বদরগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসক থেকেও নেই, রোগীর সেবা দেন এ্যাসিস্টেন্টরা

এস.কে মামুন -
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত চিকিৎসক থাকলেও তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে কাক্সিক্ষত স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন উপজেলার সাধারণ মানুষ। চিকিৎসকদের স্থানে রোগীদের সেবা দেন এ্যাসিস্টেন্টরা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৩১ শয্যার ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ আছে ১০ টি। এর মধ্যে আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তার পদটি ৭ মাস ধরে শূন্য রয়েছে। উপজেলার দশ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে আট উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়োগ পাওয়া আটজন মেডিকেল কর্মকর্তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের সংখ্যা এখন ১৭ জন। তারা সকাল ৮ টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালে উপস্থিত থাকার কথা।

কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে চিকিৎসক থাকেন না। রোগী দেখেন মেডিকেল সহকারীরা (এ্যাসিস্টেন্ট)। প্রথম খবর-এর এই স্টাফ রিপোর্টার সরেজমিন তিনদিন ওই হাসপাতাল ঘুরেও অনেকটা এমন চিত্র দেখেছেন।
গত ২ আগস্ট রোববার বেলা ১১ টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত হাসপাতালে অবস্থান করে ১৭ জন চিকিৎসকের মধ্যে ছয়জনকে উপস্থিত পাওয়া যায়। এরা হলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম, জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) নারায়ন চন্দ্র সরকার, সৈয়দা শাহনেওয়াজ নাজরুলাহ ইলোরা, উপজেলা মেডিকেল কর্মকর্তা তৌফিক আহম্মেদ, রাজিয়া বেগম, ডেন্ডাল সার্জন নাসরিন সুলতানা ও আয়েশা সিদ্দিকা। ওই সময়ের মধ্যে হাসপাতালে অবস্থান করে পাওয়া যায়নি গাইনী বিশেষজ্ঞ সাবিহা নাজনীন পপি, মেডিকেল কর্মকর্তা হেমন্ত রায় চৌধুরী, মালিহা কুদ্দুস, সাদিকুর রহমান, জিয়াউল হক, মেহের নিগার সুলতানা, আব্দুলাহ আল আশরাফী, নইমুল হাসান চৌধুরী, আওরঙ্গজেব সরকার ও শাহিনা সরকারকে।
অনুপস্থিতির বিষয়ে ডাঃ হেমন্ত রায় চৌধুরী বলেন, ‘আমি শনিবার রাতে হাসপাতালে ডিউটি করেছি। এ কারণে রোববার দিনে আমার ডিউটি ছিল না।’ গাইনী বিশেষজ্ঞ সাবিহা নাজনীন পপি বলেন, ‘আমি একদিনের ছুটিতে আছি।’ মালিহা কুদ্দুস বলেন, ‘আমি শুক্রবার রাতে ডিউটি করেছি। রোববার আমার অফিস ছিল না।’ ডা. শাহিনা সরকার ও সাদিকুর রহমান ফোন না ধরায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ওইদিন বেলা সাড়ে ১১ টায় হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখা যায়, মেডিকেল এ্যাসিস্টেন্ট ফাতেমাতুজ্জোহরা আগত রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। হাসপাতালের চিকিৎসা রেজিস্টার অনুযায়ী তিনি সকাল ৯Ñ১১ টা পর্যন্ত দুই ঘন্টায় ১২০ জন রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘ভাই, আমার সব রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। কিন্তু করার কিছু নেই। রোগীরা আসলে ফিরে দিতে পারি না।’ রোগী দেখার দায়িত্বে কে আছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাশের কক্ষে এমবিবিএস চিকিৎসক রাজিয়া বেগম আছেন। তার কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, তিনি মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি মুঠোফোন টেবিলে রেখে বলেন, ‘ভাই, অনেক চেষ্টা করছি এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না।’ তার কাছে রোগী না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এ হাসপাতালে নতুন  এসেছি। আমার কাছে চিকিৎসা নিতে রোগীরা আসে না।’ চিকিৎসা রেজিস্টার বহি অনুযায়ী তিনি ওইদিন বেলা সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত মাত্র ছয়জন রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন।
ওই মেডিকেল এ্যাসিস্টেন্টের নিকট চিকিৎসা নেওয়া ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মতিবালা (৪৫) বলেন, মোর শরীলোত খুব বিষ। আইতোত ঘুমবার পাও নাই। একটা ডাক্তার। খুব ভিড়। ঠেলাঠেলি করি ডাক্তারের গোড়োত গেনু, রোগের কথা শুনিলোয় না। খালি এইগলা খসখসা সাদা টেবলেট নেকি দেচে।’
এর আগেরদিন ১ আগস্ট শনিবার সকাল ৯ টায় সরেজমিন হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত পাওয়া যায় মাত্র দুইজন চিকিৎসককে। এরা হলেন- চিকিৎসক মেহের নিগার সুলতানা ও মালিহা কুদ্দুস। এদিন সাড়ে নয়টায় হাসপাতালে আসেন মেডিকেল কর্মকর্তা নইমুল হাসান চৌধুরী, ৯ টা ৫০ মিনিটে মোটরসাইকেল চেপে আসেন দায়িত্ব প্রাপ্ত আরএমও ডা. তৌফিক আহমেদ, ১০ টা থেকে ১০টা ১০ মিনিটের মধ্যে রংপুর সদর থেকে আসেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আমিনুল ইসলাম, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নারায়ন চন্দ্র সরকার, সৈয়দা শাহনেওয়াজ নাসরুলাহ ইলোরা ও নাসরিন সুলতানা। এ ব্যাপারে টিএইচও ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সবাই রংপুর সদরে থাকি। সেখান থেকে আসতে একটু দেরী হলো।’
তবে ওইদিন সকাল ৯ টা থেকে সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত এ প্রতিবেদক হাসপাতালে অবস্থানকালীন গাইনী বিশেষজ্ঞ সাবিহা নাজনীন পপি, মেডিকেল কর্মকর্তা হেমন্ত রায় চৌধুরী, রাজিয়া বেগম, সাদিকুর রহমান, জিয়াউল হক, আব্দুলাহ আল আশরাফী, আয়েশা সিদ্দিকা, আওরঙ্গজেব সরকার ও শাহিনা সরকার আসেননি। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে টিএইচও আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘তারা আসবে।’
অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে মেডিকেল কর্মকর্তা হেমন্ত রায় চৌধুরী বলেন, ‘আজ (শনিবার) আমার নাইট আছে। এ কারণে দিনে ডিউটি ছিল না। চিকিৎসক রাজিয়া বেগম বলেন, সমস্যার কারণে আজ আমি হাসপাতালে যেতে পারিনি।’
এদিন সরেজমিন দেখা যায় সকাল ১০ টা পর্যন্ত হাসপাতালের বহির্বিভাগে কোন চিকিৎসক বসেনি। বিভাগের সামনে ৩০-৩৫ জন রোগী চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় কথা হয় শাহাপুর গ্রামের ইলো বালার (৪৫) সাথে। তিনি পায়ের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে আটটা থেকে হাসপাতালে বসে আসি। এখনও ডাক্তার আসে নাই।’
চেংমারী গ্রামের আরেক গৃহবধূ রোকসানা (৩০) বলেন, ‘কয়টায় ডাক্তার বসপে কাঁয়ো কবার পাওচে না।’ বালুয়াভাটা গ্রামের কলেজ শিক্ষক ফয়সাল সরকার অভিযোগ করে বলেন, ‘ডাক্তারেরা হাসপাতালে না বসলেও বাইরে প্রাইভেট প্রাকটিস ঠিকই করেন। কিন্তু এগুলো দেখবে কে? সাধারণ মানুষের কি সেই ক্ষমতা আছে?
ওইদিন সাড়ে ১০ টায় মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় উপজেলার বাওচন্ডি কাজীপাড়া গ্রামের অসুস্থ সোহাগী বেগমের (৩৫) সাথে। তিনি বলেন, ‘আমি ২৮ জুলাই জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। দিনে একবার ডাক্তার এসে দেখলেও রাতে কোন ডাক্তার রোগী দেখতে ওয়ার্ডে আসে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন সেবিকা বলেন, এখানে সাত মাস ধরে আরএমও’র পদ খালি।  যিনি দায়িত্বে আছেন তিনি থাকেন রংপুর সদরে। সকালে হাসপাতালে আসেন, দুপুরে চলে যান। আর রাতে রোগী দেখবে কে?। মেডিকেল এ্যাসিস্টেন্টরাই রাতে রোগীদের একমাত্র ভরসা। অথচ তাঁদের রোগী দেখার কোন নিয়ম নেই।
এর আগে গত ২৯ জুলাই বুধবার দুপুর ১২ টা থেকে বেলা ২ টা৩০ মিনিট পর্যন্ত হাসপাতালে অবস্থান করে ১১ জন চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। এরা হলেন- উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচও) আমিনুল ইসলাম, গাইনী বিশেষজ্ঞ সাবিহা নাজনীন পপি, মেডিকেল কর্মকর্তা হেমন্ত রায় চৌধুরী, রাজিয়া বেগম, মালিহা কুদ্দুস, সাদিকুর রহমান, জিয়াউল হক, মেহের নিগার সুলতানা, আব্দুল্লাহ আল আশরাফী, নইমুল হাসান চৌধুরী ও শাহিনা সরকারকে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, অনুপস্থিত ওই চিকিৎসকদের মধ্যে জিয়াউল হক ও আওরঙ্গজেব সরকার রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা মাসিক বেতন ভাতা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে নিয়মিত তোলেন। আর চিকিৎসক  আব্দুল্লাহ আল আশরাফী গত পাঁচ বছর ধরে বিনা ছুটিতে হাসপাতালে অনুপস্থিত রয়েছেন। তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন বলে হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে।
গাইনী বিশেষজ্ঞ সাবিহা নাজনীন পপি বলেন, ‘আমি একদিনের ছুটিতে আছি।’ একই কথা বলেন চিকিৎসক মেহের নিগার সুলতানাও। চিকিৎসক মালিহা কুদ্দুস দাবি করেন, তিনি দুইটা পর্যন্ত হাসপাতালেই ছিলেন। চিকিৎসক হেমন্ত রায় চৌধুরী বলেন, ‘আমার দিনে ডিউটি নেই রাতে আছে, চিকিৎসক শাহিনা সরকার বলেন, ‘আমি ব্যস্ত আছি পরে কথা বলেন।’
এ ব্যাপারে দায়িত্ব প্রাপ্ত আরএমও ডা. তৌফিক আহমেদ বলেন, ‘ভাই’ চিকিৎসকদের উপস্থিত আর অনুপস্থিত না লিখে আমাদের সমস্যাগুলো নিয়ে লিখেন। তাহলে আপনি (সাংবাদিক) সবার কাছে গ্রহণ যোগ্যতা পাবেন।’ সমস্যাগুলো কি- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রমোশন নেই, খাবারের সময় পাই না, ঈদেরদিনও রোগী দেখতে হয়’।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ভাই’ আরএমও’র পদটি শূন্য হওয়ার পর থেকে এই অবস্থা বিরাজ করছে। যে চিকিৎসককে আরএমও’র দায়িত্ব দেই, তিনিই ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। কিছু বললেই ব্যক্তিগত সদস্যা দেখিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এ ভাবে  সাত মাসে দুইজন চিকিৎসক আরএমও’র দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।’
রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনের সাংসদ আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক এ প্রতিবেদককে বলেন, হাসপাতালে ডাক্তারদের অনুপস্থিত থাকার অভিযোগ পেয়ে গত  ১১ জুলাই হাসপাতালটি আকষ্মিক পরিদর্শনে গিয়ে তিনজন চিকিৎসককে অনুপস্থিত পাই। এরা হলেন- মেডিকেল কর্মকর্তা আয়েশা সিদ্দিকা, শাহিনা সরকার ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সৈয়দা শাহনেওয়াজ নাসরুলাহ ইলোরা। তাদেরকে কারণ দর্শানো হলে তারা জবাব দিয়েছেন। কিন্তু প্রথমবারের মত সতর্ক করে তাদেরকে ক্ষমা করা হয়েছে। এর পরও তারা অনুপস্থিত থাকলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পুরোনো সংবাদ

স্বাস্থ্য-চিকিৎসা 8322447223795386386

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item