কামলা-মজুর সংকটে মজুরি বৃদ্ধি পানির দামে ধান বিক্রি করছে কৃষকেরা


হাজী মারুফঃ



পীরগঞ্জে ইরি-বোরো ধানের বাম্পার ফলনেও কৃষকদের মরার উপর খারার ঘা পড়েছে। কর্মসৃজন কর্মসুচীতে সিংহভাগ মজুর-কামলা অন্তর্ভুক্ত থাকায় শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটতে পারছে না তারা। তার ওপর বৈশাখী ঝড়ো হাওয়ার আতঙ্কে রয়েছে তারা। পাশাপাশি ধানের বাজার মুল্য পড়ে যাওয়ায় হাসি নেই কৃষকের মুখে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় এবারে ইরি-বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নেই দিগন্ত জোড়া ধানের ক্ষেত। উপজেলা কৃষি বিভাগের সুত্রে জানা গেছে, এবারে ২২ হাজার ৮’শ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়েছে। ফলনও বেশ ভালো। কিন্তু ধান কাটতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছে কৃষকরা। কারণ মজুর-কামলার সংকট প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। চলতি মৌসুমে একজন মজুরকে দু’বেলা খাবারের পর সাড়ে ৩’শ টাকা দিতে হচ্ছে। অপরদিকে বাজারে পানির দরে ধান বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিমন ধান সাড়ে ৩’শ থেকে ৩৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মন ধানে একজন মজুরের দাম মেটানো যাচ্ছে না। উপজেলার বড় আলমপুর গ্রামের কৃষক আহাম্মদ আলী, খুশী মিয়া, চতরার আব্দুস সামাদ মিয়া, দ্বারিকামারীর আশরাফুল ইসলাম জানান, ধানের বাম্পার ফলন হলেও আমরা খুশী হতে পারছি না। কারণ কিষান (কামলা) পাওয়া যাচ্ছে না। তারা (কামলা) কর্মসৃজন কর্মসুচীর কাজ করছে। সেই সাথে বাজারে ধানের মূল্যও কমে গেছে। ধান কাটতে দেরী হওয়ায় ভর বৈশাখ মাসে শিলাবৃষ্টির আশঙ্কায় আতঙ্কিত দিন কাটাচ্ছি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দফতর সুত্রে জানা গেছে, প্রায় ৩ সপ্তাহ আগে পীরগঞ্জের ১৫টি ইউনিয়নে ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসুচী শুরু হয়েছে। ওইসব ইউনিয়নে চার হাজার ১২৪ জন শ্রমিক কাজ করছে। ওই শ্রমিকরা প্রতিদিন ২’শ টাকায় কাজ করছে। এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কর্মসৃজনে কাজ করায় শ্রমিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, জুনের প্রথম সপ্তাহেই কর্মসৃজন প্রকল্প শেষ হবে। তবে শুক্র ও শনিবার দু’দিন কর্মসৃজন প্রকল্প বন্ধ থাকে। তারা এই দুদিন সংসার কিংবা অন্যের কাজ করতে পারবে। অপরদিকে কিছু শ্রমিক ঢাকায়  অন্যান্য শহরে রিক্সা চালায়  ভাসমান কাজে যাওয়াতে শ্রমিক সংকট হয়েছে। এ ব্যাপারে খালাশপীরের স্বচ্ছল চাষী শফিকুল ইসলাম, আনিছার রহমান মন্ডল বলেন- মজুররা প্রতি একর জমির ধান কাটা এবং বাড়ীতে আনতে ৬ হাজার টাকা নিচ্ছে। আর মাড়াইয়ের খরচ প্রায় ৮’শ টাকা। যদি মেশিনে ধান মাড়াই করা হয়, তবে প্রতি একরে ১ হাজার ২’শ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে গরুর খাবারের জন্য খড় হবে না। কারণ খড়গুলো গুড়ো হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে বেশী টাকায় ধান মাড়াই করতে হয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সমীর চন্দ্র ঘোষ বলেন- আমরা কৃষকদের পাশে থেকে সাধ্য মতো সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছি। ধানের বাম্পার ফলনের মাধ্যমে তার প্রতিফলও পেয়েছি। আমরাও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছি। বৈশাখ মাস, শিলাবৃষ্টির ভয় থাকে। কৃষকরা ঠিকঠাক মতো ধান ঘরে তুলতে পারলে তাদের এবং আমাদের পরিশ্রম স্বার্থক হবে।
এদিকে বদরগঞ্জ (রংপুর)প্রতিনিধি জানান,
বদরগঞ্জে বোরো ধানের ফলন ভাল হলেও ধানের দাম না থাকায় কৃষি শ্রমিক সংকট ও মজুরি বৃদ্ধির কারণে কৃষকের মনে কোন আনন্দ নেই। ধানের দাম শ্রমিক সংকট ও মজুরি বৃদ্ধির কারণে ধান কাটা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রান্তিক কৃষকরা। এ উপর তাদের আরও ভাবিয়ে তুলেছে বৈশাখের এই বিরুপ আবহাওয়া কখন যে তাদের সোনালি স্বপ্ন দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যায় ঝড়ো হাওয়া। এ কারনে কৃষি শ্রমিক সংকট ও মজুরি পোষাতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে নিজেই নেমে পড়েছেন ধান কাটতে। গত রবিবার (৮মে)সরেজমিনে উপজেলা ঘুরে এমন চিত্রই চোখে পড়ে। কথা হয় রামনাথপুর ইউপির ফাটকের ডাঙ্গা গ্রামের কৃষক মাজেদ আলির (৪৫)সাথে। তিনি জানান; গড়ে প্রতি বিঘা জমিতে ইরি-বোরো ধান উৎপাদন হয় ৪০মন। এর পিছনে  সর্বসাকুল্যে খরচ হয় ১৪হাজার ৭শত টাকা। বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি মন ৩৮০টাকা দরে ধানের দাম ১৫হাজার ২শত টাকা। নিজের শ্রমটি বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে মাত্র ৫শত টাকা। ধানের দাম এ রকম থাকলে কৃষকরা আর কষ্ট করে ধান উৎপাদন করবে না। তারই কথার সূত্র ধরে একই এলাকার কৃষক মমিনুল ইসলাম(৫১) জানান; অনেক অর্থ আর হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তিনি ১৭ বিঘা(৬০শতাংশে) জমিতে বোরো ধানের চাষ করেন। ফলনও হয়েছে ভাল কিন্তু মনে আনন্দ নেই তার। কারন ধানের বর্তমান বাজার মুল্য ৩৮০টাকা। এতে করে কৃষক মমিনুলের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তিনি আরও জানান; শ্রমিক সংকটের কারনে আমার ধান কাটা একটু দেরিই হল। বদরগঞ্জ পৌর শহর শাহাপুর এলাকার কৃষক লুৎফর রহমান ২০বিঘা জমিতে(৫২শতাংশে)বোরো ধান আবাদ করেছেন। ধান আবাদ করে তার লোকসান গুনতে হচ্ছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন; আগামিতে ধানের দাম এমন হলে ধান চাষ করা তিনি কমিয়ে দিবেন। তিনি আরও জানান;গম ও ভ’ট্টাতেও কৃষকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। ধানের এই দামে সন্তানদের লেখাপড়া আর সাংসারিক খরচ কিভাবে চালানো সম্ভব? রামনাথপুর ইউপির মাষানডোবা খিয়ারপাড়া গ্রামের কৃষক নওশাদ আলির সাথে তিনি জানান; এক বিঘা জমি আবাদ করতে খরচ হয় ১২হাজার ৫শত টাকা অথচ ধানের দাম মন প্রতি ৩৬০টাকা। ধানের দাম কমপক্ষে ৫শত টাকা হলে কৃষকের কিছুটা লাভ হত । তিনি আরও জানান;সরকারি খাদ্য গুদামে আমাদের মত প্রান্তিক কৃষকরা ধান দিতে পারে না,আমরা ধান নিয়ে গেলে যে কোন অজুহাতে খাদ্য গুদাম কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বিদায় করে দেয়।উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়;এবারের বোরো মৌসুমে ১৭৪২৫হেক্টর জমিতে বোরোর চাষ হয়েছে। এর মধ্যে উফসি-১৩২২৫হেঃ,হাইব্রিড-৪২০০হেঃ জমিতে। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় ফলনও হয়েছে বাম্পার। 
উপজেলা কৃষি অফিসার মাহবুবর রহমান জানান; চলতি মৌসূমে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে তবে দাম কিছুটা কম হওয়ায় কৃষকের লোকসান গুনতে হচ্ছে।  
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এনামূল হক জানান;কৃষি অফিসের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকদের তালিকা নিয়ে ধান গুদামজাত করা হয়। তিনি আরও জানান;চলতি মৌসুমে তালিকাভূক্ত কৃষকদের কাছ থেকেই ধান সংগ্রহ করা হবে। 

পুরোনো সংবাদ

রংপুর 489148350017443351

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item