নাড়ির টান উপেক্ষা করে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি দিয়ে স্থায়ী ভাবে ভারত গমন করলেন ৪৮ জন

 তাহমিন হক ববী ঃ চলতি বছরের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্জলিত করেছিল ওরা। সেই রাতটি পোহালে পহেলা আগষ্টের সূর্য্যটা উঠেছে ৬৮ বছরের বন্দী জীবনের অবসান ঘটিয়ে। তিন মাস ২১ দিন পর আবার আরেকটি অপোর শেষ রাতটা ওদের র্নিঘুম কেটেছিল। সকালে ওরা একসাথে যে সুর্য্যটা দেখেছিল সেটির মধ্যে ফারাক দেখতে পেয়েছিল। সেটি আজ তাদের কাঁদিয়ে দিলো নিজ দেশ ভারতে যাওয়া প্রসঙ্গে।
চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় নাগারিকত্ব গ্রহণকারী সদ্য বিলুপ্ত পঞ্চগড়ের ৩৬টি ভারতীয় ছিটমহলের মধ্যে ১১টি থেকে ৯৮টি পরিবারের ৪৮৯ জনের মধ্যে ১৪টি পরিবারের ৪৮ জনকে ভারতে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের দু’টি বাস ও তার মালপত্র দু’টি ট্রাকে করে নেওয়া হয়।
রবিবার বিকাল ৪টায় চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্ত দিয়ে তাদের হস্তান্তর করা হয়। এসময় বাংলাদেশ অংশে নীলফামারী জেলার সহকারী প্রশাসক (রাজস্ব) মো: মজিবুর রহমান, নীলফামারীর সহকারী কাস্টমস কমিশনার হুমাউন হাফিজ, ডোমার উপজেলা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বসুনিয়া, ডোমার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছা: সাবিহা সুলতানা, বিজিবির ৫৬ ব্যাটলিয়নের লে: কর্ণেল গোলাম সারওয়ার উপস্থিত ছিলেন। ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে তাদের বরন করেন নেন কুচবিহারের এডিএম আয়শা রানী ও এসডিএম রঞ্জন ঝাঁ।
কেউ ভালো থাকার আশায়, কেউ সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নে, কেউ বা স্বজনের টানে আর কেউ কেউ অন্যের দেখাদেখি নাড়ির টান উপো করে স্থায়ী ভাবে  ভারত গমন করলেন।
গারাতি বিলুপ্ত নাজিরগজ্ঞ ৪২’র জয় প্রকাশ (৩৪) বলেন, এপার থেকে ওপারের দুরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেতো এপারের আকাশ ছেড়ে ওপারের আকাশের পথে হাটছে। মানুষের বুকের মধ্যে কথার পায়রা থাকে। মানুষের চোখের মধ্যে সমুদ্রের বিশাল নীল থাকে। মানুষের দু'হাতের মধ্যে পরম বন্ধুত্ব থাকে। মানুষের পুরো আমিত্ব জুড়ে কত মহাদেশ থাকে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে চিরদিনের জন্য চলে যাওয়ার সময় এতো কষ্ট সেটি জয়ের জানা ছিলনা। বাংলাদেশ  রাজ্যটা এত সুন্দর সেটি সে বুঝতে পেরেছে। মায়ার মত কিছু অনুভব ঘিরে থাকে। সামনের দিকে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে ভারত সীমান্তের দিকে।
ভারত সীমান্ত অতিক্রম করার আগে কথা হয় দ্বিজেন বর্মণের সাথে। অকপটে বললেন সে পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার গারাতি ছিটমহলের জীতেন বর্মণের ছেলে। ১০ বছর আগে বিয়ে করেছিলের ভারতের কুচবিহারের মহিতনগর নয়াপাড়ার মামাতো বোন রতœা রায়কে। ছিটমহল বিলুপ্ত হওয়া এবং ভারতীয় নাগরিকত্ব নিতে তার বাবা চার ভাই ও আতœীয় স্বজনরা কেউ রাজি হয়নি। তাই তারা ভারত যাচ্ছেন না। কিন্তু দ্বিজেনকে যেতে হচ্ছে স্ত্রী রতœার জেদের বসবতি হয়ে। কারন দ্বিজেন ভারত না গেলে স্ত্রী রতœা তার  দুই সন্তান মেঘলা (৮) ও বিষ্ণু(৫) কে নিয়ে ভারতে চলে যাবে একাই। এ জন্যই সংসারে অশান্তি না বাড়িয়ে বাধ্য হয়ে সবাইকে রেখে স্ত্রীর হাত ধরে ভারতে নাগরিকত্ব নিতে হয়েছে দ্বিজেনকে। তাই সে চলে গেল স্ত্রীর হাত ধরেই।
অপর দিকে স্ত্রী বাসন্তী বর্মন, পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্রী মেয়ে লক্ষ্মীরানী, ও চার বছরের শিশুপুত্র তাপস বর্মনকে বাংলাদেশে রেখেই ৪১ নাজিরগঞ্জ বিলুপ্ত ছিটমহলের মৃত শালবাবুর ছেলে মঙ্গলু বর্মন(৪১) তার মা সরবালা বর্মন(৬০) কে নিয়ে ভারত গমনের বিষয়টি এলাকায় চাঞ্চলের সৃষ্টি করেছে। অলস প্রকৃতির মঙ্গলু বর্মন নিজের দিকটা ভাবলেও ভাবেনি স্ত্রী ও দুই সন্তানের কথা। মঙ্গলুর স্ত্রীর সাফ কথা মুই শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ি কুন্ঠেও যাইমনা। মঙ্গলু তার মাকে নিয়ে ভারত চলে গেলেও স্ত্রী সন্তানের জন্য শুধু ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কিছুই রেখে যায়নি। বরং স্ত্রীর কষ্টের চারটি গরু বিক্রি করে তার অর্থ নিয়ে চলে গেল। এ ব্যাপারে মঙ্গলু বলেন স্ত্রী না গেলে আমার কি করার আছে। তাদের জোড় করে নিয়ে যেতে পারলামনা। তাই মাকে নিয়েই ভারত চলে গেলাম। রবিবার ছিল মঙ্গলুর মেয়ের পঞ্চম শ্রেনীর পিএসসি পরীক্ষা। সেদিকেও খেলায় ছিলনা মঙ্গলুর। তবে ভারতে ভাল না লাগলে বাংলাদেশ ফের ফিরে আসবো বলে জানায় মঙ্গলু।
৪২ নাজিরগঞ্জ বিলুপÍ ছিটমহলের ৮০ বছরের বৃদ্ধ সত্যরাম বর্মন। পরিবারের কেউ নেই তার। এখানে তার দেখা শোনা ও খাওয়া দাওয়া করাতো একই এলাকার জয়প্রকাশ। তাই  জয়প্রকাশ তার স্ত্রী তিন মেয়ে এক ছেলে সহ ভারতের নাগরিকত্ব নেয়ায় বাধ্য হয়ে এই বৃদ্ধকেও ভারতে চলে যেতে হলো। এই দলের তিনি সব থেকে বয়স্কো ব্যাক্তি।
দীর্ঘ ৬৮ বছর বন্দি জীবনের মুক্তির পর অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি ওপারের হলদিবাড়ি অভিবাসন সীমান্ত দিয়ে ভারতের মাটিতে পা রাখেন পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলের ১৪ পরিবারের নারী পুরুষ ও শিশু সহ ৪৮জন। এই অভিবাসন পথে এটিই পথ দল।  ৪৮ জনের মধ্যে ২৯ জন ছিল পুরুষ ও ১৯ ছিল নারী। রবিবার (২২নভেম্বর) বেলা ৩টায় চিলাহাটি Ñ হলদিবাড়ি
সীমান্ত পথেই বাংলাদেশের প্রশাসনের দেয়া দুইটি বাসে চেপে ও মালামাল পরিবহনের তিনটি ট্রাক সহ তারা ভারতের সীমান্তে প্রবেশ করে। তাদের সাথে  ভারতে প্রবেশ করেন বাংলাদেশস্থ্য ঢাকার ভারতীয়  হাইকমিশনের ফাষ্ট সেক্রেটারী মিঃ রমাকান্ত গুপ্ত। এর আগে উভয় দেশে বিলুপ্ত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতারা মিষ্টি বিনিময় করেন। এখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে লেগে যায় বেলা ৩টা ৪৫ মিনিট। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন নীলফামারীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) মুজিবুর রহমান, নীলফামারীর ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল জিএম সারোয়ার, ডোমার উপজেলার চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বসুনিয়া, ডোমার নির্বাহী কর্মকর্তা সাবিহা সুলতানা,পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল, ডোমার থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, পঞ্চগড় ও নীলফামারী নাগরিক অধিকার সম্বন্ময় কমিটির সভাপতি মফিজার রহমান প্রমুখ।
অপর দিকে ভারতের পক্ষে ছিলেন কুচবিহারের জেলা শাসকের এডিএম আয়শা রানী, এসডিএম রঞ্জন ঝা, বিএসএফের ৫৮ ব্যাটালিয়ানের ডিপুটি কমান্ডার একে ঝা, কাষ্টম সুপার সন্দীপ ব্যার্নাজী , ভারত ইউনিটের নাগরিক অধিকার সম্বন্ময় কমিটির সভাপতি দ্বীপ্তিমান গুপ্ত প্রমুখ। 
ভারত সীমান্তে পা রাখার আগে নাজিরগঞ্জ ছিটের জয়প্রকাশ কান্না বিজরিত কন্ঠে বলে উঠেন বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে আলোর মুখ দেখিয়েছেন। যা মরনের আগে পর্যন্ত ভুলবোনা। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন আপনারা ছিটবাসীদের জন্য অনেক সংবাদ লিখেছেন । আপনাদের লিখনির কারনে বঙ্গবন্ধুর কণ্যা প্রধান মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আমরা ৬৮ বছরের বন্দী জীবন থেকে রক্ষা পেয়ে নিজেদের দেশ ফিরে পেলাম।
চিলাহাটি ইমিগ্রেশনের উপ সহকারি পরিদর্শক(এএসআই) খুরশেদ জানান, ট্রাভেল পাশধারী বিলুপ্ত ছিটমহলের ১৪ পরিবারের ৪৮ জন নারী-পুরুষ ও শিশু প্রথম দফায় ভারত গেলেন। ািবলুপ্ত ছিটমহল গুলো হলো ৭৮ নম্বর গাড়াতি,নাটকতলা,৩৪ নম্বর বেনুয়ারডাঙ্গা,৩৬ নম্বর কাজলদিঘি, ৪১ নম্বর  নাজিরগঞ্জ, ৪২ নম্বর  নাজিরগঞ্জের ১৪ পরিবার। এই পথে সোমবার (২৩ নবেম্বর) যাবে ১৭৬ জন, মঙ্গলবার (২৪ নবেম্বর) যাবে ১৪৮, বুধবার( ২৬ নবেম্বর) ১০৮। চার দফায় কোন পরিবার ভারত যেতে পিছিয়ে পড়ে তাহলে সর্বশেষ ওই পরিবার গুলোকে ৩০ নবেম্বর ভারত গমনের সুযোগ দেয়া হবে।
চলতি বছরের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দি জীবনের মুক্তি মিলে ভারত বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলের কয়েক হাজার মানুষের। যার মধ্যে ১১১টি বাংলাদেশের এবং বাকী ৫১টি ভারতের ভুখন্ডের সাথে যুক্ত হয়। এগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি এবং নীলফামারীতে রয়েছে ৪টি।বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে ৯৭৯ জন মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব নিতে আবেদন করেন। তারাই ভারত গমন করছে।#

পুরোনো সংবাদ

প্রধান খবর 5060033573024628273

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item