রুদ্রমুর্তি তিস্তা॥ উজানে রেড এলার্ট

বিশেষ প্রতিনিধি, ২৪ জুলাই॥
প্রচন্ড গর্জনে রুদ্রমুর্তি ধারন করেছে তিস্তা নদী। তিস্তার উজানে ভারত কর্তৃ পক্ষ রেড এলার্ট জারী করায় বাংলাদেশ অংশের তিস্তা অববাহিকার চরও চরগ্রাম এবং তিস্তা সংলগ্ল গ্রামের মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আজ  রবিবার সকাল থেকে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। প্রচন্ড শব্দে প্রবাহিত তিস্তার রাক্ষুসী রূপ তিস্তা অববাহিকার মানুষজনকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। তিস্তার বানের তোড়ে  নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের তিস্তা অববাহিকার ২৫ হাজার মানুষজনের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া উজান থেকে তিস্তার গতিপথ পাল্টে ডালিয়ার তিস্তা ব্যারাজের উজানের চরখড়িবাড়ি ও পূর্ব খড়িবাড়ি মৌজার ১৫ টি গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসায় তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড ফিউজ হুমকীর পড়েছে। এটি বিধ্বস্থ হলে লালমনিরহাট জেলার দুটি উপজেলা হাতিবান্ধা ও কালিগঞ্জ তিস্তা নদীতে পরিনত হবার আশঙ্কা করছে এলাকাবাসী। ওই ১৫ গ্রামের পরিবারগুলো সকলে তিস্তার ডানতীর প্রধান বাঁধ সহ বিভিন্ন বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। ওই সব এলাকার ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভবনগুলো তিস্তায় ভেঙ্গে পড়ছে এবং বানের পানিতে তলিয়ে রয়েছে।
এদিকে উজানের ঢলের প্রচন্ড চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্ধ্যায় হুহু করে পানি বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। তিস্তায় কি হচ্ছে? কি হবে? তা কেউ ঠাওর করতে পারছেনা।
তিস্তার বন্যা ও ভাঙ্গনের কারনে ৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২হাজার ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৫শ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। এরমধ্যে চরখড়িবাড়ী মধ্য সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও টাবুর চর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, টেপাখড়িবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে অধিকাংশ ক্লাশরুমে ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে।
     বিধ্বস্থ হয়েছে চারটি সেতু, ৩০কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক। হুমকির মুখে পড়েছে চর খদিবাড়ি
বিজিবি ক্যা¤প ও দুইটি কমিউনিটি ক্লিনিক। ওইসব চরের আবাদি কয়েক হাজার একর জমির আমন বীজতলা বানির পানিতে ডুবে থাকায় পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এবারে আমন আবাদ হবে না
ওইসব জমিতে।বাস্তহারা পরিবারগুলো ঠাই নিয়েছে ডালিয়া হেলিপ্যাডসহ বিভিন্ন বাঁধ ও উচু স্থানে। তারা ভুগছে চরম খাদ্য ও আবাসন সংকটে। নিরাপদ পানির অভাবে অনেকেই পান করছে তিস্তা নদীর ঘোলা পানি।
বন্যার কন্ট্রোল রুম সুত্র মতে ডিমলা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন ও জলঢাকা উপজেলার দুইটি ইউনিয়নের ১৬টি গ্রাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। স¤পুর্ন ক্ষতি হয়েছে তিনশ ৮৮টি ঘড়বাড়ি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পাঁচ হাজার দুইশত ৪৬টি ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্থ লোকসংখ্যা ১৪হাজার দুইশ। ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে পাঁচশ’ প্যাকেট শুকনো খাবার, ত্রাণের চাল একশ তিন মেট্রিক টন, নগদ টাকা চার লাখ ৩৫ হাজার বিতরন করা হয়েছে।ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য আরও সাতশ ৭৬ বান্ডিল ঢেউ টিন, গৃহ নির্মাণের জন্য ২৩
লাখ ২৮ হাজার টাকা, ইঞ্জিনচালিত নৌকা কেনার জন্য চার লাখ টাকা ও উদ্ধার কাজের এক লাখ টাকা চেয়ে ত্রাণ অধিদফতরে চাহিদা পাঠানো হয়েছে।

 তিস্তা আমাগোর সোনার সংসার একদিনেই শেষ কইরা দিলো। দীর্ঘ ২০দিন তিস্তার হাটু পানিতে বসবাস করলেও আর থাকতে পারলাম না। সারা রাত বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সকালে বাড়ীর উঠানটা যখন তিস্তায় গিলি খেতে লাগল বাধ্য হয়ে হামরা সোবায় (সকলে) মিলে বাড়ীঘর ভেঙ্গে নিয়ে আননো বোরবার দুপুরে কথাগুলো বললেন পুর্ব খড়িবাড়ী গ্রামের আশরাফ আলী স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৪০)। আশরাফ আলী বলেন, ১০বিঘা জমি জিয়াত তিস্তা নিয়ে খেয়েও শান্তি পায়নি অবশেষে বাড়ীর ভিটেটাকে গিলে খেয়ে নিল। ৭জনের সংসারে কিভাবে চলবে ভেবে পাচ্ছে না তিনি। পরিবারের ৭জন সদস্য, ৬টি গরু, ৪টি ছাগল ও ৪টি ঘর নৌকায় করে আনতে পরিবারটির খরচ হয়েছে ১২হাজার টাকা। ২টি নৌকার প্রতিটির ভাড়া দিতে হয়েছে ৬ হাজার টাকা করে। তিস্তার ক্যাঞ্জার ড্যাম (কলম্বিয়া) বাধে পরিবারটি আশ্রয় নিয়েছে। রোববার বসতভিটা ভেঙ্গে ৭০টি পরিবার আসলেও তারা জানে না তাদের ভবিষ্যতে কি করবে। কিভাবে চলবে তাদের সংসার। সরকারীভাবে গত বৃহস্পতিবার থেকে ৩০৪টি পরিবারকে শুকনো খাবার বিতরন করা হচ্ছে।
একতার বাজার চর খড়িবাড়ী গ্রামের দুলাল খাঁর পুত্র ইব্রাহিম খাঁ (৫৬), আব্দুল গফুর (৪৮) , আজগর আলীর স্ত্রী বাছিরোন (৯৬) মৃত ইদ্রিস আলীর স্ত্রী আওয়া বেগম (৭৬),প্রতিবন্ধি শাহার আলীর (এক চোখ অন্ধ)  স্ত্রী রুপজান খাতুন (৫৫), মোঃ আলীর পুত্র রফিকুল ইসলাম (৪৫), গোলাপ খাঁর পুত্র  শাহার আলী (৬০), টেপাখড়িবাড়ী ৪ নং ওর্য়াডের বাসিন্দা মৃত ছলিমদ্দিনের পুত্র কাশেম আলী (১০৫),আফচার আলি (৬৫)সহ প্রায় পাচ শতাধিক মানুষ তিস্তা নদীর ভাঙ্গনের শিকার হয়ে সব কিছু হারিয়ে একটু মাথা গোজার ঠাঁই খুজে ফেরছে। এ সময় শাহার আলী জানায়, আমরা শেষ হয়ে গেছি। আমাদের চার ভাইয়ের প্রায় এক’শ বিঘা জমি নদীতে চলে গেছে। ঘরে মধ্যে রাখা প্রায় প্রায় এক’শ মন ভূট্টা, ২০/২৫ মন বাদাম,১০/১৫ মরিচসহ প্রায় পাচ লাখ টাকার আসবাবপত্র ভেসে গেছে। শুধু ঘরের কিছু টিনের চাল ছাড়া কিছুই নিতে পারিনি। আমরা নি:ম্ব হয়েছি। শেষ হয়ে গেছি জীবনের তরে। কিছুই ফিরে পাবো না হয়ত কোনদিন। এভাবেই কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, বাস্তু ভিটা হারা মধ্যেবয়সী নারি রুপজান খাতুন। তিনি বলেন কি আর থাকলো। শুধু জীবন গুলি নিয়ে জীবন তরী ভাসিয়ে তীরে এসে ঠেকেছি । জানি না কপালে আর কি আছে। এসব বানভাসী মানুষের কাঁন্নায় তিস্তাপাড় ভারী হয়ে ওঠেছে। শতবর্ষী নারী বাছিরোন বেওয়ার কন্ঠে একই কান্না। আর্তনাতে বুক ভাসছে তার।
দুপুরে নীলফামারীর সিভিল সার্জন ডাক্তার আব্দুর রশিদ, ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও প. প কর্মকর্তা ডাক্তার জেডএ ছিদ্দিকী বন্যা দুর্গত এলাকার লোকজনের স্বাস্থ্য সেবা দেখতে ছুটে আসেন। সিভিল সার্জন ডাক্তার আব্দুর রশিদ  জানায়, তিস্তার বাধে ২টি স্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এছারা বন্যাদুর্গতদের জন্য ১০টি মেডিকেল টিম সাবক্ষনিক ভাবে কাজ করছে।
ঝুনাগাছ চাপানি ফরেষ্টের চরের নদী ভাঙ্গা ৫০টি পরিবারের মাঝে সকালে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ১০ কেজি চাল, মশুর ডাল ও ১কেজি করে আলু বিতরন করেন ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান। এ ছারা  তিনি ফরেষ্টের চরে, ছাতুনামা, ভেন্ডাবাড়ী চরের ৩৭৬টি পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার, মোমবাতি ও দিয়াশালাই বিতরন করেছেন। ঝুনাগাছ চাপানি ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, ছাতুনামা ও ভেন্ডাবাড়ী গ্রামে ৭শ পরিবারের বসতভিটা হাটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে রয়েছে। টেপাখড়িবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন বলেন, টাবুর চর, জিঞ্জির পাড়া, একতার চরসহ আশেপাশের ১০টি গ্রামের সহ¯্রাধিক পরিবারের  হাটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে রয়েছে। সরকারীভাবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো বাধে আশ্রয় নিলেও ভারী বৃষ্টিপাতের কারনে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম  বলেন, তিস্তার বাধে আশ্রিত পরিবারগুলোর জন্য ১০টি নলকুপ ও ৩০টি স্যানিটারী ল্যাট্রিন স্তাপন করা হচ্ছ্।ে তিনি আরও বলেন তিস্তা নদীর সংলগ্ন ৭টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নায়েমা তাবাচ্ছুম শাহ  বলেন, ইতিমধ্যে সরকারী ভাবে ৯০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৩লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা, শুকনা খাবার জেলা প্রশাসক বরাদ্দ দিয়েছে।
নীলফামারীর ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোডের বন্যা পূর্বাভাস ও সর্তকীকরন  কেন্দ্র জানায়, রবিবার সকাল ৬টা থেকে ডালিয়ায় পয়েন্টে তিস্তা পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছিল।  দুপুর ১২টায়  ভারতের দো-মোহনি পয়েন্ট থেকে ওয়্যারলেন্স সেটে জানানো হয়  সেখাসে তিস্তার বানের পানি  বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার (বিপদসীমা ৮৫ দশমিক ৯৫ মিটার) উপর দিয়ে প্রবাহিত  হওয়ায় ভারত অংশের তিস্তায়  রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। ওই বানের পানি এখন বাংলাদেশের তিস্তায় ধেয়ে চলেছে।  উজানে তিস্তার রেড এলার্ডের কারনে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার তিস্তা পাড়ের পুর্ব বাইশপুকুর, পশ্চিম বাইশপুকুর, কিসামত ছাতনাই, পূর্ব ছাতনাই, ঝাড় সিংহেস্বর, বাঘের চর, টাবুর চর, ছাতুনামা, ভেন্ডাবাড়ি, হলদিবাড়ী, একতার চর, ভাসানীর চর, কিমামতের চরসহ ২৫টি  গ্রামের বসবাসরতদের  নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, তিস্তা নদীর চরাঞ্চলের বসবাসরত ও তিস্তা পাড়ের বসবাসরতদের সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের তিস্তার ডান ও বাম তীর বাঁধ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় ও ত্রান প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি আরো জানান তিস্তার বন্যার পানির সাথে তীব্র ভাঙ্গনে চরখড়িবাড়ি ও পূর্বখড়িবাড়ি মৌজার প্রায় ১৫ গ্রামের ৫৬০ পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে। তিস্তার ডালিয়ায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে তথ্য কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নীলফামারী জেলা প্রকৌশলী মাহমুদ আলীর সাথে তিনি, আমরা গাইড বাঁধে আশ্রয় নেয়া মানুষ জনের জন্য ইতি মধ্যেই ১৩টি নলকুপ বসিয়ে দিয়েছি। আরো ১০টি বসানোর কাজ চলছে। আমার জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আপাতত পানি খাওয়ার জন্য বেশ কিছু জারিকেন দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরো দেয়া হবে।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন বলেন, তিস্তার উজানের রেড এলার্টের কারনে সকল তিস্তার চর ও চর গ্রামে বসবাসরতদের নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে। সেই সাথে  সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি, বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তা, স্বেচ্ছাসেবি প্রতিষ্ঠানকে তিস্তা পাড়ের দূর্গতদের সহায়তা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তিস্তার উজানে রেড এলার্ট জারি করায় সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের তিস্তা ব্যারাজ ও ফ্লাড ফিউজ এলাকায় অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় সর্বোচ্চ সর্তকর্তা জারি করা হয়েছে।

পুরোনো সংবাদ

নীলফামারী 4043645940887410814

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item