ্রমিকদের হাতের ফাঁকে উজ্জ্বল রঙের ঝিলিক দিয়ে উঠতো কাঁসার তৈরি পাত্রগুলো। তখন এই কাসা পিতল থেকে গৃহস্থলীতে ব্যবহৃত তৈজস্ব উৎপাদন থেকে শুরু করে তৈরি হতো নিখুঁত নকশার সব ভাস্কর্য। রংপুর জেলার ভূগোলে লেখা ছিল গোমনাতী কাসা-পিতলের জন্য বিখ্যাত। এখানে চমৎকার বাসনপত্র তৈরী হতো। ধিরে ধিরে বিলুপ্ত হতে থাকে কাসা-পিতলের বাসনপত্র।যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলে আসে এলুমিনিয়াম, স্টিল, প্লাস্টিক আর মেলামাইন।এককালে কাঁসা শিল্পের ব্যাপক প্রসার ও রমরমা অবস্থা থাকলেও এখন আর সেই ব্যস্ততা চোখে পড়ে না। দেখতে হয়না কাঁসা পল্লীর শ্রমিকদের ছোটাছুটি।যদিও হিন্দুদের বিয়েতে প্রথা অনুযায়ী কাসার বাসন দরকার হয়। কারন হিন্দুদের বিয়েশাদি এবং পূজা-পার্বণে কাসার ব্যবহারকে পূত-পবিত্র বলে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে।কিন্তু দাম খুব বেশী। এক সময় আভিজাত্য প্রকাশ পেত কাসা-পিতলের বাসনপত্র দ্বারা।বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিনের উপহার, অতিথি আপ্যায়নে কাসা পিতল শিল্পের তৈরি সামগ্রীর কোন বিকল্প ছিলনা। জামাই ও আত্মীয় স্বজনদের কাসার পাত্রে খেতে না দিলে তাদেরকে অপমান করা হয়েছে বলে মনে করা হতো। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে রুচি,চাহিদা এবং আভিজাত্য প্রকাশের উপকরনের।এখন কাসার দাম প্রতি কেজি ১২৫০টাকা। আগে ছিল ৫০/৬০ টাকা।অনেক ব্যবসায়ীর বসবাস ছিল এই ইউনিয়নটিতে,ছিলেন অনেক কারিগর।তাদের হাতের গড়া জগ,বাটি,পানের ডাবলা,থালা ছিল চোখ ধাঁধানো। কাসা-পিতলের কাঁচামাল ওরা সংগ্রহ করতেন ভারতের হলদিবাড়ী, জলপাইগুড়ি, কচুবিহার হতে। মাটির ফ্রেমের মধ্যে গলানো কাসা-পিতল দেয়া হতো ।তৈরী করা হতো সুদৃশ্য বাসনপত্র। নয়ন জুড়ানো এসব জিনিস ছিল ধনীদের ঘরে। কাসা-পিতল গলানোর জন্য ছিল আলাদা চিমনি। কয়লা ছিল এর প্রধান জ্বালানী। এখন মাত্র ১৫টি পরিবার এখানে বসবাস করেন যারা কাসা-পিতলের বাসন তৈরী করতেন। এরা হলো সহিদুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ, আনিছুর রহমান, জহির“ল হক, নজর“ল ইসলাম, লতিফর রহমান, মশিয়ার রহমান, মমতাজ আলী, লুত্ফর রহমান, আবু হোসেন বুলু, খায়র“ল ইসলাম, ওয়ালেব, খোকাবুড়া ওসমান আলী ও রফিকুল ইসলাম।চাহিদা না থাকায় ওরা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ে। কেউ ভ্যানচালক, কেউবা রিকশা- সাইকেলের মেকার, কেউ দিনমজুর হিসেবে কাজ করে।এদের মধ্যে সহিদুল ইসলাম করেন বাঁশের ব্যবসা।খোকাবুড়া বর্তমানে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে করুন দিনানুপাত করছেন।এখানকার তৈরী বাসনপত্র রপ্তানি হতো বিভিন্ন জেলায় এমনকি ভারতেও বিক্রি হতো। কাসা-পিতলের বাসনপত্র হারিয়ে গেছে।এই পেশা ছেড়ে অধিকাংশের সচ্ছলতা নেই।পুণর্বাসনের সুযোগও হয়নি। চরম দুর্দিন আর প্রতিকূলতার মাঝেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন হাফিজার রহমান নামে একজন কাসা শিল্পি। গোমনাতী ইউনিয়নের তেতুলতলায় যার বাস।পুরাতন কাসা -পিতলের মেরামত এবং অর্ডার পেলে কিছু নতুন বাসন তৈরী করেন তিনি।তবে তিনি হতাসার সুরে বলেন,চাহিদা না থাকায় এবং কাঁচামাল ও পুঁজির অভাবে হয়তো বেশীদিন এ পেশাকে ধরে রাখতে পারবেননা ।বহুমুখী সঙ্কটে পড়ে বিলুপ্ত গোমনাতীর ঐতিহ্যবাহী এই কাঁসা শিল্প।সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে গোমনাতীর কাসা শিল্পের শিল্পিরা।